kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ফেরা


কালচিত্র | এ্যানি আরনো - অনুবাদক : জাফর জয়নাল প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০২৩, ১১:৩৭ এএম ফেরা

ফেরা

মূলগল্প লেখক : এ্যানি আরনো

- অনুবাদক: জাফর জয়নাল

 

গত জুলাইয়ের কোনো এক রবিবারে আমার আম্মার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল। ট্রেনে সেখানে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় আমরা মোট্টেভিল্লে’র স্টেশনে বসেছিলাম। শান্ত এবং উষ্ণ ছিল কম্পার্টমেন্ট এবং বাইরের আশপাশ। খেলা জানালা দিয়ে দেখছিলাম বাইরের শূন্য প্লটফর্ম। এস.এন.সি.এফ. রেল-রোডের পাশের লম্বা ঘাসগুলো আপেল গাছের নিচু ডালগুলো ছুঁয়ে ছিল। তারপর বিষয় গুলো সত্যিকার অর্থে উপভোগ্য হয়ে উঠলো, আমি অনেকটাই সি এর কাছাকাছি এসে পড়েছি। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। বিষয়গুলো আমাকে তাড়িত করছিল। সি এর কাছাকাছি এসে ট্রেন গতি কমিয়ে আনলো এসময়।

 

স্টেশন ছেড়ে আসার পর, মনে ভেসে উঠলো অনেকগুলো মুখ-ছবি, যদিও তাদের কারো নাম মনে রাখতে পারি না। কিছুটা কম গরম আবহাওয়া মনে হলো। বাতাসটা মনোরম ! সি সবসময় বাতাসে পূর্ণ থাকে। আর সবার মতো মা-ও বিশ্বাস করে সি-তে এখন ঠাণ্ডা। এইসব পথ-ঘাট এমনকি সামনের পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে যাওয়া জায়গাগুলোও তাই।

 

রেল-রাস্তার হোটেলগুলোর পাশে ট্যাক্সি ছিল, সেই ট্যাক্সি না নিয়েই এগুতে থাকলাম। অল্প কিছু সময় পর সি-তে পৌঁছে গেলাম। পুরাতন রাস্তায় ফিরে আসলাম, যেখানে ট্যাক্সি যোগাযোগ, বিবাহ এবং মৃতের সমাধি পাশাপাশি চলে। টাকা খরচের কোন মানে হয় না। রুথি কারনোট মানে শহুরের মধ্যভাগের কাছাকাছি চলে এসেছি। প্রথমে পেটিস, তারপর, কেক, ইকলার, আপেল টার্টস⸺ মা প্রায় বলতে দুপুরের খাবারের পর এসব আনতে। মায়ের জন্য কিছু ফুল কিনেছিলাম ভিতর গ্রাডিওলাস ফুলও ছিল। ফুলগুলো দীর্ঘ সময় সতেজ ছিল ভেবে ভালো লাগে। যতক্ষণ না আমি তার বাসভবনের কাছাকাছি আসতে পারছি, ততক্ষণ অন্যকিছু নিয়ে ভাববার কথা ভাবই যাচ্ছিল না। অবশেষে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়, তিনি অপেক্ষায় ছিলেন আমার জন্য।

 

নিচতলার ছোট্ট দরজায় ধাক্কা দিতেই - ভিতর থেকে তিনি বললেন, ‘ভিতরে আসো !’

‘দরজাটা লাগিয়ে এসো !’

‘আমি জানতাম তুমিই এসেছো। তুমি ছাড়া কেউ আসার কথা ছিল না।’

টেবিলের পাশে অ্যাপরন ছাড়াই লিপস্টিক জড়ানো হাসি দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার কাঁধে হাত রাখলেন এবং আমার দিকে ঝুঁকে চুমু দিতে এলেন। এই সময় তিনি আমাকে আমার আসা পথের বিষয়ে জানতে চাইলেন, সঙ্গে জানতে চাইলেন বাচ্চাদের কথা এবং আমার পোষা কুকুরের কথা। আমি তার একাকী বিরক্তিকর বিষয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলাম। পরে তিনি উত্তর দিলেন, তিনি ভালো আছেন এখানে, এর চেয়ে ভালো থাকা যায় না, ‘আমার কোনো এর চেয়ে ভালো বিশেষণ জানা নেই’। টিভি চলছিল কোনপ্রকার শব্দ ছাড়াই, যেন কিছু হিজিবিজি নকশার মত।

 

আমাকে একপ্রকার কৃত্রিম ধন্যবাদ দেয়ার সঙ্গে গ্ল্যাডিওলাস ফুল কিছুটা অস্বস্তির সঙ্গে টেবিলে রাখলেন মা। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার দেয়া ফুল তাকে সবসময় আকর্ষণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টা তাকে টানে। আমরা তাকেই পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করেছিলাম, শুধুমাত্র পারিবারিকভাবেই বিষয়টা ছিল না। মার জন্য যে কেক নিয়ে গিয়েছিলাম তাতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। এর আগে অবশ্যই তিনি আমাদের জন্য কিছু কেক কিনে এনে রেখে ছিলেন বাইরের থেকে।

 

আমরা টেবিলে বসলাম মুখোমুখিভাবে, তার খুব কাছাকাছি এবং অনুভব করছিলাম তার ঘরটি। আমার মনে পড়লো প্রথমে তিনি কি বলেছেন যেসব কথা, যেমন- ‘দশম আসন বিশিষ্ট টেবিলটি আমি কিনেছিলাম কেন !’ গত ছয় বছর যাবৎ এই আসনটি ফাঁকাই পড়ে আছে। টেবিলটা তিনি ভালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছেন যেন, টেবিলটা নষ্ট না হয়।

 

মা স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন, কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারেনি, বুঝতে পারছিল না কি নিয়ে কথা বললেন । তার ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, সাথে ছিল ঘরময় ঘ্রাণ। সেখানে যথেষ্ট বাতাস নেই। প্রায় রবিবার আম্মা ছোটবেলা আমাকে নিয়ে তার পরিচিত প্রবীণ নারীদের দেখতে যেতেন। আম্মা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘‘বৃদ্ধ মানুষদের ঘরে একটা সেকেল ঘ্রাণ সবসময় থাকে⸺ তারা কখনো তাদের জানালাগুলো কখনো খুলে না !’ আম্মা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন এরকম বলতে। যদিও আমি তেমনটা প্রস্তুত ছিলাম না - এতদিন পরেও তিনিই সে বৃদ্ধা মানুষের দলে নিজেকে নিয়ে আসবেন।

 

আম্মা আমাকে সি-এর বসন্তকালীন আবহাওয়ার কথা বলতেন। বলতেন সে সকল মানুষের কথাও যারা মারা গিয়েছেন⸺আমার শেষবার আসার পর। আম্মা মনে করিয়ে দিতেন তাদের বিভিন্ন বিষয়-আশয় যেন আমি তাদের চিনতে পারি। মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আম্মা বিস্তারিত বলতেন, যতক্ষণ না, আমি তাদের কে চিনতে পারি⸺ বলতেন তার মেয়ে তোমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়তে যেত এবং আরও অনেক খুঁটিনাটি বিষয়।

 

আমরা টেবিলটা চার ভাগের এক থেকে বারোতে উন্নিত করি। শেষবার তিনি অপেক্ষা করছিলেন টেবিলটা কখন বারো-তের জনে ভোরে ওঠে তা দেখার জন্য। কথা প্রসঙ্গ তিনি এক জায়গায় বললেন, আমাদের এই সুন্দর দিন দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে।

 

তোয়ালে খুঁজতে গিয়ে বুফে-কাউন্টারের পেছনে একগুচ্ছ রোমান্স ম্যাগাজিন পেলাম। এ বিষয়ে মাকে আমি কিছু বললাম না, কিন্তু এটা কেমন করে জানি বুঝতে পেরেছেন যে, আমি এই ম্যাগাজিনগুলো দেখেছি। ছোটো ম্যাগাজিনগুলো পলেট আমাকে দেয়, তাছাড়া তুমি জানো আমি এগুলো পড়বো না। সেগুলো সে পড়েছে, গল্পগুলো তেমন বড় কিছু না।’’ আম্মা তখনও খানিকটা ভয় পাচ্ছিলেন, আমি যদি তারা পড়ার অভ্যেস নিয়ে কিছু বলি। আমি তাকে বলেছিলাম যে, তিনি নউস ডিউক্সের চেয়ে ম্যালরাক্সে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন⸺ তিনি পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনতেন। আমি যেমন ধরনের বই পড়তে অক্ষম তেমন বই সে পড়লে সেই মনে হয়তো অসুখী হত।

