সংকল্প : আমি হব দুখু মিঞা
মানিক দে
অনেকে বারংবার ভাবতে পারেন- বাউণ্ডুলে কোনো ছেলের আত্মজীবনী কি মূল্যবান হতে পারে? হয়তো বলবেন- ছেলেটি কে বলুন, না হয় তাঁকে চেনার কিছু সংকেত দিন।দ্বিতীয় পথটা বেছে নিচ্ছি। দু-একটা শব্দ বললেই বুঝতে পারবেন আমি কার কথা বলছি- আশা করি, এর মধ্যেই অনেকেই অনুমান করেছেন। এখন একবারেই নিশ্চিত হয়ে যাবেন, যদি বলি - পরাধীনতার নিষ্ঠুর শেকল থেকে 'মুক্তি' কে না চায়?
সময়ের প্রয়োজনে কেউ বিপ্লবী আর কেউবা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।বিপ্লবী ও বিদ্রোহী এ দুইটি শব্দে দু'ধরণের অনুরণন রয়েছে। প্রথমটিতে রয়েছে কোমলতা, প্রেম ও মমত্বের- অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে তেজস্বী, বিচ্ছিন্নতা ও প্রতিবাদীর - অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক দিক দৃষ্টি গোচর হয়। আমি মনে করি, 'বিপ্লবীরা' স্বাধীনতাকামী বা আমূল পরিবর্তনকামী - তাদের পথ হতে পারে সহিংস বা অহিংস আন্দোলন বা প্রয়োজনে সশস্ত্র আক্রমণ কিন্তু "বিদ্রোহীরা" শাসকের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সরাসরি আক্রমণে বিশ্বাসী। একথা ঠিক যে, শাসক কিন্তু কোন দলকে সহজেই মেনে নেয় না বরং প্রতিহত করে। যাহোক , যাঁর কথা বলছি তিনি ছিলেন দ্বিতীয় দলের তবে তাঁর অস্ত্র দিলো তীক্ষ্ণ কলম যা অধিক শক্তিশালী আর প্রেরণার উৎস ছিল নিজের সংবেদনশীল হৃদয়।
অন্যায়-অবিচার-শোষন দেখে খুব অল্প বয়সেই খুব ব্যথিত হয়েছিলেন । তাই হয়তো তিনি প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম "ব্যথার দান" আর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম "অগ্নি-বীণা" রাখলেন। নামের মাঝে সবার পরিচয় পাওয়া না গেলেও কোন লেখনীতে লেখকের বা কোন কবিতায় কবি'র দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা, মনোভাব বা মনোজগতের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন অনেকটা ভবঘুরে বা বাউণ্ডুলে- হয়তো ভালোবাসতেন বাঁধন হারা জীবন, ছিলেন মুক্তির প্রত্যাশী, ছিলেন বিদ্রোহী - অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আর ছিলেন সাম্যবাদী - মানবতায় বিশ্বাসী কবি। আজ হতে একশ বছর আগে মাত্র বাইশ বছর বয়সে অমর সৃষ্টি "বিদ্রোহী" কবিতা রচনা করেন। সেই চব্বিশ বছর বয়স্ক তেজি তরুণ কবির অনশন ভাঙতে বাষট্টি বছর বয়স্ক জগৎ বিখ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জন্য তোমার বেঁচে থাকা বড়ই প্রয়োজন।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বরে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁকে"বাঙালি জাতির কবি" হিসেবে ঘোষণা দেন। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে মেতে ওঠা কবির কবিত্ব বেঁচে ছিল মাত্র পঁচিশটি বছর। তিনি সুস্থ থাকলে বাংলা সাহিত্য আরও অনেক বেশি ঋদ্ধ হতো একথা সহজেই অনুমান করা যায়। বুঝতেই পারছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এঁর কথাই বলছি।
শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মে ছিলেন একই বছর। প্রথম জনের কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি, প্রশান্তি ও নির্জনতা এবং আর অন্য জনের কবিতায় রয়েছে তেজ, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। এটা বলার কারণ হলো সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি একই হলেও ভেতরের প্রকৃতি তথা বাসনা, চেতনা, চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা বা তাগিদ ভিন্ন হতেই পারে। এসব কোন কঠিন বিষয়ে আলোচনা করছি না ।
ছোট বেলায় অনেকেরই মুখস্থ করা দুটি কবিতা- "সংকল্প" ও "আমি হব" আর "দুখু মিঞা" ("দুখুর ছেলেবেলা") নামে ছোটদের জন্য কবির ছোট্ট একটি জীবনী নিয়ে একটু আলোচনা করব।
