ছাড়া গ্রন্থ: দাদুর টাকে পড়ল বেল এর প্রচ্ছদ
সমালোচক: জান্নাতুল যূথী
“দাদুর টাকে পড়লো বেল” অসাধারণ ছড়ার বইটি রচনা করেছেন নব্য ছড়াকার চিন্ময় কুমার মল্লিক। বইটি শিশু গ্রন্থ কুটির থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ এ প্রকাশিত। বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন এন. কে অধিকারী। ছাব্বিশটি আকর্ষণীয় ছড়া এ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটির সূচিপত্রের দিকে চোখ রাখলে এটি এক নিমিষেই আকৃষ্ট করবে। বইটির নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে লেখকের যেমন সিদ্ধহস্তের ছোঁয়া পাওয়া যায় তেমনি প্রত্যেকটি ছড়া রসে টইটুম্বুর। নাম ছড়া ‘দাদুর টাকে পড়লো বেল’ পাঠে শিশু কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক সকল পাঠকের কাছে দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠবে। এখানে লেখকের নিপুণ হাতে বোনা এক একটি রসাত্মাক পংক্তি পাঠককে এক অন্য ভুবনের স্বাদ গ্রহণ করাবে।
চিন্তা ও উপলব্ধির ভিন্ন মাত্রিকতা পরিস্ফুট হয়েছে প্রতিটি ছড়াায়। ছড়াসমূহে যেমন আছে আনন্দ বা হাস্যের খোরাক তেমনি রয়েছে নীতিকথন। যার দ্বারা শিশু-কিশোরদের মনোরাজ্যে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হবে। ‘দাদুর টাকে পড়লো বেল’ ছড়াটিতে ছন্দ এবং শব্দ নির্বাচনে লেখকের দক্ষ হস্তের পরিচয় ফুটে উঠেছে। পংক্তিদ্বয়ের বুনন জমে উঠেছে অনুপ্রাস ছন্দরীতিতে। ছন্দের দোলায় শিশু-কিশোরদেরকে রসাত্মক আমেজে ভাসিয়ে দিয়েছেন এভাবে-
ঠুকঠুকিয়ে দাদু চলে
গাছের নীচে দিয়ে
আপন মনে ভাবেন দাদু
করবো আরেকটা বিয়ে।
দাদু যখন বিয়ের কথা ভেবে পথ চলছেন ঠিক সেইসময় দাদুর টাকে কাকের ঠোঁকায় বেল পড়লো! ছড়াকার চিন্ময় কুমার মল্লিক অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ছড়াটি শেষ করেছেন। শেষমেশ আমরা দেখতে পায়-
টাকের ব্যাথায় দাদু এখন
খাইতে পারে না ভাত
সারাটি দিন শুয়ে বসে
টাকে বুলায় হাত।
ছড়া বইটিতে স্থানকৃত প্রত্যেকটি ছড়াতেই রয়েছে এমন এক একটি অভিনব মজার কাহিনি যার মধ্যে দিয়ে শিশু-কিশোররা আনন্দ উপভোগ করবে। তাছাড়া কিছু ছড়ার মাধ্যমে ছড়াকারের সচেতন মনের অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে। যার দ্বারা পাঠকের নীতিশিক্ষণও ঘটবে। ‘ছোটো খোকা’ ছড়াটিতে ছন্দের দোলায় ছড়াকার শিশুর মনোজগতের বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি খুব সচেতনভাবেই উচ্চারণ করেছেন-
আপন কাজেতে আমি
কখনো করি নাকো হেলা
মা-বাবার আদেশ মেনে
কেটে যায় সারা বেলা।
‘ছোটো খোকা’ ছড়ার মতো আরো একটি বিশেষ ছড়া ‘পাগল ও খোকা’। এই ছড়াটির আদ্যোপান্ত একজন মানবতাবাদী লেখকের পরিচয় পাওয়া যায়। মনুষত্বের জায়গা দখল করে আছে ছড়াটি। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি যে দায়িত্ব সেটা ছোটো থেকেই আমাদের পরিবারগুলোকে শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে বর্তমান সমাজের স্খলন কিছুটা হলেও কমবে। লেখকের অসাধারণ শব্দজাল এবং ছন্দবৈভবে ফুটে উঠেছে সামাজিক দায়বদ্ধতার এসকল চিত্র। মা সন্তানকে বলছেন পাগলের কাছে যাওয়া যাবে না, সে খামচে দেবে। কিন্তু ছোট্ট ছেলেটির অবাক করা কাণ্ড দেখে সকলেই চমকিত। ছড়াকার বলেছেন-
