kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা গানে  নজরুলের অবদান


কালচিত্র | ড. নাসিমা আকতার প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২১, ১২:১৮ এএম বাংলা গানে  নজরুলের অবদান

বাংলা গানে  নজরুলের অবদান

ড. নাসিমা আকতার

প্রতিভা সবার মাঝেই কমবেশী থাকে। সেটি বিকাশের সুযোগ কিংবা চর্চার মধ্য দিয়ে লালন না করলে তা অধরাই থেকে যায়। এই চর্চার ইতিহাস নজরুলের ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমী প্রয়াসের মধ্য দিয়েই বাংলাসাহিত্য ও সঙ্গীত জগতে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন বাঙালি জাতিকে।  
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য প্রতিভা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নজরুলের ক্ষেত্রে এই দরিদ্রতাই প্রতিভা বিকাশের অন্যতম শক্তি, প্রেরণা হয়ে আলো ছড়িয়েছে। চুরুলিয়া গ্রামের লেটোদলের কিশোর দুখুমিয়া থেকে কবি নজরুল, সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল হয়ে ওঠা এবং কোটি কোটি বাঙালির প্রাণে, যুগ যুগ ধরে ভালবাসার আসন দখল করা। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান’। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের মোয়াজ্জেম, সহায় সম্বল বলে তেমন কিছু ছিল না। হঠাৎ পিতৃবিয়োগে নয় বছর বয়সেই জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন তিনি। গ্রামের মক্তবে নি¤œ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর, অল্প বয়সে অর্থ উপার্জনের জন্য মক্তবে শিক্ষকতা, গ্রামের মসজিদে ইমামতি, মাজারে খাদেমগিরি এবং কিশোর বয়সেই লেটো গানের শিক্ষক চাচা কাজী বজলে করিমের লেটো দলে যোগ দেন নজরুল। দলের হয়ে গান লিখতেন, গান গাইতেন এবং অভিনয় করতেন। বলা যায় এই কিশোর বয়স থেকে কবিতা রচনার পাশাপাশি শুরু হয় তাঁর সঙ্গীত চর্চা। অল্প বয়সে গ্রাম্য কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর রচিত ‘শকুনিবধ’, ‘মেঘনাদবধ’ ‘চাষার সং’, ‘রাজপুত্র’, ‘আকবর বাদশা’ ইত্যাদি পালাগানে কবিত্বশক্তির প্রখর পরিচয় বিদ্যমান।
নজরুল অনেকের কাছে গান শিখেছিলেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খান, ওস্তাদ মঞ্জু সাহেব, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ প্রমুখ। নজরুল গায়ক হিসেবে হয়তো তাঁদের সমপর্যায় যেতে পারেননি কিন্তু সঙ্গীতের বিবিধ ধারার সৃষ্টিতে সে শিক্ষাকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। কেননা নজরুল একজন সহজাত কবি ও সঙ্গীত শিল্পীর প্রকৃতিগত  প্রতিভার স্বাক্ষর ১৩/১৪ বছর বয়স থেকেই রাখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর দরাজ কণ্ঠ, হৃদয়স্পর্শী রাগপ্রধান বাণী অতি সহজেই সবাইকে মুগ্ধ করে।
নজরুল ছিলেন অপরিমেয় প্রাণ শক্তির আধার। তাই শত কষ্টের মাঝেও সৃষ্টির নেশায় মেতে ছিলেন। সমাজনীতি. রাজনীতি, প্রেম, প্রকৃতি, দেশ, স্বাধীনতা নানা বিষয়ের আলোকে, নানা ভাবের গান লিখেছেন, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে দেশি বিদেশি সুরের মিশ্রণে নতুন নতুন সুর যেমন সৃষ্টি করেছেন তেমনি সৃষ্টি করেছেন সুর তাল। এর মধ্যে রূপ মঞ্জরী, দোলন চাঁপা, বন কুন্তলা, সন্ধ্যামালতী, মীনাক্ষী, রেনুকা, অরুণ ভৈরব, উদাসী ভৈরব, আশা ভৈরবী, শিবানী ভৈরবী প্রভৃতি রাগ তিনি সৃষ্টি করেছেন।
নজরুল হিন্দি খেয়াল গান অনুবাদ করে বাংলায় ভাঙা খেয়াল রচনা করেন। খাম্বাজ রাগে- ‘কুহু কুহু কুহু কুহু  কোয়েলিয়া’, ছায়ানট রাগে, ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর’, ‘ললিত রাগে- পিয় পিয় বিরহী পাপিয়া বোলে’ এরকম অসংখ্য গান নজরুল রচনা করেন। হিন্দুস্থানী রীতিতে বাংলায় মৌলিক বাংলা খেয়াল রচনাতেও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আর এভাবেই নব নব বিন্যাসে বাংলা সংগীতকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। দিয়েছেন নতুন প্রাণ।
আমরা লক্ষ্য করি কবির গানে এক বিষ্ময়কর রূপবৈচিত্র্য, এজন্য তিনি মাঠে ঘাটে, দেশ বিদেশে সব খানে সুর অন্বেষণ করেছেন। কোনোটাই ছোট করে দেখেননি। দেশি বিদেশি বিভিন্ন রাগ রাগিনীর সংমিশ্রণে অনেক গান রচনা করেছেন। সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন সুর। ইমন, বিলাবল, জয়জয়ন্তী, টোড়ি, বেহাগ, দরবারি, পিলু, ছায়ানট, মালকোষ, খাম্বাজের সঙ্গে আরব্য পারস্য সুর নজরুলের গানে মূর্ত হয়ে উঠেছে বাঙালির নিজস্ব চিরন্তনী রূপ ও সুরমাধুর্যে। বিখ্যাত পারস্য গজল শিল্পী আমির খসরু, গালিবের উর্দু গজল, বাংলায় তার রূপায়ন নজরুল অত্যন্ত সার্থক ভাবে করেছেন। এমনকি তিনি ভারতীয় ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরিকে বাংলা গানের মেজাজের সাথে মেলাতে পেরেছিলেন একজন দক্ষ শিল্পীর কুশলতায়। এছাড়া বাউল, ভাটিয়ালি, মারফতি, মুর্শিদি বিভিন্ন দেশজ সুর রাগ রাগিনীর সাথে আরব, পারস্য, মিশর, ল্যাটিন আমেরিকা, তুরস্কসহ পাশ্চাত্যের নানা ছন্দ ও সুর, রাগরাগিনীর মিশ্রণ ঘটিয়ে অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ জনপ্রিয় বাংলা গান রচনা করে, বাংলাগানে ভিন্নতা নিয়ে আসেন। তিনি মিশরীয় নাচের সুর অবলম্বন করে লিখেছেন, ‘মোমের পুতুল, মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়’। কিউবান নাচের সুরে লিখেছেন, ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ গানটি। তুরষ্কের লোক সংগীতের ধারায় লিখেছেন, ‘শুকনো পাতার নূপুরপায়ে’, আরবদেশের  লোকগীতির সুরে, ‘চমকে চমকে ভীরু ভীরু পায়ে পল্লীর বালিকা, বনো পথে যায়’ প্রভৃতি। নজরুল এভাবেই নতুন নতুন ভাব বিষয়, শব্দ ও বিচিত্র সুরের সংযোজন বাংলা গানকে আন্তর্জাতিক মানে উচ্চকিত করেছেন। যা শ্রোতামনকে ক্লান্তি বা একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি দেয়। এমনকি তার গান যারা গেয়ে থাকেন তাদের গায়কী স্বাধীনতাকেও কিছুটা প্রাধান্য দিয়েছেন। এজন্য নজরুল বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার।