"আমি হব" কবিতায় কবি সকাল বেলার পাখি হতে চান। "আমি হব সকাল বেলার পাখি। / সবার আগে কুসুমবাগে / উঠব আমি ডাকি।" প্রশ্ন হলো, পাখি কেন হতে চান? সহজ উত্তর - ঘুমিয়ে থাকা লোককে জাগাতে। আচ্ছা, তিনি কোথায় জেগে উঠবেন - কুসুমবাগে তিনি জেগে উঠবেন। শুধু ফুলের সুভাষে কবি বিমোহিত থাকতে চাননি, তিনি ফুলের রূপ-রঙ-রস-গন্ধ এক কথায় ফুলের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান - তিনি উপলব্ধি করেছেন কেউ না জাগলে সহজেই রাত পোহাবে না। কবি জন্মে ছিলেন পরাধীন ভারত উপমহাদেশে- দেশমাতৃকা নামক কুসুমবাগের মানুষ যখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্ধী ছিল । আনুমানিক আঠারো বছর বয়সে বাউণ্ডুলে কবি কলম নামক অস্ত্র ধারণ করে বৃটিশ শাসকের শান্তির ঘুম বিনষ্ট করে দিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিল এই কবি বিষের বাঁশি বাজিয়ে তাদের সাম্রাজ্যে ভাঙনের গান শুনিয়ে দিবেন। এ তরুণ একজন প্রলয় শিখা। যে কেনো মুহূর্তে তাঁর অগ্নি-বীণা'র শিখায় বৃটিশ শাসিত ভারতকে কাঁপিয়ে দিতে পারে- তাদের ভীত নরম করে দিতে পারে। তাই তারা কবির কন্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু দুঃখ ও দারিদ্র্যে পোড়া কবির মনোবল কি অতো ভাঙতে পারবে বৃটিশ শাসকের রক্ত চক্ষু? তিনি তো পাখির মতো মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে চান - যেখানে খুশি যে ডালেই খুশি বাসা বাঁধবেন। সোনার খাঁচায় বন্দি জীবন তিনি চান না।পৃথিবীকে দেখার জন্য তিনি সংকল্প করেছেন। বিশাল আকাশের নিচে উন্মুক্ত প্রান্তরে মুক্ত বাতাসে উড়ন্ত পাখির মতো ঘুরে ঘুরে তিনি মানুষের জয়গান গাইবেন আর শোনাবেন প্রেম, স্বাধীনতা, মানবতা ও সাম্যের গান।
তিনি ভাঙ্গবেন কারাগারের লৌহ কপাট। পরাধীনতার আঁধারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে তিনি জাগিয়ে তুলবেন। মা জানেন শত্রুরা সন্তানের ক্ষতি করতে পারে আর তাই শত কষ্টের মাঝেও সন্তান নিজের আঁচলের নিচে রেখে দিতে চান। মায়ের স্নেহমাখা শাসন- " হয়নি সকাল, ঘুমো এখন"- কি তিনি মাথা পেতে মেনে নিবেন? মা রাগ করবেন, তবুও তিনি জেগে উঠবেন- বন্ধ ঘরে আর আবদ্ধ থাকতে চান না। এটাই তাঁর চিত্তের দৃঢ়তা - এটাই তাঁর সংকল্প। অভিমানের সুরে তিনি মাকে 'আলসে মেয়ে' ডাকবেন আর 'ঘুমিয়ে' থাকতে বলবেন।
তাঁর অকাট্য যুক্তি - "হয়নি সকাল, তাই বলে কি / সকাল হবে নাকো।" মায়ের ভালোবাসা, মায়া, মমতা কিংবা শাসনকে তিনি অবহেলা বা অবজ্ঞা করেননি বরং তিনি মাকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন- দেশমাতৃকার কল্যাণে বা বৃহত্তর কোন শুভ কাজে তাঁর সন্তানকেই এগিয়ে যেতে হবে, তাঁর সন্তান দায়িত্ব ও কর্তব্যকে এড়িয়ে গেলে তো অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। রাতের অন্ধকারে বাস করতে হবে- ভোর হবে না। "আমরা যদি না জাগি মা / কেমনে সকাল হবে?" কবি একাই সব সমস্যা সমাধান করবেন না, তিনি একসাথে পথ চলতে চান।
কিন্তু কে প্রথমে জেগে উঠবে? কে জাগাবে ঘুমিয়ে থাকা অসচেতন মানুষকে? কে প্রেরণা যোগাবে?
"তোমার ছেলে উঠলে গো মা /রাত পোহাবে তবে।" খোকা মাকে ভুলিয়ে বা ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি অন্যদের জাগাতে যাচ্ছে না, মাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কেন তাঁর সন্তানকে জেগে উঠতে হবে? কারণ পথে যদি বিপদ আছে, শত্রুর হাতে ধরা পড়ে, যদি তাঁর সন্তান নির্যাতিত হয়, বা মৃত্যু বরণ করে মা নিজকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন - তাঁর সন্তান অন্যায় অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছে বা হারিয়ে গেছে। এতে দুঃখ, কষ্ট ও শোকের মাঝেও মা কিছুটা স্বস্তি পাবেন, শক্তি পাবেন ও শান্তি পাবেন। দুঃখ ও দারিদ্রতা কবিকে জ্ঞানী ও মহান করেছে। ঝাঁকড়া চুলের দূরন্ত ছেলেটি দারিদ্রতার স্বরূপ দেখেছিল। তাই দারিদ্রতার মূল কারণ পরাধীনতা ও বৈষম্যকে তিনি উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি জগতটাকে দেখার সংকল্প করেছিলেন। কোন জগতটাকে? যেখানে দারিদ্র্য , বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, দূর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, জুলুম, হানাহানি, মারামারি-এক কথায় কোনো অসুন্দর থাকবে না।
খোকা সত্যিই জেগে উঠেছিল, জাগ্রত করেছিল, প্রেরণা দিয়েছিল আর সাহস যুগিয়েছিল। পরাধীনতার কবল হতে কুসুমবাগ মুক্ত হয়েছে। কিন্তু দুখু মিঞার দুঃখ কি এখনো আছে ? কোন কিছুর আঁধারে আমরা কি ঘুমিয়ে আছি? কিন্তু খোকার সাধ কি মিটিছে?
আপনার মতামত লিখুন :