পাগল তোমায় খামচে দেবে
হাতের কাছে পেলে
ছোট্ট ছেলে বায়না ধরে
পাগলের কাছে যাব,
একটু খাবার তাকে দিয়ে
আমরা খাবার খাব।
এছাড়া ‘কর্মফল’; ‘মায়ের কোল’; ‘রস চুরি’; ‘বৃথাশ্রম’; ‘মূর্খ রাজা’ প্রমুখ ছড়াতে লেখকের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পরিস্ফুট। চমকপ্রদ কাহিনি এবং নীতির আলোয় উদ্ভাসিত এক একটি ছড়া যেনো সমাজের এক একটি দর্শনও বটে। পাঠক হিসেবে এজন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই্ এতো চমৎকার বাচনভঙ্গি এবং সচেতনতামূলক একটি গ্রন্থ আমাদের শিশু -কিশোরদের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করার জন্য। এই ছড়ার বইটিতে লেখকের আরো কিছু গুণের সমাহার বিদ্যমান। লেখকের ভাষা দক্ষতার পরিচয়ও পাওয়া যায় এ গ্রন্থটিতে। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে ছোট্ট শিশু -কিশোরদের ভাষার আঞ্চলিক পার্থক্য এবং বাংলা ভাষার মার্ধুয্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি ছড়ায় লেখকের সচেতন দৃষ্টি পাঠককে আকৃষ্ট করতে ব্যাকুল। ‘দাদু কনে যাতি চাও?’ আঞ্চলিক ভাষাসম্পন্ন এ ছড়াতে তিনি লিখেছেন
জমি খানা চষি আজিগি
নাগাবো তাতি ধান,
ভোর বছর তুমি বসি খানা
দাদির বানানো পান।
এছাড়াও জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলার বীজ রোপণের কারিগর প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রয়েছে অসাধারণ ছড়া। যে ছড়াটি নিমিষেই পাঠক মহলে সাড়া জাগাবে। ছড়াটি পাঠে সমগ্র বাংলার স্মৃতি ভেসে উঠে এক ঝলকেই -
মুজিব হলো ধন্য পুরুষ
বাংলা মায়ের ছেলে,
পূর্ণ জীবনের অধিক সময়
কাটালেন তিনি জেলে।
মানুষের কথা ভেবে তিনি
রাজনীতি করতে এলেন,
ছাত্রসমাজ খুশি হয়ে তাঁকে
‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব দিলেন।
মানবসেবায় জীবন দিয়ে
হলেন জাতির পিতা ।
-রসাত্মক কিছু ছড়াও মনকে সজীব করে তুলেছে। হাস্যকৌতুক মিশ্রিত ছড়ার মাধ্যমে চিন্ময় কুমার মল্লিক আমাদেরকে নিয়ে যান কল্পনার ভাবলোকে। ‘লোভী দাদু’ ছড়াটিতে বর্ণনার আতিশয্য নয় বরং সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লোভী দাদুর কুকীর্তি। আবহমান বাংলার প্রচলিতরূপের দেখা পাওয়া য়ায় এ ছড়াটিতে। যেখানে লোভী দাদুর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাবনার আলোকোজ্জ্বল রূপ ফুটে উঠেছে। ছড়াকার বলেছেন-
শ্বশুরবাড়ির মধুর খাবার
অনেক মজার হয়,
তাইতো দাদু সুযোগ পেলেই
চলে শ্বশুরালয়।
‘দাদুর সাজসজ্জা’ ছড়াটিতে ভরপুর রসের সমাহার ঘটিয়েছেন লেখক। এখানে শ্বাশুরবাড়ি যাওয়াকে কেন্দ্র করে দাদুর পাকা চুলে কলপ করার মজার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। দাদুর রসিকচিত্তের সাথে সাথে লেখকের সরস মনেরও পরিচয় ফুটে উঠেছে আলোচ্য ছড়াটিতে-
ছাতা খানা বগলে করে
হাতে মিষ্টির থলে।