 

খাবার খাওয়া নীরবেই শেষ হলো। তার চোখ তারই খাবারের প্লেটের ওপর। তার সামান্য নাড়াচড়া দেখে বোঝা যায় তিনি একা একা খেতে অভ্যস্ত মানুষ। থালা-বাসন ধোয়ার কাজটা তিনি আমাকে করতে দিলেন না। তিনি আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘তুমি চলে গেলে তারপর আমার কী করার থাকবে ?’’

 

তিনি সোজা হয়ে তার দু’বাহু জড়ায়ে চেয়ারে বসেছিলেন। আমি কখনো তাকে এমনটা দেখিনি যে তিনি কোনো বইয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন- সঙ্গে স্বাভাবিক, স্বাচ্ছন্দ্যময় গতি চুল নাড়ছেন কিংবা ব্লাউজের ভিতর হাত দিচ্ছে। তার একমাত্র অভিব্যক্তি ছিল অবসাদের ভিতর দিয়ে যাওয়া: মাথার ওপর হাত প্রসারিত করে থাকা, অতি মন্দাভাবে পা দুখানি সামনের দিকে ছড়িয়ে রাখা। তার মুখে যতটা কঠোরতা দেখা যেত তার চেয়ে কম ছিলো জীবনের মধ্যপথ দিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহের। তার ধূসর চোখ দুটি সবসময় আমাকে সন্দেহ করতো তীব্রভাবে, এর পাশাপাশি সেখানে আমার জন্য ভয়ানক রকমের স্নিগ্ধ ভালোবাসাও ছিল আমার জন্য। আম্মা বসে বসে আমার অপেক্ষায় দিনগুনতেন-এমনকি আমি যেদিন সকালে আসবো সে দিনও, ভাবতে ভাবতে আমাদের অর্ধেক সময় চলে যাই। আমাদের এই পারস্পারিক সাক্ষাৎ ছিল সবসময় অনুসন্ধানী এবং ভালোবাসার। আমার বয়স যখন পনেরো বছর তখন আমাদের ভিতর একটা বীভৎস রূপ তৈরি হয়েছিল সেটি আর ফিরে আসবে না।

 

‘‘গরু, কুকুর আমি তার জন্য নিজেকে শেষ করতে চেয়েছি।’’ ‘‘ আমি সেখান থেকে যৌনস্বাদ পেতে চেয়েছি।’’ ‘‘তুমি প্রথমে জেলে যাচ্ছো, অনেকটা অপ্রয়োজনীয় গাধার মতো।’’

 

আম্মা আমার সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইতেন, আমার সঙ্গে, তার মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা তার ভিতর কাজ করত, আমি তার এ আকাঙ্ক্ষাসহ সব কিছু রেখে অনেকটা একাকী রেখে চলে আসতাম-অনিশ্চিতভাবে সবসময়ের জন্য। বললেন, ‘‘পলেট আমার জন্য কিছু হংসবেরি এনেছে। তুমি বিশ্বাস করবে না সেগুলো আসলে কতটা ভালো। এটা সত্যি অসাধারণ কারণ এগুলো ডিম দেওয়ার অবস্থায় আছে। তুমি যাওয়ার আগে আমাকে মনে করিয়ে দিও, তোমাকে সেখান থেকে কয়েকটা দেবো।’’ পলেট⸺আমার সমবয়সী আম্মার প্রতিবেশি⸺তিনি আম্মাকে দেখার জন্য প্রতি সপ্তাহে একবার করে আসেন; তিনি কখনো সি ছেড়ে যাননি।

 

আমি অনতিদূরে ট্র্যাংক রোডে গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, শুনতে পাচ্ছিলাম পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দরজা থেকে সম্ভবত ভেসে আসছিল ফ্রান্সের ট্যুর ডি রেডিও আওয়াজ।

