kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২

 সেলিনা হোসেন : উৎস থেকে উৎসারিত


কালচিত্র প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২১, ০২:১২ পিএম  সেলিনা হোসেন : উৎস থেকে উৎসারিত

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন

 

সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের একজন জনপ্রিয় লেখক সেলিনা হোসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম সাহিত্যে নতুন মাত্রা লাভ করেছে।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সেলিনা হোসেনের ঔপন্যাসিক প্রতিভাকে প্রাণিত করে নিরন্তর। তাই ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন নির্মাণে তিনি বারবার ফিরে যান গৌরবোজ্জ্বল একাত্তরের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে একাত্তরে সাধারণ মানুষের জাগরণটাকেই ধরতে চেয়েছেন সেলিনা হোসেন।

নাফিউল হক নাফিউ

বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক সেলিনা হোসেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের নিরন্তর সাধনায় ইতিমধ্যে তিনি নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক শিল্পভুবন—পাঠককে শুনিয়েছেন তাঁর স্বতন্ত্র সত্তার স্বরগ্রাম। 

সমকালীন জীবন ও সংগ্রামকে সাহিত্যের শব্দস্রোতে ধারণ করাই সেলিনা হোসেনের শিল্প-অভিযাত্রার মৌল অন্বিষ্ট। এ ক্ষেত্রে শ্রেণি-অবস্থা ও শ্রেণিসংগ্রাম-চেতনা প্রায়শই শিল্পিতা পায় তাঁর ঔপন্যাসিক বয়ানে, তাঁর শিল্প-আখ্যানে। কেবল শ্রেণিচেতনা নয়, ঐতিহ্য-স্মরণও তাঁর কথাসাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ। উপন্যাসে তিনি পৌনঃপুনিক ব্যবহার করেছেন ঐতিহাসিক উপাদান, কখনো-বা সাহিত্যিক নির্মাণ।

উপন্যাসের মতো ছোটগল্প রচনাতেও সেলিনা হোসেন রেখেছেন নিজস্বতার পরিচয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, প্রেম-যৌনতা, ভণ্ডামি-প্রতারণা, শ্রেণিযুদ্ধ আর প্রতিরোধ-বাসনা—এই সব নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর বিশাল গল্পভূগোল।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন একগুচ্ছ গল্প, যেখানে শিল্পিতা পেয়েছে তাঁর প্রগত জীবনচেতনা। সেলিনা হোসেন তাঁর গল্পে প্রত্যাশা করেছেন নারীর অনেকান্ত উত্থান—তবে সে উত্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিনির্ভর। সামাজিক নির্ভর না হয়ে ব্যক্তিনির্ভর হওয়ার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর নারীরা পরিণতিতে হয়ে পড়ে স্তব্ধ, নির্বাক কিংবা মৌন। তবে ছোটগল্পে নারী-অভিজ্ঞতার রূপায়ণে সেলিনার সিদ্ধি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেনের আদিবাড়ি নোয়াখালী হলেও চাকরিসূত্রে বগুড়া ও পরে রাজশাহী থেকেছেন দীর্ঘকাল; কাজেই সেলিনাকে একেবারে ছেলেবেলায় নোয়াখালীতে বেশিদিন থাকতে হয়নি। সেলিনা হোসেনের মায়ের নাম মরিয়ম-উন-নিসা বকুল। মোশাররফ-মরিয়ামুন্ননেছা দম্পতির সব মিলিয়ে নয় ছেলেমেয়ে। সেলিনা ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ।

সেলিনা ১৯৫৪ সালে বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে রাজশাহীর নাথ গালর্স স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি এখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে বি.এ. অনার্স এবং ১৯৬৮ সালে এম.এ. পাস করেন।

সেলিনা ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পূর্বে তিনি বিভিন্ন পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলা একাডেমির 'অভিধান প্রকল্প', 'বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প', 'বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ', 'লেখক অভিধান', 'চরিতাভিধান' এবং 'একশত এক সিরিজের' গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় 'ধান শালিকের দেশ' পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরি থেকে অবসর নেন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ উৎস থেকে নিরন্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫টি, গল্প গ্রন্থ ১৩টি, ২২টি শিশু-কিশোর গ্রন্থ এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ১০টি। এছাড়াও ১৩টি সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