দারুণভাবে ছাঁট দিয়েছে
মুখের সব দাড়ি,
দিদার সাথে দাদু যে তাই
যাবে শ্বশুরবাড়ি।
শৈশব-কৈশোরে দাদি-নানির মুখে শোনা বিভিন্ন রূপকথার কাহিনি সম্বলিত ছড়াও স্থান পেয়েছে বইটিতে। যা আমাদেরকে নিছক শৈশবের স্মৃতি আস্বাদন করায়। ‘ব্যাঙের বিয়ে’; ‘ইচ্ছেঘুড়ি’ তেমনি দুটি ছড়া যেখানে লেখক আবহমান বাংলার শৈশবস্মৃতিকে চাঙ্গা করে তুলতে সহায়তা করেছেন। ‘ব্যাঙের বিয়ে’ ছড়াতে আমরা লক্ষ্য করি-
টাপর মাথায় বর এসেছে
ব্যাঙেরেই মাঝে,
বউ ব্যাংটি চুপটি থাকে
ঘোমটা দেয় লাজে।
‘খুকুর জন্মদিন’ ছড়াটি ছোট্ট খুকুমণির জন্মদিনের আনন্দকে কেন্দ্র করে রচিত। এছাড়া ‘বৃষ্টি ঝরে’; ‘ঋতুর ফুল-ফল’; ‘পাখিদের কাজ’ প্রভৃতি ছড়াতে লেখকের প্রকৃতির প্রতি অপার ভালোবাসা এবং আত্মিক টান অনুভব করায়। আরও একটি ছড়া যা ছোট থেকে বড় সকলের মনকে আন্দোলিত করবে বলে আশা রাখছি। ‘পুতুলের বিয়ে’ নামক ছড়াটিতে একদিকে ছোট্টরা যেমন আনন্দে ডগমগিয়ে উঠবে তেমনি বড়রা তাদের শৈশবে ফিরে যাবে। আমরা জনি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ছোট্ট মেয়ে শিশুদের খেলার অন্যতম উপকরণ পুতুল। সেই পুতুলকে ঘিরে একজন মেয়ে শিশু তার সমাজ বা¯বতার সাথে পরিচিত হতে শেখে। পুতুলের বিয়ে দিয়ে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোকে কেন্দ্র করে সে নিজেরই অদূর ভবিষত্যের স্বপ্ন বীজ বপন করে। নিত্য ঘটে যাওয়া এমন অসংখ্য হাস্য-রসাত্মক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভাষ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সমগ্র গ্রন্থটি।
প্রতিটি ছড়ার সাথে মিল রেখে চিত্রের অঙ্কনকুশলতা, শব্দ নির্বাচন, ভাষা, ছন্দের বুনন, সঠিক এবং পরিমার্জিতরূপ ছড়াগুলোকে জীবন্ত করেছে। শিশু- কিশোরদের কথা মাথায় রেখে বইটিতে রঙের ব্যবহারও নজরকাঁড়া। ছড়াকারের মানবিক দর্শন প্রকাশ পেয়েছে প্রতিটি ছড়ায়। যেহেতু এটি লেখকের প্রথম ছড়াগ্রন্থ সেহেতু ছন্দের মেলবন্ধন করতে গিয়ে কিছুটা ছন্দপতন পরিলক্ষিত হয়। পরর্বতীতে অবশ্যই লেখক এদিকে আরও সচেতন দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন। আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক যেটি না বললেই নয় সেটি হচ্ছে প্রতিটি ছড়ার শেষে ছড়াকার তারিখ সংযোজন করেছেন কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি দিলেও দেখতে পাই তিনি অতি দ্রুততম সময়ে ছড়াগুলোকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সেক্ষেত্রে যদি হাতে কিছুটা সময় নিয়ে ছড়াকার পাঠকের সামনে গ্রন্থটি প্রকাশ করতে উদ্যত হতেন তবে নিঃসন্দেহে আমরা আরও পরিমার্জিতভাবে গ্রন্থটি পাঠ করতে পারতাম। সবকিছুর উর্ধে উঠে এ গ্রন্থটি নীতিশিক্ষণ, সমাজ বাস্তবতা, মানবিক দর্শন, হাস্যরস, কৌতুকের মাধ্যমে পাঠকের মনে অচিরেই স্থান করে নেবে। সেইসাথে পাঠক মনে প্রবল আকর্ষণেরও সৃষ্টি করবে। অন্তিমে ছড়াকারের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।
লেখক: খণ্ডকালীন প্রভাষক (বাংলা), নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন :