kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

কবি শামসুর রাহমান : কবিতার বাস্তবতা বা বাস্তবতার কবিতা


কালচিত্র | খালেদ হোসাইন প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১, ০৮:১১ পিএম কবি শামসুর রাহমান : কবিতার বাস্তবতা বা বাস্তবতার কবিতা

খালেদ হোসাইন

কবি শামসুর রাহমান : কবিতার বাস্তবতা বা বাস্তবতার কবিতা

শামসুর রাহমান শুধু বালাদেশের সাহিত্যে নন, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রতিনিধিত্বশীল কাব্যস্রষ্টা। সর্বপ্রান্তস্পর্শী আবেগ ও চিন্তার প্রতিফলন তাঁর কাব্যের মৌলিক বিশেষত্ব। তবু সার্বিক সৃষ্টিসম্ভারের আলোকে তিনি নাগরিক বৈদগ্ধময় একজন স্বাদেশিক চেতনাগর্ব কবি হিসেবেই পরিগণিত। দ্বিজাতিতত্ত্বখণ্ডিত এই বাংলার বিপর্যযকর ও অসম্মানিত বাস্তবতা ও এর প্রভাব তিনি যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে ক্রমাগত তাঁর কবিতা ব্যক্তিগত রোম্যান্টিকতার ঘেরাটোপ ছিন্ন করে বিশালায়তন স্বদেশ ও তার মানুষের যুগভাষ্য প্রণয়নের জন্য আত্মনিবেদন করেছেন; কিন্তু স্বাধীনচিন্তা উচ্চারণের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এই দেশে বরাবরই ছিল কম।

তাই কবি শামসুর রাহমান তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের কোটি প্রাণে, আমাদের শুভ মানবিক চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছেন। কারণ, কবি শামসুর রাহমানের জীবনের ব্রত ছিল জীবনে সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা, মানুষের কল্যাণ। এ কারণেই একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন,

হৃদয়ে আমার সাগর দোলার ছন্দ চাই

অশুভের সাথে আপোসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই।

একজন কবি সব সময় তাঁর নিজের কথা বলেন কিন্তু  প্রকৃত বড় মাপের কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি সকল মানুষের হৃয়ের আর্তিকে ধারণ করে। তাই কবির লেখার সঙ্গে সকল মানুষ আত্মীয়তা বোধ করে। এ সামর্থ্য যে কবির যত বেশি, তিনি তত বড় কবি। শামসুর রাহমানের কবিতায় আমাদের ব্যক্তিগত আনন্দ ও বেদনা অত্যন্ত সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে বলেই তিনি সকল শুভচেতনাসম্পন্ন মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতা আমাদের জাতিগত ইতিহাস হয়ে উঠেছে।

আমাদের জাতীয় জীবনে যত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, শামসুর রাহমানের কবিতায় তা ফুটে উঠেছে অনাবিলভাবে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন, আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস শামসুর রাহমানের কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কিন্তু মানুষের স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ত হয়নি। এ দেশ নানা রকম রাজনৈতিক জটিলতায় ঘুরপাক খেয়েছে। নেমে এসেছে স্বৈরাচারী শাসন। নূর হোসেনর মতো অনেক মানুষ। সেই নূর হোসেনকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন বাংলাদেশে। পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার, আমাদের স্বাধীনতা আকাক্সক্ষাকে তিনি তখন তাঁর কবিতায় রূপদান করেছেন। সেই সব কবিতা মুক্তিযুদ্ধে আমদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি লিখেছেন,

‘স্বাধীনতা, তোমার জন্যে

হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে

ব’সে আছে পথের ধারে।

...