বলা যায় বাংলা গানের বিচিত্র শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। নজরুল যখন গান লিখতেন, সুর দিতেন তখন এর পূর্ব থেকেই এদেশে রজনী কান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুরেন্দ্র নাথ মজুমদার, অতুল প্রসাদ, রাম প্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ গীতিকার ও সুরকার বাংলাগানে জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারপরও রবীন্দ্রনাথ একসময় ‘সংগীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে  আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমাদের সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, চিত্রকলা সবই আজ অচলায়তনের বাঁধন হতে ছাড়া পেয়েছে। এখন আমাদের সঙ্গীতও যদি এই বিশ্ব যাত্রার তালে তাল রেখে না চলে, তবে ওর আর উদ্ধার নেই।” সুর বৈচিত্র্যে নজরুল কিছুটা হলেও সে মুক্তি দিতে পেরেছিলেন বলে আমারা বিশ্বাস করি। নজরুলের সুর সাধনার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই কয়েকটি বাক্যে। বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ১৯২৯ সালে নজরুলকে যে অভিনন্দন পত্র দেয়া হয়েছিল সেখানে একটি স্থানে বলা হয়েছে, “তুমি বাংলার মধুবনের শ্যামা কোয়েলের কণ্ঠে ইরানের গুল বাগিচার বুলবুলের বোল দিয়েছো।” সত্যি নজরুলের গান নদীর কলতানের মতই স্বতঃস্ফূর্ত, উচ্ছ্বল ধারায় বয়ে চলে। তাঁর গানের বাণীর অকৃত্রিম প্রকাশ, ভাবের গাঢ়তা অনুযায়ী সুুর ও ছন্দের নিপুণ কারুকাজ যে কোনো সজ্ঞীতানুরাগীর হৃদয়তন্ত্রীতে দোলা দেয়, শ্রোতামন আবিষ্ট করে। 
নজরুল সমৃদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত হননি। জন্ম নিয়েছিলেন মুসলিম রক্ষণশীল দরিদ্র পরিবারে। আর্থিক সংকট ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে স্বভাবজাত প্রতিভাগুণে, সৃষ্টির নেশায়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গান রচনা করেছিলেন। উচ্চাঙ্গ থেকে সাঁওতালী কোনোটাই বাদ যায়নি।  ভাব ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুলের গান তাই বিশেষ শ্রেণির শ্রোতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকেনি বরং ভাব ও পরিবেশ অনুযায়ী সুরের মেলবন্ধনে নজরুলের গান সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। নজরুলের বিভিন্ন ধারার গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বদেশ চেতনা মূলক গান: ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘এই শিকল পরা ছল’, ‘আমার শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা, আয় রে আয়’, ‘আমার দেশের মাটি ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি (ভাওয়াইয়া সুরে )’। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় নজরুলের স্বদেশ চেতনা মূলক গানগুলো ঐসময় ব্রিটিশ বিরোধী ও স্বাধীনতাকামী চেতনা জাগরণে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল।
কবির মানব প্রেমমূলক গানগুলো মানব মনের শাশ্বত আবেদনকেই প্রতিনিধিত্ব করে। ‘কুঁচ বরণ কন্যারে তোর, মেঘবরণ কেশ (কার্ফা সুরে)’ ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর  নমো নমো (ভৈরবী গজল )’ ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি (ইমন ভূপালী মিশ্রণে)।’
নজরুলের বহুল প্রশংসিত কীর্তি, গজল গানের মধ্য দিয়েই তাঁর প্রেমসংগীতের বিকাশ এবং আরব্য পারস্য গজলের সুরকে বাংলা গানের রূপের ভিতর দিয়েই তাকে বাংলার মানুষের অন্তরের সম্পদ করে তোলেন।