 

সৃষ্টি কর্ম

উপন্যাস সম্পাদনা: উত্তর সারথি (১৯৭১), জলোচ্ছ্বাস (১৯৭৩) ১ম উপন্যাস, জ্যোস্নায় সূর্যজ্বালা' (১৯৭৩), হাঙর নদী গ্রেনেড' (১৯৭৬), মগ্ন চৈতন্যে শিস (১৯৭৯), যাপিত জীবন (১৯৮১), নীল ময়ূরের যৌবন (১৯৮২), পদশব্দ (১৯৮২), চাঁদবেনে (১৯৮৪), পোকা মাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬), নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭), ক্ষরণ (১৯৮৮), কাঁটাতারে প্রজাপতি (১৯৮৯), খুন ও ভালোবাসা (১৯৯০), কালকেতু ও ফুল্লরা (১৯৯২), ভালোবাসা প্রীতিলতা (১৯৯২), টানাপোড়েন (১৯৯৪), গায়ত্রী সন্ধ্যা-১ম খণ্ড (১৯৯৪), গায়ত্রী সন্ধ্যা-২য় খণ্ড(১৯৯৫), গায়ত্রী সন্ধ্যা-৩য় খণ্ড (১৯৯৬), দীপাম্বিতা (১৯৯৭), যুদ্ধ (১৯৯৮), লারা (২০০০), কাঠ কয়লার ছবি (২০০১), মোহিনীর বিয়ে (২০০১), আণবিক আঁধার (২০০৩), ঘুমকাতুরে ঈশ্বর (২০০৪), মর্গের নীল পাখি (২০০৫), অপেক্ষা (২০০৭), দিনের রশিতে গিটঠু (২০০৭), মাটি ও শস্যের বুনন(২০০৭), পূর্ণছবির মগ্নতা (২০০৮), ভূমি ও কুসুম (২০১০), যমুনা নদীর মুশায়রা (২০১১), আগস্টের একরাত (২০১৩), গেরিলা ও বীরাঙ্গনা (২০১৪), দিনকালের কাঠখড় (২০১৫)

গল্প: উৎস থেকে নিরন্তর (১৯৬৯), জলবতী মেঘের বাতাস (১৯৭৫), খোল করতাল (১৯৮২), পরজন্ম (১৯৮৬), মানুষটি (১৯৯৩), মতিজানের মেয়েরা (১৯৯৫), অনূঢ়া পূরণিমা (২০০৮), সখিনার চন্দ্রকলা (২০০৮), একালের পান্তাবুড়ি (২০০২), অবেলার দিনক্ষণ (২০০৯), নারীর রূপকথা (২০০৯), নুনপান্তার গড়াগড়ি (২০১৪), মৃত্যুর নীলপদ্ম (২০১৫)

 

কবিতা: বর্ণমালার গল্প, শিশু-কিশোর সাহিত্য, সাগর (১৯৯১), বাংলা একাডেমী গল্পে বর্ণমালা (১৯৯৪), কাকতাড়ুয়া (১৯৯৬), বর্ণমালার গল্প (১৯৯৭), আকাশ পরী (২০০১), অন্যরকম যাওয়া (২০০১), যখন বৃষ্টি নামে (২০০২), জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি (২০০২), মেয়রের গাড়ি (২০০৩), মিহিরুনের বন্ধুরা (২০০৪), রংধনু (সম্পাদনা) (২০০৪), এক রুপোলি নদী (২০০৫), গল্পটা শেষ হয় না (২০০৬), বায়ান্নো থেকে একাত্তর (২০০৬), চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ (২০০৮), মুক্তিযোদ্ধারা (২০০৯), সোনারতরীর ছোটমণিরা (২০০৯), পুটুসপুটুসের জন্মদিন (২০১০), নীলটুনির বন্ধু (২০১০), কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ (২০১১), ফুলকলি প্রধানমন্ত্রী হবে (২০১১), হরতালের ভূতবাবা (২০১৪), 

প্রবন্ধ: স্বদেশে পরবাসী (১৯৮৫), ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন (১৯৮৫), একাত্তরের ঢাকা (১৯৮৯), নির্ভয় করো হে (১৯৯৮), মুক্ত করো ভয় (২০০০), ঘরগেরস্থির রাজনীতি (২০০৮), নিজেরে করো জয় (২০০৮), প্রিয় মুখের রেখা (২০১০), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০১০), পথ চলাতেই আনন্দ (২০১৪) 

সম্পাদনা:

নারীর ক্ষমতায়ন : রাজনীতি ও আন্দোলন (যৌথ) (২০০৩), ইবসেনের নারী(২০০৬), ইবসেনের নাটক ও কবিতা (২০০৬), জেন্ডার বিশ্বকোষ (যৌথ) (২০০৬), বাংলাদেশ নারী ও সমাজ (যৌথ) (২০০৭), জেন্ডার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন (যৌথ) (২০০৭), সাহিত্যে নারীর জীবন ও পরিসর (যৌথ) (২০০৭), জেন্ডার আলোকে সংস্কৃতি (যৌথ) (২০০৭), পুরুষতন্ত্র নারী ও শিক্ষা (যৌথ) (২০০৭), দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী গল্প(যৌথ) (২০০৮), জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ (২০০৯), ধান শালিকের দেশ (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোর পত্রিকা, ২২ বছর), ছোটদের অভিধান (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত) (অন্যতম সম্পাদক)

ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাস

Selected Short Stories of Selina Hossain 2007. Published by Bangla Academy.

The Shark The River & The Grenade 1987 Published by Bangla Academy. Translated by Abedin Kader.

Warp and Woof 1999. 'টানাপোড়েন' উপন্যাসের অনুবাদ। Published by Bangla Academy.

Plumed Peacock (1st Published- 1983. 2nd published- 2009. 'নীল ময়ূরের যৌবন'উপন্যাসের অনুবাদ। Translated By Kabir Chowdhury.

Fugitive colours 2010

 

পুরস্কার ও সম্মাননা

২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি যেসব পদক লাভ করেন: ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক ১৯৬৯, উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার- ১৯৮০, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার- ১৯৮১, চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৯৭, ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার- ১৯৯৪, ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক- ২০০৯ সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার- ২০১৮, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ শাখায় পঙ্খিরাজ থেকে প্রকাশিত অপেক্ষা গ্রন্থের জন্য পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার- ২০১৯, ব্র্যাক ব্যাংক- মকাল সাহিত্য পুরস্কার - ২০১৮, সার্ক সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫।

উৎস থেকে উৎসারিত, সতত বহমান এই সব জীবন যেন নিরন্তর ঘণ্টা ধ্বনির মতোই তাদের সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে যাচ্ছেন। একইভাবে উৎস থেকে উৎসরিত নিরন্তর ঘণ্টা ধ্বনির মতো লেখিকা এখানো এক-একটি সাহিত্য রচনা করে যাচ্ছেন। আশা করা যায় এই ধ্বনি আরো অনেক দিন, বিচিত্র দ্যোতনায় অনুরণিত হবে।

চুয়াত্তর- অতিক্রমী এই সাহিত্যিকের কাছে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে। তাই তাঁকে সুস্থ থাকতে হবে, থাকতে হবে বিগত অর্ধশতাব্দীর মতো কর্মচঞ্চল। সাহিত্যিক-সমাজচিন্তক-প্রশাসক সেলিনা হোসেনকে জন্মদিনের অনেকান্ত শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করি তাঁর এই মঙ্গলগীত।

সুত্র: ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া

 

লেখা: নাফিউল হক নাফিউ 

(কবি, প্রাবন্ধিক)

সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম কর্মী।

Side banner