নজরুল-কাব্যে পুরাণ-ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা
ড. শ্যামল কান্তি দত্ত
তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হবার পরও নজরুলের জনপ্রিয়তা দুই বাংলায় অটুট দেখে অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৪৯ সালে লিখেন : ‘ভুল হয়ে গেছে/ বিলকুল/ আর সব কিছু/ ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো/ নজরুল।’ কিন্তু, সে ঐতিহ্যটুকুও আমরা অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যর্থ হলে, তিনি ১৯৭৬ সালে আক্ষেপ করে লিখেন: ‘কেউ ভাবল না ইতিহাসে ফের/ ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ এতকাল পরে ধর্মের নামে/ ভাগ হয়ে গেল নজরুল।’ ধর্মের নামে শুধু আমাদের জাতীয়কবি নয়, পুরো দেশ-জাতি এমনকি গোটা বিশ্বই আজ দ্বিধা-বিভক্ত; যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত হতে উদগ্রীব, এ যুদ্ধমনস্কতাই জঙ্গিবাদ। এমন প্রেক্ষাপটে নজরুলের পুরাণ-ঐতিহ্যের প্রয়োগ পুনর্পাঠের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। নজরুল ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা নাস্তিকতা দিয়ে নয়, বরং সকল ধর্মের মানবিকতা ও ধর্মের লোকশ্রæতি-ঐতিহ্য-কিংবদন্তির সমন্বয় ঘটিয়ে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন তাঁর কবিতায়। ‘অভেধ ধর্ম-জাতি’-র রূপায়ন করতে গিয়ে বাংলা কবিতাকে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রথম মুক্ত করেন রবীন্দ্র-কবিতাবিশ্ব থেকে। বাংলা কবিতার শান্তশীল আবহে যুক্ত করেন দ্রোহের মত্ততা; প্রচলিত শব্দ-শাসন ভেঙে, শব্দে-ছন্দে-স্বরভঙ্গিতে আনেন নবীনতা, সৃষ্টি হয় নতুন বাংলা কবিতা, কবিতার নতুন নিয়ম। বৃটিশ উপনিবেশে নজরুল ইসলামের জন্ম, কিন্তু কলোনীর বুদ্ধিবাদী আরোপন তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। অবক্ষয় বিচ্ছিন্নতা বা ডেকাডেন্ট শিল্পীমানস নজরুলের ছিল না-বরং তিনি অবিচ্ছিন্ন বাংলার একেবারে মর্মমূলে প্রবেশ করেছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন দ্রোহের মত্ততা ও প্রেমের আবেগ, বাঙালি চরিত্রের এই দুই প্রান্তেকে এবং মূর্ত করেছেন কবিতায়। বিদ্রোহকে স্বাগত করেছেন তিনি, তাকেই আবার প্রেমের এক প্রমূর্ত প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। চরিত্রের এই দুই প্রান্তে তিনি দৃষ্টি ফেলেছেন রোমান্টিকের এবং প্রাণিত দৃষ্টি বৈভবে দুটো প্রান্তই উপভোগ্যভাবে রূপান্তরিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।
নজরুলের সাধনা ছিলো সাম্য ও স্বাধীনতা; তারই কলারূপ তাঁর কবিতা। আকাঙ্ক্ষিত সাম্য ও স্বাধীনতাকে তিনি কেনো ইডিয়োলজি বা কল্পলোকের আদর্শিক ফ্রেমে পেতে চাননি, চেয়েছিলেন আপন অন্তর্গত অনুভবে এবং বাস্তবে। এই অন্তর্গত আবেগ-অনুভবের স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণে তাঁর কবিতায় এসেছে দ্রোহের মত্ততা-শাসিত শিল্পের অবাধ্যতা, পুরাণ-প্রয়োগের প্রাচুর্যতা ও পুনর্জাত ঐতিহ্যের প্রবর্তনা। নজরুলের কাব্যে একদিকে যেমন হিন্দু-পুরাণের সার্থক ব্যবহার আছে, অন্যদিকে তেমনি আছে ইসলামি ঐতিহ্যের অভ্রান্ত অনুসরণ। নজরুল তাঁর কাব্যের উপাদান আহরণ করেছেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকে এবং আহরিত উপাদান-পুরাণের বিষ্ময়কর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত বাঙালির সমবায়ী ঐতিহ্যকেই কবিতায় প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান যথার্থই মনে করেন: ‘নজরুলের ব্যক্তিহৃদয় ও সমষ্টিভাবনা, তাঁর আত্মসন্ধান, জাতিসত্তা-অনুসন্ধান এবং ঐতিহ্যনির্বাচন ও বিশ্বাত্মা-সন্ধানের পথপরিক্রমায় যে নিগূঢ়-জটিল-দ্ব›দ্বময় বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, তার মূলে বিদ্যমান কবির আত্মবীক্ষা ও বিশ্ববীক্ষার স্বাতন্ত্র্য। দেশের মৃত্তিকামূল তথা জনচিত্তের গভীর থেকেই কাব্যোপকরণ সংগ্রহ করেছেন কবি। ... মোহগ্রস্ত আবেগ থেকে তিনি প্রত্যক্ষ করেননি মিথ-ঐতিহ্যকে, বর্তমানের অনিবার্য প্রয়োজনে তাকে পুনরুজ্জীবন দান করেছেন।’ বলে নেওয়া ভালো: পুরাণ বা মিথ (সুঃয) বলতে সামাজিক বা প্রাকৃতিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ব্যাখ্যামূলক কল্পকাহিনি বা অলীক কাহিনি বোঝায়। আর ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশন বলতে বোঝায় পরম্পরাগত কথা, পুরুষানুক্রমিক ধারা, কিংবদন্তি, বিশ্রæতি বা লোকপ্রসিদ্ধি। যুগের যথার্থ চারণকবি নজরুল এদুয়ের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁর কাব্যে। নজরুল-কাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর দ্রোহী সত্তায় নিহিত এবং তাঁর সাফল্যের স্তম্ভ মূলত তিনটি: এক. ঔপনিবেশিক বাংলায় রাজনৈতিক বিদ্রোহ, দুই. রাবীন্দ্রিক প্লাবণের যুগে ভাষা-বিপ্লব, তিন. পুরাণ-ঐতিহ্য ব্যবহারে অতুলনীয় সামর্থ্য। নজরুলের পুরাণ-ঐতিহ্যের বর্ণবহুল-বিচিত্র ব্যবহারকে সমালোচকগণ পাঁচটি ধারায় বিন্যস্ত করেন: এক. ভারতীয় পুরাণ-ঐতিহ্য, দুই. বাংলার দেশজ লোকপুরাণ, তিন. ইউরোপীয় মিথ, চার. ইসলামি ঐতিহ্যের নবমাত্রিক প্রয়োগ এবং পাঁচ. ইসলাম-পূর্ব পারস্য-আরবীয় মিথিক-উৎসের ব্যবহার। নজরুলের কাব্যের প্রায় সর্বত্রই পুরাণের প্রয়োগ সুপ্রচুর। তবে পুরাণের ব্যবহারে সর্বাধিক সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা (১৯২২) ও সাম্যবাদী (১৯২৫)। এই গ্রন্থদ্বয়ে পুরাণ-প্রয়োগের রীতিও দ্বিবিধ; সাম্যবাদীর কবিতাগুচ্ছ পুরাণের ব্যবহার সাধারণ ও অবিকল অর্থাৎ কাহিনি কেন্দ্রিক; অগ্নিবীণার কবিতাগুচ্ছের পুরাণ কবির নিজস্ব অর্থে ও অন্তরাখ্যানে দ্যুতিমান।
বাংলাকাব্যে নজরুলের আত্মপ্রকাশ অগ্নিবীণা কাব্যে প্রকাশের মধ্যদিয়ে। দ্রোহীসত্তার স্বত্বঃস্ফূর্ত প্রকাশ, ভাষা-বিপ্লব ও পুরাণ-ঐতিহ্য প্রয়োগ সবদিকে থেকেই অগ্নিবীণার শ্রেষ্ঠত্ব আজ একটি মীমাংসিত সত্য। নজরুলের কবিখ্যাতির মূলেও রয়েছে প্রধানত অগ্নিবীণার কবিতামালা। অগ্নিবীণার অতিখ্যাত কবিতাটির নাম ‘বিদ্রোহী’। একশো একচল্লিশ পঙক্তির এই কবিতাটি পুরাণ প্রয়োগের একটি জাদুঘর যেনো। হিন্দু-মুসলিম পুরাণ বা মিথ এখানে একত্রীকৃত। এখানে পৌরাণিক এক-একটা চরিত্রের মধ্যদিয়ে কবি তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধির দিকে যাত্রা করেছেন। এখানে পৌরাণিক কোনো চরিত্রেই অবিকল ভাবে ব্যবহৃত হয়নি : রূপকার্থে বা প্রতীকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্যের অসামান্য অন্বয়ের একটি দৃষ্টান্ত- ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর। মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ¦লে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)
অগ্নিবীণার আরেকটি অসামান্য কবিতা ‘ধুমকেতু’। ধুমকেতু বিদ্রোহীর অপর আয়তন, বিদ্রোহী কবিতার পুরাণ-প্রয়োগ এখানে অত্যুদীপ্তভাবে অনুসৃত। একটি দৃষ্টান্ত: ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধুমকেতু! সাত-সাতশ নরক-জ্বালা জ্বলে মম ললাটে মম ধূম-কুন্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘনঘোলাটে। আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ, আমি স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ হাহাকার-’ (ধুমকেত, অগ্নিবীণা)
অগ্নিবীণার একাংশে ‘প্রলয়োল্লাশ’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’, ‘আগমনী’ ও ‘ধূমকেতু’ কবিতায় আছে প্রধানত হিন্দু পুরাণের ব্যবহার। অপর অংশে ‘কামালপাশা’, ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আবর’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহরম’ কবিতায় মুসলিম পুরাণের ব্যবহার। হিন্দু ও মুসলিম পুরাণ-ঐতিহ্য ব্যবহার করে কবি ধ্বংস, জয়, বীরত্ব সাহস ও নির্মাণের গাঁথা রচনা করেছেন এবং পৌঁছতে চেয়েছেন তাঁর অনন্য গন্তব্যে। বর্তমানের বিপর্যস্ততার উপরে ভবিষ্যতের প্রদীপ্ত জাগরণে। ক. ‘শ্বেত শতদল বাসিনী নয় আজ রক্তাম্বর ধারিণীমা ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর সৃষ্টির নব পুর্ণিমা।’ (রক্তাম্বর ধারিণী মা, অগ্নিবীণা) খ.‘ফিরে এলো আজ সেই মোহরম মাহিনা ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না। উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবীর, দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,- তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা, শমসের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা।’ (মোহরম, অগ্নিবীণা) উদ্ধৃতিদ্বয়ে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম পুরাণ-ইতিহাস ব্যবহার করে কবি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, -যেখানে কেবল জয়ধ্বনি উচ্চকিত। অগ্নিবীণার পর পুরাণ প্রয়োগে সর্বাধিক সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ সাম্যবাদী। তবে সাম্যবাদীতে পুরাণ প্রয়োগ রীতি স্বতন্ত্র; অগ্নিবীণাতে পুরাণ ব্যবহৃত হয়েছে প্রতীকার্থে সাম্যবাদীতে ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণ অর্থে, সাম্যবাদীর পুরাণ নির্দিষ্ট সরাসরি ও কাহিনিকেন্দ্রিক। ক. ‘এই রণভূমে বাঁশির কিশোর গাইলেন মহাগীতা এই মাঠে হল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।’ (সাম্যবাদী, সাম্যবাদী) খ. ‘আদম দাউদ ঈসা মুসা, ইব্রাহিম মোহাম্মদ কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর বিশে^র সম্পদ।’ (মানুষ, সাম্যবাদী)
এইভাবে হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্য পাশাপাশি ব্যবহার করে নজরুল তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছেন। নজরুল ছিলেন জীবনের সর্বাত্মক অস্তিত্বে বিশ্বাসী--সাম্যের প্রতীক; হিন্দু-মুসলমানের মিলন সাধনে তৎপর। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকে কাব্যের উপাদান আহরণ করে, কাব্যে হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্য পাশাপাশি প্রয়োগ করে তাঁর সেই সাম্য সাধনাকেই মূর্ত করে তুলেছেন নজরুল। আধুনিক বাংলা কবিতায় পুরাণ-প্রয়োগের সূত্রপাত মধুসূদনের হাতে হলেও নজরুল-ই প্রথম সমকালের সাথে সাজুজ্যের সেতু গড়ে সরলরৈখিকভাবে পুরাণ ও প্রাচীন ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবন দেন তাঁর কবিতায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য-এ (১৮৬১) পুরাণ-প্রয়োগ করেছেন চিত্রকল্প রূপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে পুরাণ স্ফটিকায়িত ও রূপকধর্মী (খান ২০১৯)। অথচ নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ (১৯২২) থেকেই পুরাণ উপমা হিসেবে প্রয়োগ হয় : বর্তমানের আমি-র সাথে একাকার হয়ে। যেমন : ‘আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড। আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র শিষ্য আমি দাবানল-দাহ দাহন করিব বিশ্ব।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)।
নজরুলের কবিতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে পৌরণিক চরিত্র শিব। স্মরণ্য যে ১৯২২ খ্রি: ধুমকেতুর ১৩শ সংখ্যায় নজরুল স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন: ‘ধুমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’। এই স্বাধীনতার জন্য অমিত শক্তি ও সাহসের উৎসরূপে কবির কল্পনায় বার বার হানা দিয়েছে শিব-চরিত্র। শিব-চরিত্র এক অর্থে ভারতীয় লৌকিক চরিত্রও বটে। হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে তিনি প্রাচীন বাংলা লোকপুরাণকে ধারণ করতে গিয়ে লিখেন: ‘আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী’। আবার, ইউরোপীয় মিথচেতনার অব্যর্থ প্রয়োগ পাই যখন লিখেন: ‘আমি আর্ফিয়াসের বাঁশরী’। এভাবে লায়লি-মজনু-রুস্তম চরিত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইসলাম-পূর্ব আরব-পারস্য ঐতিহ্যও তাঁর অসংখ্য কবিতায় অবলোকন করা যায়।
নজরুল ভালোভাবেই জানতেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আবাস ভারতবর্ষ থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে আবশ্যক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নিñিদ্র সাম্য স্থাপন। নজরুল ইসলাম হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্য বা ট্রেডিশন ও পুরাণ বা মিথ থেকে কাব্যের উপাদান আহরণ করে, আহরিত উপাদান-পুরাণের মিলিত ব্যবহারের মধ্যদিয়ে তাঁর আরাধ্য সাম্য-সাধনাকে প্রকীর্তিত করেছেন এবং আবহমান বাঙালির সমবায়ী ঐতিহ্যকেই বিস্ময়কর সাফল্যে শিল্পশ্রী দান করেছেন। সহজেই অনুমেয় নজরুলের স্বতঃস্ফ‚র্ত সঞ্চরণ ছিল জাতিধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতন-অবচেতন বিচিত্র উৎসলোকে। ফলে তাঁর পুরাণ-চয়নের প্রেরণা-শক্তি যেমন সমন্বয়বাদী তেমনি ‘ঐতিহ্যবোধের ক্ষেত্রেও তিনি স্পর্শ করেছেন সমষ্টি-চৈতন্যের ইতিবাচক প্রান্তসমূহ’(খান ১৯৯৯)। তাই পৃথিবীতে যত দিন ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল’ শোনা যাবে; তত দিন মানুষকে দানব হবার বাসনা থেকে বেরিয়ে মানব হবার প্রেরণা যোগাতে নজরুলের কাব্য প্রেরণা যোগাবে, পঠিত হবে। ধাবমান পৃথিবীতে মানুষ ও মানবতার জয়গানের প্রয়োজনে তাঁর পুরাণ-ঐতিহ্য প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতা প্রবহমান থাকবে। তাঁর সমন্বয়বাদী সাম্য-চিন্তাই আমাদের শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখাবে। সমন্বয়বাদী দর্শনে চড়ে আগামীতে মানবসমাজ প্যেঁছুবে এক সাম্যবাদী সুন্দর পৃথিবীতে।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
সিইউএফ
আপনার মতামত লিখুন :