তিনি পারস্য গজলের সুরে রচনা করেন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’, ‘কেন আন ফুল ডোর আজি এ বিদায় বেলা’ ইত্যাদি। নজরুলের গানের এই নতুন ধারা তৈরি হয় তাঁর সৈনিক জীবনে। পল্টনে থাকাকালীন সময়ে পরিচয় হয় একজন পাঞ্জাবি মৌলভি সাহেবের সাথে, তার কাছে ফার্সি কবিতা ও পারস্য কবি হাফিজের গজল শুনে এর প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। নজরুল স্কুল জীবনের ফার্সি শিক্ষক হাফিজ নূরুন্নবীর কাছে কিছুটা ফার্সি শিখেছিলেন। মৌলভি সাহেবের সাহচর্যে, ফার্সি কবিদের বিখ্যাত কাব্য পাঠের আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি ফার্সি ভাষায় দক্ষতা লাভের জন্য পাঞ্জাবি মৌলভি সাহেবের সাহায্য নেন। এভাবেই তিনি বাংলা ভাষায় গজল রচনায় উৎসাহী হন এবং বাংলা গানের জগতে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেন।
নজরুলের গজলের  ভূয়সী প্রশংসা করেন বুদ্ধদেব বসু, দিলীপ কুমার প্রমুখ। সবাই যে নজরুলের গান কবিতার প্রশংসা করতেন তা নয়। অনেকে সমালোচনাও করেছেন এদের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রমুখের কথা বলা যায়। নজরুলের প্রকৃতি মূলক গানে ফুটে ওঠেছে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য। ‘আজি দোল ফাগুনের, দোল লেগেছে আমের বৌলে দোলন চাঁপা’, ‘শুকনো পাতার নুপুর পায়ে, নাচিছে ঘূর্ণি বায়’, ‘মনের রং লেগেছে, বনের পলাশ জবা অশোকে’ ইত্যাদি গানের চিত্রকল্পে ও সুরের ঝংকারে প্রকৃতির একটি বিশেষ অবয়ব, চিত্ত চঞ্চলরূপ শ্রোতাকে চঞ্চল করে তোলে।
নজরুলের ভক্তিমূলক গান সম্পর্কে লোক সঙ্গীতের সম্রাট আব্বাস উদ্দীন ‘গীতিকার নজরুল’ প্রবন্ধে দাবী করেছেন, নজরুল তাঁর অনুরোধে বাংলা কাওয়ালি ও ইসলামি গান রচনা ও সুর করেন। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’, ‘ইসলামের ঐ সওদা নিয়ে এলো নবীন সওদাগর’ ইত্যাদি। ইসলামি ঐতিহ্যের পরিচয় এবং ভক্তিরসের অতুলনীয় প্রকাশ এখানে যেমন রয়েছে, তেমনি কীর্তনেও রয়েছে সে ভাবের প্রকাশ। সাহিত্য রচনায় নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ, বাংলাগানেও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
নজরুলের গান সুরবৈচিত্র্যে অতুলনীয়।  গানের বাণী ও ভাবের সাথে সুরের অপূর্ব মিলন তাঁর গানকে ঈর্শ্বণীয় সাফল্য এনে দেয়। বাংলা গানে নতুন নতুন ভাব বিষয় শব্দ, উপমা, রূপক চিত্রকল্পের অনবদ্য প্রয়োগ ও সুরের সংযোজন, তা কেবল একজন একনিষ্ঠ গুণী শিল্পীর পক্ষে সম্ভব। এছাড়া নজরুল গানের সুরের মৌতাতে মিশে আছে কবি মনের মমতা জড়ানো, অপূর্ব প্রেমের ফল্গুধারা। তাঁর গীতির রসময়তার সাথে মানব হৃদয়ের চিরন্তন জিজ্ঞাসা, চাওয়া পাওয়া শ্রোতা হৃদয়কে, অভিভভূত করে সহজেই। তাই বাংলা গানের ধারায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে নজরুলের বিপুল সংখ্যক গান। যে গানগুলো একসময় আধুনিক গান বলে প্রচার করা হতো। প্রয়াত নজরুল গানের বিখ্যাত শিল্পী ফিরোজা বেগমের নেতৃত্বে সেসব গান এখন নজরুলগীতি নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘আমার নয়নে নয়ন রাখি কি বলিতে চাও পরান প্রিয়া’, ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’, ‘আমি চাঁদ নহি অভিশাপ’, ইত্যাদি। এই গানের প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম। প্রাণবন্ত সুর ও অপূর্ব ব্যঞ্জনায় মূর্ত  নজরুলের প্রেমের গান যেন উচ্ছ্বাসে, অনুরাগে, বেদনায় বিরহে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও আবেগের প্রতিচ্ছবি।
