চন্দন আনোয়ার রাজশাহীর ছেলে, আমিও। তবে আমি রাজশাহী ছাড়া বহু বছর। এখন অবসর কাটছে গাজীপুর। ওঁর সাথে দেখা হবার আগে বহুবার মোবাইলে কথা হয়েছে। ভরাট গলা, শুদ্ধ উচ্চারণ। ওঁর পত্রিকা ‘গল্পকথার জন্য বেশ কটি প্রবন্ধ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। একবার তাঁর আগ্রহেই দেখা হয় একুশে বইমেলায়। বয়স চল্লিস ছুঁই ছুঁই করলেও দারুণ তরুণ। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। ইতোমধ্যে সৃজনীল ও গবেষণা শাখায় অনেকগুলো প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছেন। দুই বাংলা সাহিত্যবোদ্ধাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এসবই চন্দন আনোয়ারের মেধা, শ্রম ও সাধনার ফল। এ বছর কলকাতা বইমেলায় একুশ শতক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে চন্দন আনোয়ারে গল্পসংকলন ‘নির্বাচিত ৩০’। মূলত এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর চারটি এবং প্রকাশিতব্য একটি মোট পাঁচটি গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো থেকে নির্বাচিত ৩০ টি গল্প নিয়ে এই বইটির পরিকল্পনা। প্রথম ফ্লপে কলকাতার বর্ষীয়ান সম্পাদক, কলামিস্ট ও কথাশিল্পী সৌমিত্রি লাহিড়ী জানান যে, ববাংলাদেশের মূর্তমতী বুদ্ধিজীবী লেখক আবদুশ শাকুর তরুণ লেখক চন্দন আনোয়ারের নিষ্ঠা ও শ্রম সাধ্য উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ও লেখক হতে পারে। ওর মধ্যে সম্ভাবনা আছে।’এছাড়া চন্দনের গল্প পড়ে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক সাধন চট্টোপাধ্যায় পাঠক্রিয়ার অভিজ্ঞতা লিখেছেন এভাবে, ‘চন্দন আনোয়ার প্রায় সকল গল্পের শুরুতেই আখ্যানে চাপা একটি টেনশন তৈরি করে। কাহিনির কোন ঘনঘটা থাকে না। পাঠককে টেনশনের সুতো ধরে ক্রমশ কৌতূহলকে মেলাতে মেলাতে, শরীরের সম্পসারিত অংশ হয়ে নিয়ে ক্রমশ দেশ হয়ে ওঠে।’ (চন্দন আনোয়ারের গল্প : পাঠক্রিয়ার অভিজ্ঞতা) এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘উভয়বঙ্গের সাম্প্রতিক লেখালেখিতে এমন গল্পের তুলনা খুবই বিরল।’
আমি চন্দন আনোয়ারের পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ হাসান আজিজুল হক সাহিত্যকর্ম, ও অন্যান্য গ্রন্থ বা সম্পাদিত গ্রন্থ পাঠে যতোটা মুগ্ধ হয়েছি, তার চেয়ে অধিক আনন্দ, বিস্ময় আর মুগ্ধতায় পাঠ করি তাঁর গল্পের বিষয় ও নির্মাণশৈলী। চন্দনের গল্পের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায়। ওঁর গল্পের বুনন প্রণালী বার বার মনে করিয়ে দেয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের গঠন ও কথনরীতির কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চন্দনের গল্প চন্দনের মতো হয়েই গড়ে ওঠে। তাঁর গল্পের বিষয় প্রধানত নগরজীবন, সামাজিক অবক্ষয়, নারীর অধিকার, রাজনীতি আর মুক্তিযুদ্ধ। তবে এসব সঙ্গ-প্রসঙ্গ গল্পের শরীরকে স্ফীত করে না, খুব প্রচ্ছন্নভাবে তাঁর প্রয়োগ থাকে। বাস্তব খানিকটা যাদুবাস্তব বা পরাবাস্তব ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়। চন্দন আনোয়ার গল্পের ঘটনা, চিত্র কিংবা চরিত্র চিত্রণে অবিরল উপমা প্রয়োগ করেন। আঞ্চলিক ভাষা, বিশেষ করে রাজশাহী এলাকার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। সেইসঙ্গে তিনি অবলীলায় চরিত্রের মুখে তুলে দেন অকথ্য গালি। ইংরেজি শব্দ বা বাক্যাংশ সংযুক্তকরণও অপ্রতুল নয়। উপমা, গালি ও ভিনদেশি শব্দ সবই আসে সাবলীলভাবে, অতি পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে।