‘‘এটা একটা শান্তিময় পরিস্থিতি।’’

‘‘এটা সবসময় শান্তিপূর্ণ জায়গা। তার ভিতর সবচেয়ে শান্ত দিন রবিবার।’’

 

আম্মা অনেকবার ছুটিতে আমাকে বলেছেন আমি যেন ছুটিতে বিশ্রাম করি। সেকথাটা আমাকে অনেক বেশি আতঙ্কিত করে যখন আমি বলি ⸺ ‘‘আমি জানি না কি করতে হবে: শুধু আপনি বিশ্রাম নিন।’’ আবার, আমি বিরক্তি অনুভব করি কিন্তু তার কথার ওপর কোন কথা বলার ক্ষমতা আমার আর ছিল না। খেলাধুলার রেডিও এবং আপেল ট্রার্ট শুধু মাত্র তার স্মৃতিগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। সি-তে গ্রীষ্মের আবহাওয়ায় আমি একঘেয়েমি অনুভব করছি: সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পড়া, রবিবার চলচ্চিত্র দেখা, প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য মন্ডিয়ালের তিন-চতুর্থাংশ খালি থিয়েটারে বসে থিয়েটার দেখা। যখন ভাবলাম আমার আত্মীয়ের সঙ্গে বাইরে হাঁটতে যাবো, স্থানীয় ব্যবসায় শিশুদের খেলার জায়গায়; সাধারণের নাচের জায়গায় আমি প্রবেশের সাহস করতে পারিনি।

 

মাঝ বিকেলে রান্নাঘরের জানালায় একটা বিড়াল এসে হাজির। আম্মা লাফ দিয়ে তার চেয়ার থেকে উঠে তার দত্তক নেওয়া বিড়ালটা ভিতর ঢুকতে দেয়। আম্মা বিড়ালটাকে খাওয়ায়, বিড়ালটা দিনের বেলায় আম্মার বিছানায় ঘুমায়।

 

আমি সেখানে যাওয়ার পর আম্মা অনেক সুখী ছিলেন। বিড়ালটা আমাদের দিনের একটা দীর্ঘ সময় ব্যস্ত রাখতো⸺এটাকে দেখে রাখা, যত্ন-আয়ত্তি করা নিয়মিতভাবে। আম্মা বিড়ালটা নিখুঁত বর্ণনা দিতেন, বিড়ালের লাল ডেরাকাটা দাগের কথা বলতেন বারবার। আম্মা প্রায় বলতেন, ‘‘সব জীবন্ত জিনিসই সুন্দর।’’ আমার মনে হতো আম্মা প্রায় ভুলেই গিয়েছেন যে আমি চলে যাচ্ছিলাম।

 

শেষের দিকে তিনি একটা ফর্ম নিজের দিকে টেনে নিলেন, এই ফর্মটা আম্মার সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পূরণ করা জরুরি।

 

‘‘আমার সময় নেই। আমাকে ফর্মটি দিন আমি এটি পূরণ করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো।’’

‘‘এটার জন্য সময় লাগবে না। বাসা থেকে স্টেশন পাঁচ মিনিটের পথ।’’

‘‘আমি ট্রেন ধরতে পারবো না।’’

‘‘তুমি ট্রেন কখনোই মিশ করবে না। পরের ট্রেনে তুমি চাইলে যেতে পারো।’’

 

আম্মার চোখে তখন অশ্রু এসে গিয়েছিল। শেষের দিকটায় তিনি এমনটাই করতেন।

‘‘বিষয়টা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর।’’

দরজার কাছে আম্মা আমাকে চুমু খাওয়ার পর তার কথা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করলে। মায়ের শেষ ছবিটা এমন : দরজার সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, হলুদ রঙের পোশাকের সঙ্গে নিখুঁত বাহু বেষ্টিত রূপে তাকে অনন্য লাগছিল, সুগঠিত বুক এবং পেট সঙ্গে তার যথারীতি মুখ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাসির ঝিলিক। সে সময় আমার মনে হলো আরও একবার আমি ছেড়ে আসছি সবকিছু অনেকটা কাপুরুষোচিত ভাবে⸺ যেন আমার এটা করা ঠিক হচ্ছে না।