রাগ প্রধান বাংলা গান রচনাতেও নজরুল অসামান্য অবদান রেখেছেন। মীনাক্ষী রাগিণীতে রচিত তাঁর রাগ প্রধান গান, ‘চপল আঁখির ভাষায় হে মীনাক্ষী কয়ে যাও’। রাগিণী দোলন চম্পা রাগে, ‘দোলন চাঁপা বনে দোলে দোল পূর্ণিমা রাতে চাঁদের সাথে’। নির্ঝরিণী রাগে, ‘রুমঝুম রুমঝুম কে বাজায় জল ঝুমঝুমি’ ইত্যাদি নজরুলের অসম্ভব জনপ্রিয়  রাগসংগীত। এছাড়া উচ্চাঙ্গ সংগীতের খেয়াল ও ঠুমরি গানের সুরের বিস্তারকে ঠিক রেখে নিজের রচিত বাণীতে সুরারোপ করে অসংখ্য গান, গজল ও কাওয়ালি রচনা করেন। এর সাথে বাংলা গানের ধারায় লোকগান রচনাতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি বাংলা লোকগানের  বিভিন্ন শাখা অবলম্বনে গান রচনা করে এই ধারাকে বৈচিত্র্যময় করে তোলেন। এর মধ্যে ভাটিয়ালীর আঙ্গিকে রচিত ‘পদ্মার ঢেউ রে’, ‘কোন কূলে আজ ভিরল তরী’ গানটির অসামান্য জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা য়ায়। 
আমরা দেখি লোকগানে নজরুলই প্রথম আদিবাসী গানের স্তর থেকে ঝুমুর ঢঙ ব্যবহার করে, বাংলা গানে ব্যতিক্রমী ধারা সৃষ্টি করেন। কয়লা খনির জীবন, নর নারীর ভালোবাসা, রাধাকৃষ্ণ প্রেমকথা, প্রাকৃতিক শোভা প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ে রচিত নজরুলের অসংখ্য গানে ঝুমুরের এই দোলা লাগানো সুর, আমাদের উদ্বেলিত করে। এই ধারার উল্লেখযোগ্য একটি গান ‘চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনিঝিনি বাজে লো।’ নজরুলের ভাওয়াইয়া গান সম্পর্কে  ভাওয়াইয়া সম্্রাট আব্বাস উদ্দীন বলেছেন, ‘নদীর নাম সই কচুয়া/ মাছ মারে মা মাছুয়া/ মই নারী দিচঙ ছ্যাকাপাড়া।’ এই ভাওয়াইয়া গানটি তাঁর কণ্ঠে শুনে নজরুল লেখেন, ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা/নাচে তীরে খঞ্জনা/পাখী তো নয়/নাচে কালো আঁখি।’ নজরুল অসংখ্য পল্লী গান, ভাওয়াইয়া রচনা করেছেন।
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিপ্রকাশ, বাংলাগানেও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এছাড়া নজরুলের শ্যামা সংগীত রচনা সম্পর্কে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে রাম প্রসাদের পরেই নজরুলের অবদান। ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, আলোর নাচন দেখে যা’,‘আমি বেল পাতা দেব না মাগো, দেব শুধু আঁখি জল’ ইত্যাদি। নজরুল কিছু বৈষ্ণবগীতিও রচনা করেছিলেন।
কবির হাস্যরসাত্বকমূলক গান রচনা সম্পর্কে জানা যায়, কবিপুত্র বুলবুলের মৃত্যুতে কবি ভীষণ আহত হন। তাঁর প্রিয় কণিষ্ঠ পুত্রের শোক ভুলতেই তিনি হাসির গান রচনায় হাত দেন এবং কিছু প্যারোডি গান রচনা করেন। ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’, ‘উল্টে গেল বিধির বিধি, আচার বিচার ধর্ম জাতি’ ইত্যাদি। 
