ভাওয়াইয়া গানে নারী মানস
ড. নাসিমা আকতার
ভাওয়াইয়া বাংলা লোকসঙ্গীতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি শাখা । এ গানে উত্তর জনপদের গ্রামীণ নরনারীর জীবনজীবিকা, তাদের আশা আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, সমাজ বাস্তবতার প্রায় সব অনুসঙ্গই ধরা পড়েছে।
ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি স্থল তরাই এলাকা যা জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার অঞ্চল বলে পরিচিত। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যারা এ গানকে লালন, ধারণ করে আসছেন সেই লোকসমাজের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় গানের প্রকৃত অঞ্চলকে ঘিরে। এতে পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার, আসামের গোয়ালপাড়া, এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ভাওয়াইয়া গানের প্রকৃত এলাকা। এ এলাকা বা অঞ্চলের জনজীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, ভাষার সাথে এ গানের ভাব-ভাষা ও সুরের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে।
সাধারণভাবে ওঁরাও, মু-া, দ্রাবিড়, সাঁওতাল অস্ট্রিক ও রাজবংশী, কোচ উত্তর বঙ্গের আদি অধিবাসী। অনেকের মতে রাজবংশীরা ভাওয়াইয়া গানের ধারক ও বাহক। তবে, রাজবংশী শুধু নয় এ অঞ্চলের ব্রাহ্মণ, খেন, যোগী, ধোপা, কোচ, মুসলমান সকলেই মূল রাজবংশী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তাদের ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, জীবন-যাত্রার সুখ-দুঃখ তাদের শিল্পবোধ, অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, নদী প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষা সব কিছুর মধ্যে উৎপত্তি হয়েছে এই ভাওয়াইয়ার। ভাওয়াইয়া গানে নর-নারী যেমন লোকজ জনপদের তেমনি এ গানের বিষয়বস্তু প্রেম ও বিরহ।
ভাওয়াইয়া গান সৃষ্টির সময়কাল সম্পর্কে লোকসাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক প্রফেসর ড. ওয়াকিল আহমদ বলেন, “ভাওয়াইয়া গানের উদ্ভবের সীমানা পনের- ষোল শতক বলে অনুমান করা হয়।” এ গানের নামকরণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন মৈষাল, চাষি, মাহুতের গান দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসতো, তাই এই বাও বা বাতাস থেকে বাওয়াইয়া যা পরবর্তীতে ভাওয়াইয়া হয়েছে। প্রেমের গান ভাওয়াইয়া, ভাও শব্দের অর্থ প্রেম। এ অনুযায়ী এর নামকরণ হয়েছে। স্থানীয়ভাবে ভাওয়াইয়ার অন্য নামকরণও রয়েছে। মৈষাল বন্ধুর গান, গাড়ীয়াল বন্ধুর গা, পাথারিয়া গান, কানাইর গান ইত্যাদি। তবে কামরূপী ভাষায় গাওয়া দীর্ঘ ছন্দের ও বিলম্বিত তালের লোক সঙ্গীতই ভাওয়াইয়া।
লয় অনুযায়ী এ গানকে চিতন ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল ভাওয়াইয়া, দরিয়া ও দীঘলনাসা ইত্যাদি শ্রেণিকরণ করা হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানে নারীমনের আনন্দ- প্রেমবিরহ, বেদনা-আর্তি, চাওয়া-পাওয়া, পরকীয়া, নারী মানসের বিভিন্ন ভাব প্রাধান্য পেয়েছে বেশী, যার গীতিকার, নায়ক ও গায়ক অধিকাংশই পুরুষ।
ওরে গাড়িয়াল বন্ধুরে
বন্ধু ছাড়িয়া রইতে পারি না রে
ওরে গাড়িয়াল বন্ধুরে।।
বন্ধু গাড়ির চাকায় ভরেয়া গান
অদিয়া অদিয়া চলিয়া যান রে
ওকি গাড়িয়াল বন্ধুরে ।। (গীতিকার আব্দুল করীম)
প্রিয়মানুষের গরুগাড়ির চাকার শব্দ নারীমনকে ভালবাসায় আন্দোলিত করে। নারী মনের উপচেপড়া ভালবাসার নিরাভরণ প্রকাশ এ গানে ফুটে উঠেছে। নারী মানসের বিশেষ ভঙ্গীর রূপকার পুরুষ গীতিকার। যিনি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন নারীর মনন আর আবেগ। আব্দুল করীম রচিত এ গানটির সুর ও শিল্পী ছিলেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন। এরকম অসংখ্য গান রচনায় নারীমানসের বহুভঙ্গী প্রকাশে সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন পুরুষ গীতিকারদের।
লেখক : অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, মাহিগঞ্জ কলেজ, রংপুর
আপনার মতামত লিখুন :