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত

ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,

নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক

এই বাংলায়

তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।

শামসুর রাহমানের প্রথম পর্যায়ের কাব্যসম্ভার বিশুদ্ধ রোম্যান্টিকতাস্নাত, কিন্তু অচিরেই তাঁর কবিতার গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য হয়ে ওঠে সমকাল, সমাজস্বত্ব ও মনুষ্যত্ব। মূলত নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনের আবেগ ও চিন্তা, তাদের জীবন-যাপনের অনুপুঙ্খ অচিন্ত্যপূর্বভাবেই রূপায়িত হয়েছে তাঁর কবিতায়। কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনন্দ-বিষাদ নয়, সমাজবাস্তবতার মর্মমূলে আছড়ে পড়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা- সে অনুভূরি বিস্কর বিস্তার অনিবার্য হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়, বিশেষত আমাদের সে সময়ের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কারণে। ষাটের দশকের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার চালচিত্রে পরিণত হয় শামসুর রাহমানের কবিতা। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কবিতা স্পষ্টভাবে বা রূপকের অন্তরালে- হয়ে উঠেছে আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অসামান্য প্রামাণ্য দলিল। ব্যক্তির অনিকেত-মনোভঙ্গি, তাঁর নৈঃসঙ্গ্য, বিষণ্ণতা ও বিপন্নতার  বোধও মিছিল বা জনসভার পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে কবিতার অন্তর্লোকে। ‘রুপালি স্নান’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে। ব্যক্তিক রোমান্টিকতায় সমাচ্ছন্ন হয়েই তিনি লিখেছিলেন, ‘যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি/প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবু শান্ত রুপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।’ কিন্তু কবিকেও সামাজিক জীবন কবুল করে নিতে হয়। পরিপার্শ্বকে ঠাহর করে দেখতে হয়। চারপাশের মানুষজনের জীবনের অন্ধকারও ও অন্তরঙ্গতার আলো আবিষ্কার করতে হয়। শিশির ছেড়ে অগ্নিসমুদ্দুরে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তাঁকে অনুধাবন করতে হয়, ‘সঙ্গীত সাধক, কবি, চিত্রকর অথবা ভাস্কর, কাউকেই/খুব বেশি ভালো থাকতে নেই।/খুব বেশি ভালো থাকা মানে/মোহের নাছোড় লতাগুল্মসমেত স্নোতের টানে/সেখানেই অনিবার্য খর ভেসে যাওয়া,/যেখানে কস্মিনকালে বয় না শিল্পের জল-হাওয়া।’ (‘খুব বেশি ভালো থাকতে নেই’)। বা, ‘কখনো না-দেখা নীল দূর আকাশের/মিহি বাতাসের/সুন্দর পাখির মতো আমার আশায়/হৃদয়ের নিভৃত ভাষায়/দুঃখ তার লেখে নাম। (‘দুঃখ)। কাব্য চৈতন্যগত এই স্তরান্তর ঘটে গিয়েছিল স্বল্পসময়ের ব্যাবধানেই। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির মধ্যেও সামাজিক লীলা মুদ্রিত হয়ে যায়। কিন্তু তা বিচূর্ণিত বলে অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। গণমানুষের পারস্পরিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই সামাজিক স্বাভাবিকতা। শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রে তা প্রাকৃত সাবলীলতায় সম্ভব হয়ে উঠেছিল। এর ফলটা হয়েছিল প্রতিবাদে প্রোজ্জ্বল- বারুদ গন্ধময়। সাতচল্লিশ পরবর্তী সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। তার মানে এই নয় যে, ব্যক্তিক রোমান্টিকতা তাঁকে আর আকর্ষণ করতে পারেনি। তা কোনো কবির ক্ষেত্রেই সত্য হয়ে উঠতে পারে না। শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও নয়। তা-ও আমৃত্যু ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে। তারও নানা বাঁক-বিবর্তনের সাক্ষ্য হয়ে আছে শামসুর রাহমানের কবিতা : ‘আজো আছে চিরকস্তুরীটুকু লুকোনো মনে :/সেই সৌরভে উন্মন তুমি, তখন জানি/দেয়ালে তোমার কাঠকয়লার আঁচড় পড়ে॥ (‘আত্মজীবনীর খসড়া’)।

দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তানি নব্য বা ছদ্ম উপনিবেশের প্রথম আক্রমণটা এসেছিল আমাদের ভাষার ওপর। শামসুর রাহমান লিখলেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। যে বর্ণমালা ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে’ কবির সত্তায় মিশে থাকে, তার করুণ পরিণতি তঁকে বিচলিত ও অস্থির করে তোলে, ‘এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস! তোমার মুখের দিকে আর যায় না তাকানো,/বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’ রাষ্ট্রনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ভারসাম্যহীনতা কবির কাছে জীবনের অর্থময়তারই বদল ঘটে গেল : ‘জীবন মানেই/তালে তালে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলা, নিশান ওড়ানো,/জীবন মানেই/অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা...’  (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯)। জাতীয় জীবনের যাবতীয় ব্যর্থতার কলুষকে আড়াল করে দিল ‘আসাদের শার্ট’ : ‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক; আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ ছিলেন শামসুর রাহমান স্বদেশেই। দেশ তখন বন্দি শিবির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সব চেয়ে সফল কবিতাগুলো লেখা হলো তাঁর মাধ্যমেই। কেবল ‘স্বাধীনতা তুমি’  বা ‘তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা’ বা ‘গেরিলা’ নয়, ‘বন্দী শিবিরের’ প্রতিটি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক কৌণিকতায় দৃষ্ট ও বিশ্লেষিত হয়েছে। যুদ্ধের ধাতব ঝঙ্কারের মধ্যে, রক্তবন্যার মধ্যে, মা-বোনের সম্ভ্রম-হারানো আর্তনাদের মধ্যে এমন একটি কাব্য রচিত হওয়ার আর কোনো নজির কোথাও নেই। আমাদের সমাজ-ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গকে তিনি উপমিত করেছেন স্বাধীনতার সঙ্গে, নজরুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছে নিম্নবর্গের গ্রামীণ মানুষ ও প্রকৃতি। প্রকৃতি ও মানুষের সমন্বিত যে নিবিড় চিত্র সেখানে আঁকা, নিমর্মতার বিপরীতে সেই নির্মলতা আমাদের চিত্তকে স্পর্শই কেবল করে না, অদ্ভুত এক আবেশে মোহ্যমানও করে :

স্বাধীনতা তুমি

ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।

স্বাধীনতা তুমি

রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।

স্বাধীনতা তুমি

মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।

(‘স্বাধীনতা তুমি’, “বন্দী শিবির থেকে”) (১৯৭২)

মুক্তিযুদ্ধকালীন আমূল বদলে গিয়েছিল বাংলাদেশের জীবন ও তার পরিপার্শ্ব। চেনা স্বদেশকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কোথাও। পথে-প্রান্তরে রিক্ততা আর হাহাকারে চিহ্ন দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছিল মানুষের মন :

গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গোরু

নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ্ম সরু

আল খাঁ খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক’

নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।

আর কোথায় হারিয়ে গেছে এদেশের স্বজনেরা?

বন্ধুরা অনেকে

দেশান্তরি, বস্তুত প্রত্যহ

হচ্ছে বাস্তুত্যাগী

সন্ত্রাসতাড়িত

হাজার হাজার লোক, এমনকি অসংখ্য কৃষক

আদি ভিটা জমিজমা ছেড়ে

খোঁজে ঠাঁই যেমন তেমন ভিন্ দেশে।

এ অবস্থার অবসান ঘটেছিল। এ দেশের মানুষ কী অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করেছে এ দেশের স্বাধীনতা।  কিন্তু স্বাধীনতা গণমানুষের মনে সামগ্রিক মুক্তির যে মায়া-অঞ্জন মেখে দিয়েছিল, সেই বাস্তবতার অনেকটা আজও অনুপার্জিত ও সুদূরপরাহত। শামসুর রাহমানের কবিতায় এরও অজস্র চিহ্ন অক্ষয় হয়ে আছে।

কবি-মাত্রই ব্যক্তিগত রোমান্টিকতায় আক্রান্ত। এই ধারাটি শামসুর রাহমানের চৈতন্যে আমৃত্যু সংলগ্ন হয়ে ছিল। কিন্তু সমষ্টিচেতনাই শেষ-পর্যন্ত শামসুর রাহমানের কবিতার প্রাণ। তিনি আমাদের ব্যক্তি-জীবনের পাশাপাশি সমষ্টিগত জীবনেও সাগর দোলার ছন্দ সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছেন। এ কাব্যবৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি আমাদের মন ও প্রাণ দখল করে আছেন। থাকবেন।

 

লেখক: ড. খালেদ হোসাইন

অধ্যাপক

বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Side banner