জানা যায় নজরুল কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদের সঙ্গে কলকাতার ৮ নং টার্নার রোডে থাকাকালীন শ্রীযুক্তা মোহিনী সেনগুপ্তার কাছ থেকে একটি চিঠি পান। চিঠিতে তিনি নজরুলকে অনুরোধ করেন, সঙ্গীত রচনার আঙ্গিকগত দিক তথা সঙ্গীতের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ চারটি স্তর মেনে গান রচনার জন্য। এরপর থেকে তিনি মোহিনী সেনগুপ্তার উপদেশ মেনে গান রচনা করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিন হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন অসংখ্য গানের। তাঁর মত এত অধিক সংখ্যক গান ভারত উপমহাদেশে তো নয়ই, বিশ্বের কোনো গীতিকার রচনা করেছেন কিনা জানা নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গ্রামোফোন, বেতার  কেন্দ্রের ফরমায়েশে অসংখ্য গান তিনি রচনা করেছেন। বলা যায়, অর্থোপার্জনের জন্য গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার চেয়ে গানই তিনি বেশী রচনা করেছেন। অনেক কবিতা তাঁর দ্বৈত ভূমিকাও পালন করে আসছে। তাঁর রচিত গানের বই যথাক্রমে বুলবুল ১ম খ-, ২য় খ-, চোখের চাতক, নজরুলগীতিকা, চন্দ্রবিন্দু, সুরসাকী, নজরুল স্বরলিপি, জুলফিকার, বনগীতি, গুলবাগিচা, গীতি শতদল, গানের মালা ইত্যাদি। 
উনিশ শতকের প্রথম দিকে নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে, সাহিত্য ও সংগীত রচনায় গভীরভাবে  নিয়োজিত হন। একপর্যায় জীবন জীবিকার তাগিদে সংগীত রচয়িতা হিসেবে গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেন। যতটুকু জানা যায়, গ্রামোফোন কোম্পানি নজরুলকে প্রথমে গ্রহণ করেননি, তাঁর বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে। জনগণের চাহিদা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে পরে তাঁকে গ্রহণ করা হয়। এখান থেকে রেকর্ডকৃত জনপ্রিয় বাংলা গান রচনায় তিনি সর্বাধিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখান থেকেই তিনি চলচিত্রে যুক্ত হন। কাহিনীকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক নানাবিধ সৃজনকর্মে অভিসিক্ত হন।
নজরুলের গান জনপ্রিয় করে তুলতে যাঁরা অগ্রণি ভূমিকা রাখেন তাঁদের মধ্যে কে. মল্লিক, দিলীপ কুমার রায়, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, আশ্চর্যময়ী দাশী, কমলা ঝরিয়া, শচিন দেব বর্মণ, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, শৈল দেবী, মৃণাল কান্তি ঘোষ এবং নজরুল নিজে। অপরদিকে নজরুলের গান করেও ভারত ও বাংলাদেশের অসংখ্য শিল্পী যেমন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সোহরাব হোসেন, ফিরোজা বেগম প্রমুখ জনপ্রিয় হয়েছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন। বর্তমানে খালিদ হোসেন, নীলুফার ইয়াসমিন, ফাতেমা তুজ জোহরা, জোসেফ কমল, সুজিত মোস্তফা, শারমিন সাথী  ইসলাম সহ অনেকই নজরুল গানের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
