kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত কাজী নজরুল ইসলাম


কালচিত্র প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২১, ০৫:০৯ পিএম হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত কাজী নজরুল ইসলাম

কবি কাজী নজরুল ইসলাম

 

হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত কাজী নজরুল ইসলাম

 

রেজাউল করিম

 

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি, গায়ক, সুরকারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, মুক্তচিন্তার অধিকারী, হিন্দু-মুসলমান মিলতের দূত। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন, সম্প্রদায় বা জাত-ধর্মের ভিত্তিতে দেখেননি।

রেজাউল করিম

বঙ্গ-ভারতে প্রধানত হিন্দু-মুসলমানের বসবাস। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষি প্রায়ই লেগেই থাকত। এ দুই সম্প্রদায়ের হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত করতে তাঁর যেন আবির্ভাব। তাইতো তিনি ‘হিন্দু মুসলমান’ কবিতায় বলেন,

মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান,

মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।

সকল সন্তান একই মায়ের সন্তান, একইভাবে উৎপত্তি-বিনাশ। একই মাটি-আলো-বাতাসে মানুষ। তবে কেন বিভেদ- হিন্দু মুসলমান? তাই, ‘কাণ্ডারী হঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেন,

হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জ্ঞিাসে কোনজন?

কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।

যেহেতু তিনি মানবতার কবি, সেহেতু তিনি মানুষের জয়গান গাইবেন- সেটাই স্বাভাবিক। মানুষকে তিনি বড় করে দেখেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে সমতার গান গেয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষই সব। মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। তাই তো ‘মানুষ’ কবিতায় বলেন,

গাহি সাম্যের গান -

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।

মানুষ শাস্ত্রের নামে, ধর্মগ্রন্থের নামে মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতায়। মানুষের চেয়ে ধর্মগ্রন্থ কি বড়? কেননা মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ। মানুষই গ্রন্থ এনেছে, গ্রন্থ মানুষ আনেনি। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় বলেন,

পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মুর্খরা সব শোনো

মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।

এ মানুষের মধ্যেই রয়েছে পরম মানুষ। বিন্দু বিন্দু বারিতে যেমন সিন্ধু, তেমনি আত্মায় আত্মায় মিলেই পরমাত্মা। পরম স্রষ্টার আত্মা বা রুহ বা নূরেই মনুষ্য সৃষ্টি। তাই আত্মার মধ্যেই পরমাত্মা, মানুষের মধ্যেই পরম মানুষ। তাই মানুষ হয়ে মানুষকে আঘাত করা মানে খোদাকেই আঘাত করা। তাই তিনি ঐ কবিতায়ই বলেন,

কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি!

হয়ত উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবা রাতি!

 

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ভারতীয় জাতয়িতাবাদে বিশ্বাসী, হিন্দু মুসলমান মিলনে বিশ্বাসী। হিন্দু মুসলমান একে অপরের ভাই, মিলেমিশে থাকতে চাই। হিন্দু মুসলমানের মিলনের নিদর্শনস্বরূপ তিনি তাঁর প্রথম ছেলের নাম রাখেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও দ্বিতীয় ছেলের নাম খালিদ অরিন্দম। দাম্পত্য জীবনেও তিনি হিন্দু মুসলমানের মিলন ঘটিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রমিলাকে কখনো ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেননি। যেটা সম্রাট আকবর করেছিলেন। আকবর তাঁর কোনো স্ত্রীকেই ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানাননি। বরং হিন্দু রাজপুত স্ত্রীদের জন্য রাজপ্রাসাদে মন্দির বানিয়ে দেন।

 

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলনের দূত। সে কাজই তিনি আজীবন করে গেছেন। তাঁর গান কবিতায় একদিকে যেমন রয়েছে নবি পয়গম্বরের কথা, তেমনি রয়েছে হিন্দু দেব দেবীর কথা। তিনি লিখেছেন ইসলামি কবিতা, গজল, গান, তেমনি লিখেছেন হিন্দু পৌরানিক কবিতা, কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত। আবার লিখেছেন সাম্যবাদী কবিতা, গান। তাঁর বিপুল প্রতিভা দিয়ে তিনি সমন্বয় করতে চেয়েছেন। মানুষের ভিতরের পশুত্ব দূর করতে চেয়েছেন। তিনি শুধু হিন্দু মুসলমানের সমন্বয় করতে চেয়েছেন তাই নয়; তিনি বিদ্রোহ ও প্রেমের সমন্বয় করেছেন। তিনি অন্যায়ের কাছে যেমন প্রতিবাদী, বিদ্রোহী, তেমনি প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, মোমের মতো গলে গেছেন। তাই তো বিদ্রোহী’ কবিতায় বলেন,

আমি ইন্দ্রাণী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য,

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ-তুর্য্।

কাজী নজরুল ইসলাম নারী পুরুষের ভেদাভেদ দূর করতে প্রয়াসী হয়েছেন। নারী ও পুরুষ পরিপূরক। একজন ব্যতীত অন্যজন অচল। নারী পুরুষের মিলিত সুরই ঐক্যের সুর। ঐক্য যেখানে জয় সেখানে। উভয়ের প্রেরণা উভয়কে শক্তি যোগায়। উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল আজকের এ বিশ্ব সভ্যতা। তাই  তিনি ‘নারী’ কবিতায় বলেন,

বিশ্বের যা কিছু মহান চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

নারী ও পুরুষ হচ্ছে একে অপরের অঙ্গ। তাই এক অঙ্গকে বন্দি করে আরেক অঙ্গ সতেজ থাকতে পারে না। তিনি নারীর জয়গান গেয়েছেন, তাদেরকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার কথা বলেছেন। তিনি ‘নারী’ কবিতায় বলেন,

চোখে চোখে চাহিতে পার না; হাতে রুলি পায়ে মল,

মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল!

যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু উড়াও সে আবরণ!

দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন, ঐ যত আভরণ!

নারী দাসী নয়, সে মানুষ। সে মা, সে জন্মদাত্রী। সে অধিকার বঞ্চিত ও অবহেলিত থাকতে পারে না। তিনি নারী পুরুষের সাম্যে বিশ্বাসী। তাই তিনি ‘নারী’ কবিতার প্রথমেই বলেন,

সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!

মুসলমান সমাজকে তিনি জাগ্রত হতে বলেছেন, যৌক্তিক জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত হথে আহবান জানিয়েছেন। বিশ্ব কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে, গবেষণা করতে আহবান জানান। কিন্তু মুসলমান সমাজ সেদিকে অগ্রসর না হয়ে আনপ্রোডাকটিভ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় তা দেখে তাঁর দুঃখ হয়। তাই তিনি ‘খালেদ’ কবিতায় বলেন,

বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনো বসে

বিবি তালাকের ফতো খুঁজেছি ফেকা হাদিস চষে।

কাজী নজরুল ইসলামের মতো অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী মহান মানুষটিকে ধার্মিক মুসলমান ভাইয়েরা কাফের, নাস্তিক বলতে কসুর করেননি। সে দুঃখের কথা তিনি প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খার একটি চিঠির উত্তরে লিখেন, “বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙার এবং অতিমাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যেশিরোপা দিয়েছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনোদিন অভিযোগ করেছি বলে মনে তো পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হবার মতো বড় আমি হইনি। অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুরের প্রভৃতি মহাপুরুষের সাথে কাফেরের পঙক্তিতে উঠে গেলাম।” (নজরুল রচনাবলী, ৯ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ১৮২)। এ মহান মানুষটির শুভ জন্মদিনে লাল সালাম, ভক্তিপূর

----

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।

 

 

Side banner