 

আমি ট্রেনের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত দিয়ে হাটতে শুরু করলাম, পথটা সেল স্টেশনের পাশ দিয়ে গেছে। এখনেই, অতীতের দিনগুলোতে আম্মার প্রশ্নালু দৃষ্টির কাছে আমার প্রস্তুতি থামিয়ে দিয়েছি, যখন আমি সিনেমা দেখে ফিরতাম, আমাকে আরো একটু সতেজ করতাম এপথে, এপথেই আমার লিপস্টিক মুছে ফেলতাম। ভাবতাম, লোকজন আমাকে নিয়ে কি ভাববে ?

 

ট্রেনে আমি অনুভব করলাম আমার উপস্থিতির সব উপাদান তার কাছ থেকে মুছে যাচ্ছে, আমি নিজে তাকে কোনো কাজে সাহায্য করছি এমন দৃশ্যে করতে পারছি না ⸺ হয়তো থালা ধুয়ে দিচ্ছি কিংবা অন্য কিছু, কিছুই মনে করতে পারছি না। ট্রেনের জানালা দিয়ে আমি আমার শহর সি কে দেখছিলাম, আর একে একে সি-য়ের সব কিছু সরে সরে যাচ্ছিল, সারমের দালালনগুলো, রেলের কর্মীরা, ট্রেনের পথের পাশে গড়ে ওঠা আবাসনগুলো।

 

এক মাস পর, আমি আম্মাকে দেখতে ফিরে এলাম। সানস্টোকে আক্রান্ত হয়ে আম্মা সি-এর একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছেন। আম্মার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে সেখানে সেখানকার আলো-বাতাসহীন অ্যাপার্টমেন্টে আলো এবং বাতাসের প্রবাহ ঠিক করলাম। চারপাশটা পরিষ্কার করলাম ঘষে ঘষে, অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তার ফ্রিজ থেকে বের করলাম। সবজির ড্রয়ারে প্লাস্টিক ব্যাগের ভিতর সবচেয়ে ওপরের তাকে রাখা ছিল হংসবেরি গুলো, গতবার আমি সেগুলো সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়ে ছিলাম⸺ সে হংসবেরি গুলো এখন শুধুই বাদামী রঙের তরল স্তুপ।

 

⸺১৯৮৫ ( ফরাসি ভাষা থেকে ডেবোরা ট্রেসম্যান ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন দি নিউ ইর্য়কার পত্রিকার ১৪ই নভেম্বর, ২০২২ সংখ্যা। মূলগল্পটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে ফেঞ্চ “Retours,” in “Écrire la Vie,” by Éditions Gallimard এ। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে একজন সামান্য অনুবাদক হিসেবে আনন্দ পেয়েছি, নিজেকে গল্পের ভিতর আবিষ্কার করতে পেরেছি।)

(শেষ)

 

লেখক পরিচিতি : অ্যানি দ্যুশেন (১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৪০) যিনি অ্যানি আরনো নামেই পাঠক সমাজে পরিচিত। প্রায় বিরাশি বছর বয়সে এসে প্রথম কোনো ফরাসি নারী লেখকের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটে। অ্যানির লেখায় আত্মকথন অত্যন্ত মোলায়েমভাবে ছড়ানো-ছিটানো থাকে। অনুরূপভাবে ‘ফেরা’ গল্পটিও অ্যানির মায়ের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে, প্রতিবেশীর সঙ্গে, প্রতিবেশের সঙ্গে, শহরের সঙ্গে যে জীবন গড়ে উঠেছে তারই বয়ান। গল্পটি বাংলা ভাষাভাষী যেকোনো পাঠকের পাঠের ক্ষেত্রে আমি বলবো গল্পটি নিরিবিড়ি আবহাওয়ায় পড়ুন। আপনি আপনার মায়ের স্পর্শ অনুভব করবেন। গল্পটি অনুবাদ করতে গিয়ে আমার প্রিয় শহর এবং মায়ের কথা বারবার মনে পড়েছে।

Side banner