নজরুল শুধু সুরশিল্পী ও সুরকারই ছিলেন না একজন সফল সুরপরিচালকও ছিলেন। ধ্রুব, গোরা, পাতালপুরি, বিদ্যাপতি ইত্যাদি চলচ্চিত্রের গানসহ রক্তকমল, মহুয়া, কারাগার বিভিন্ন নাটকে তিনি গান  পরিচালনা করেছেন। কলিকাতা বেতারে ‘হারামণি’, ‘নবরাগ মালিকা’ ও ‘গীতিবিচিত্রা’ প্রভৃতি গানের অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন তিনি। হারিয়ে যাওয়া রাগ রাগিনীর পুনঃউদ্ধার ও সংরক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ‘হারামণি’ অনুষ্ঠানের। অন্যদিকে নিজের তৈরি রাগ রাগিনীর সাথে শ্রোতাদের পরিচয় ঘটাতেন ‘নবরাগ মালিকা’ অনুষ্ঠানে।
সৃজনশীলতার ইতিহাসে নজরুল সত্যিই বিষ্ময়কর এক প্রতিভা। কোরাসগান তাঁর অনন্য সৃষ্টি। তিনি প্রচলিত ধারাকে ভেঙে দেশাত্মবোধক গানের আদলে কোরাস গানে ছ্ত্রাদলের গান, রণসংগীত, মার্চসংগীত, জেলে কৃষকের, মুঠে মুজুরের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, জাতীয় জাগরণের গান সার্থকভাবে সমবেত কণ্ঠে ব্যবহার করেছেন। 
নজরুল সাম্প্রদায়িকতার বেঁড়াজাল ভেঙে বিচিত্রধারার গানের মাঝে ঐক্যের সুর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমৃদ্ধ বাণী ও সুর ঐশ্বর্যে তাঁর গান এখনো স্বাদেশিক চেতনায়, বিদ্রোহ বিপ্লবে এদেশের মানুষকে উদ্বেলিত করে, বিরহ মিলনে, আনন্দ ভালবাসায়, মন ও মননে একান্ত প্রশান্তি দেয়। 
নজরুল একাধারে কাহিনীকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক, নানাবিধ পরিচয়ের মাঝে নিরীক্ষামূলক রাগসঙ্গীত ও জনপ্রিয় গান রচনায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে, ব্যতিক্রমী সঙ্গীত সৌন্দর্য, রয়েছে গভীর জীবনবোধ, জীবন ঘণিষ্ঠতা এবং মানব অনুভূতিগুলোকে সহানুভূতির সাথে তুলে ধরবার অপিরমেয় শক্তি। জনচিত্তের মর্মবাণী তাঁর গানে ঝংকৃত হয় বলেই তিনি বিপুলভাবে শ্রোতা হৃদয়ে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। জননন্দিত হয়েছেন। তাঁর সংগীতের মূল্যায়ন সম্পর্কে আলোচক ও গবেষকগণ উচ্চ প্রশংসা করেছেন। বাংলা গানে নজরুলের বহুমূখী প্রতিভা সম্পর্কে জনাব আসাদুল হক কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৪২, এ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০১), নজরুল সমকালের প্রখ্যাত দু’জন ব্যক্তিত্বের স্মৃতিচারণে জানা যায়, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন যে নজরুলের গানে, তাঁর নিজস্ব একটি ধরন আছে। রবীন্দ্রনাথের মতটির প্রতি জোর দিয়ে এস ওয়াজেদ আলী, বি এ (ক্যান্টাব), বার-এট-ল বলেন, নজরুলের এই ধরনটাই যে বাংলা গানে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে, গৌরবের সাথে স্থান দখল আছে এর জন্য আধুনিক সংগীত কলা নজরুলের কাছে ঋণী। নজরুলের বিশাল সৃষ্টিকর্ম আমাদের সাহিত্য, সাংস্কৃতিক সম্পদ, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করণে যে বলিষ্ঠ অবদান রেখে চলেছে সে ঋণ সত্যিই অপরিশোধ্য। 
আকাশ সংস্কৃতির ডামাঢোলে বাঙালির গর্বের, বাঙালির অহংকারের এই স্মারক যেন কখনো হারিয়ে না যায়। তাই আসুন শুদ্ধ নজরুল চর্চায় তাঁকে নতুন নতুন রুপে আবিস্কারের মধ্য দিয়ে তাঁকে চির অম্লান করে রাখি।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক 

বাংলা বিভাগ

মাহিগঞ্জ কলেজ

রংপুর 

Side banner