চন্দন আনোয়ার গল্পের সূত্র মেনেই গল্প শুরু করেন, কিন্তু শেষটা হয় যেন প্রত্যাশার চেয়ে অধিক প্রচ্ছন্ন। তাঁর গল্প প্রচলিত ধারা স্পর্শ করে খানিকটা আলাদা, কিছু চমকপ্রদ, বাহুল্যতাবর্জিত, গল্পবাজারে টিকে থাকার মতো। চন্দন আনোয়ারের জন্ম ১৯৭৮-এ। মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। প্রচুর নির্ভুল পঠন-পাঠনের মধ্যদিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালকে সঠিকভাবে অনুধাবন করেছেন। তাঁর চেতনায় সঞ্চিত হয়েছে রাজনীতির চালবাজি, হরতালের তাণ্ডবলীলা, পুলিশের দৌরাত্ম্য আর শাসক-শোষকের চাপে পিষ্ঠ নিরীহ মানবজীবন। তাই তাঁর গল্প কেবল কল্পনার ফানুষ নয়, বাস্তবতার মাটি-রসে পুষ্ট নবতর সৃজনকর্ম। চন্দন আনোয়ার কেবল গল্পের সাদামাটা ঘটনা বিস্তারে আগ্রহী নন। গদ্যের কৌশলী প্রয়োগে, শিল্পের বিশেষ মাধুর্যে তাঁর গল্প হয় সফল শিল্প।
চন্দন আনোয়ার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লেখক। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কবি ও কাপালিক’-এ গল্পকারের স্বদেশপ্রীতি আর বাঙালি জাতিসত্তাবোধের পরিচয় সুস্পষ্ট হয়। বাংলা ভাষা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা অর্জন সংরক্ষণে কম সাধনা সংগ্রাম করতে হয়নি। বিরোধীপক্ষ সর্ব খড়গহস্ত উঁচিয়ে রেখেছে। তারা বলেছে, রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু, বাংলা নয়। রবীন্দ্রচর্চা বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ মনঃপূত হয়নি। গল্পে দেখা যায়, স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কিলার দেশের প্রধান কবিকে খুন করতে এসেছে। গল্পের শুরুতে কিলারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : শহরে আগন্তুক ঢুকেছে। এসেছে রাতের ট্রেন ধরে। কমলাপুর স্টেশনে নেমেই প্রথমে নিজের দিকে তাকিয়েছে একবার। আগন্তুক কালো, ঋজু ও খর্বকায়। খয়েরি রঙের প্যান্টের উপরে অ্যাপ্রোনের মতো একটা ফতুয়া শরীরে। প্রশস্ত করোটিতে দুইটা কাটা দাগ। প্রায় গিরগিটির মতো লম্বা ঘাড়। ঝোপের মতো ভুরু, নিচের দুটো চোখের একটি কিছুটা অস্বাভাবিক। ডান চোখের মধ্যমণি নাই বলেই মনে হচ্ছে। হাত দুটো সাগর কলার মতো ঝুলছে। অস্বাভাবিক চোখটাকেই স্টেশন দেখার কাজে লাগাচ্ছে। দুম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ব্যস্ত সে। খড়ের মতো অগোছালো চুলে চিরুনি চালায় ক্ষিপ্রতার সাথে। এক ফাঁকে চিরুনি চালায় দূর্বাঘাসের মতো ছাঁট করা ঘন দাড়িতে। এরপর হাতে তুলে নিল খয়েরি রঙের ব্রিফকেস। সিনা উঁচু করে সাহসি এবং স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে এবং মৃদু গলাখাকারি দিয়ে পরীক্ষা করে নিয়েছে নিজের কণ্ঠনালি। আগন্তুক বেঁটে হওয়ায় লম্বা করে পা ফেললেও এগোতে পারছে অল্প। অবশেষে স্টেশন ছেড়ে মিশে গেল জনমিছিলে। জনমিছিলের ঘনত্ব ছেড়ে একটা কালো রঙের ক্যাবে উঠে বসল। (পৃ. ১৭)
পরিকল্পিতভাবে খুনের প্রক্রিয়াটি সংঘটনের দিকে এগোয় আগন্তক। কবির স্ত্রী-সন্তানরা বাড়ি নেই, কবি এবং সন্ত্রাসীদের এসিডে মুখ ঝলসে যাওয়া কাজের মেয়েটি ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। প্রথম আলাপেই কবি জেনে যান যে, তিনি খুন হচ্ছেন, কিন্তু অত্যন্ত কৌশলী ও ঠাণ্ডামাথার এই কিলার তাৎক্ষণিকভাবে কবিকে খুন করেনি। বরং আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়। কবির উপরে সে এবং তার সংগঠন কেন রুষ্ট এবং খুন করার তালিকায় কেন কবির নাম উঠেছে উত্তেজনাবশত একপর্যায়ে বলেছে আগন্তক, ‘আপনার লেখায় এইসব কী থাকে? গণতন্ত্র! সমাজতন্ত্র! জাতীয়তাবাদ! বস্তাপঁচা বাতিল এইসব আইডিয়াকে আমি খান্কিবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই মনে করি না। হু! বিকৃত হাসি দিতে দিতে শান্ত হতে হতে আগন্তুক বিড়বিড় করে, গণতন্ত্র! সমাজতন্ত্র! মুক্তিযুদ্ধ! এইসব ছাড়া আপনারা কবিরা কবিতা লিখতে পারেন না!’ (পৃ. ১৯) প্রকৃত দেশপ্রেমিক কবিরা নিজেকে অপশক্তির কাছে বিক্রি না হয়ে জীবনবাজি রেখে সত্য উচ্চারণ করেন; দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে আমাদের জাতীয় সংগীত মনঃপুত হয়নি। তাই কবিকে প্রলোভন দেখানো হয় : আমার সোনার বাংলা’পাল্টে নতুন জাতীয় সঙ্গীত দেশের মানুষের দাবি। আপনাদের মতো কবি-সাহিত্যিকদের জন্য পারছি না। সামান্য এই কাজটি করে আপনি নিজে বাঁচবেন, সন্তান দু’টা এতিম হবে না! একজন নারী বিধবা হবে না! দেশের মানুষও মালাউনের হাত থেকে বাঁচে! আমার সংগঠনও বেগবান হবে।
কবি সাপাট দাঁড়িয়ে গেলেন। দুই হাত টানা সোজা করে এবং সিনা উঁচু করে স্কুল বালকের মতো সুর করে গাইতে লাগলেনÑআমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তো... (পৃ. ২৩) তাঁর ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীর বিচারকেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় রাজাকার আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী অসংখ্য বাঙালি নারীকে নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করে ডোবা-নালায় পুঁতে রেখেছিল। যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও এক পর্যায়ে ক্ষমতার লাগাম চলে যায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির হাতে। কিন্তু শুদ্ধচেতনার বীজ জেগেই থাকে। ফলে দেখা যায়, বহু বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হবার পরে মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহ নরহত্যা ও ধর্ষণের বিচারের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। গল্পে দেখা যায়, শহর থেকে আগত কিছু তরুণ আবিষ্কার করে একটি বদ্ধভূমি, যা বটবৃক্ষের ছায়ায় শহিদদের আচ্ছাদিত করে রেখেছে। উক্ত এলাকার স্কুল মাস্টারের মেয়ে নাসরিনসহ কতিপয় তরুণ ডোবাটি লাল নিশানা দিয়ে ঘিরে ফেলে। থানার ওসি এসে পরিত্যক্ত ডোবাটির পাহারার ব্যবস্থা করে। গ্রামের মানুষের মধ্যে তৈরি হয় নানা রকমের গুঞ্জন ও আতঙ্ক। উত্তাল বাতাসে সদর্পে পতাকাগুলো উড়তে দেখে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ জমির খাঁ হয় আতঙ্কিত। কারণ, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে। আতঙ্কে-ভয়ে জমির খাঁ তার-ই স্কুলের মাস্টারের মেয়ে নাসরিনকে কখনও হুমকি দিয়ে কখনও করুণা প্রার্থনা করে সত্য ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিচারের আগেই পুরনো পাপই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। জীবনবাদী গল্পকার খানিকটা অতিলৌকিক ও সদর্থক ভঙ্গিতে গল্পের সমাপ্তি টানেন।
জমির খাঁ ভয়ানক একা হয়ে পড়েছে। অহর্নিশি ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত একটি লাশের ছায়া চোখে ভাসে। নিজেকেই প্রশ্ন করে-লাশটি কার? ভুল করে দুপুর রাতে ডোবাটার নিকটে ছুটে যায়। সেখানে যেন একটা বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে। জানাজা হয়নি। কবর হয়নি। লাশটাকে ঘিরে এক ঝাঁক শকুনের উল্লাস। শকুনের শরীরের কদর্য কালিমায়, বক্র ঠোঁটে, কুটিল চোখে, তীক্ষè নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করছে লাশটাকে। নিজের শরীরে লাশের গন্ধ। অসংখ্য লাশ ডোবাটার ভিতর থেকে যেন উঠে আসছে। যুবতীদের লাশ! তাড়া করছে কাউকে। ভয় পেল জমির খাঁ। প্রাণভয়ে দৌড় দিল। অসংখ্য যুবতী চিৎকার করতে করতে ডোবাটা থেকে উঠে আসতে লাগল। ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাল নিশানা। যুবতীদের চেহারা বীভৎস। কারো স্তন নেই, কারো স্তন থ্যাতলানো, কারো চোখ বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে, কারো বুকে-পিঠে নখ-দাঁতের দাগ কাটা, কারো আবার যৌনাঙ্গ ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে! পূব আকাশে নতুন একটি লাল সূর্য উঠেছে। সকালের লাল রোদ গহরডাঙ্গার ঘরে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উন্মত্ত শকুনের দল চিৎকার করতে করতে খোলা মাঠ দিয়ে উড়ে এসে ডোবাটার পাড়েই নামছে। (পৃ. ৩০)
‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ এবং ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ গল্প দুটির আখ্যানও যুদ্ধাপরাধীর বিচারকেন্দ্রিক। শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নয়, তৃণমূলের মানুষের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে ব্যাপক আশা ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ সোচ্চার হয়ে উঠেছে গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে। এছাড়া ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পের বিষয় যুদ্ধাহত এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার করুণ কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল ও আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গঠিত সরকার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রহম আলিকে পুরস্কার ও সংবর্ধনা দেবার প্রস্তুতি নিলে সে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। সে কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল স্মৃতি ভুলতে পারে না। রাজাকার ছানা মিয়ার ক্ষমতা আর দাপটের কাছে চরম অসহায় মুক্তিযোদ্ধা রহম আলী। তার মর্মযন্ত্রণা মারাত্মক। দারিদ্র্যলাঞ্জিত জীবনে সুখের প্রলোভনে স্ত্রী জরিনা সুখের স্বপ্ন দেখলে রহম আলী তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে : রহম আলি বউয়ের লোভাতুর চকচকে চোখে তেত্রিশ বছরের পোড় খাওয়া জরিনাকে খোঁজে। আচমকা জখম বাঘের মতো হুংকার দিয়ে ওঠে-আমারে হাত পেতে ভিক্ষা লইবার কইলি? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? অ্যা! কথা কইস না কেরে? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? তুই না মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির বউ। তুই এতো নীচ! এতো লোভ ভিত্রে তোর! ছি জরিনা! ছি! রহম আলি এলোপাতাড়িভাবে থুথু ছিটাতে লাগল জরিনার স্বপ্নকাতর চোখে-মুখে। (পৃ. ১২৫)
চন্দন আনোয়ারের বেশ কয়েকটি গল্পের বিষয় বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, কলুষতা, দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতার অসুস্থ লড়াই. হরতাল, সন্ত্রাস। ‘মা ও ককটেল বালকেরা’ গল্পে হরতালের আগের দিন পাবলিক গাড়ি ও মানুষ পুড়িয়ে মানুষের ত্রাস-আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকার বিরোধীরা। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অন্যতম শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি হরতাল। আমাদের দেশে হয় তার উল্টো। ভাড়াটে কর্মী দিয়ে ককেটল নিক্ষেপ, মাস্তান দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও ধরো-মারো, ভাঙো-কাটো হচ্ছে হরতালের চারিত্র্য লক্ষণ। ফলে বিরোধী দল হরতাল ডাকলেই শান্তিপূর্ণ মানুষ উদ্বিগ্ন হয়। ‘শহর জুড়ে থমথম করছে একটা আতঙ্ক। বিকেলে গোটা দশেক গাড়ি পুড়িয়ে এই আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। মনুষ্য পরিত্যক্ত ফাঁকা রোডে কিছু ভদ্র কুকুর আর থেমে থেমে আসা পুলিসের হিংস্র গাড়ি‘গুলোর রাজত্ব চলছে।’ (পৃ. ৩১) সেই পোড়াগাড়ির পার্টসপত্র চুরির উদ্দেশ্যে গভীর রাতে জনশূন্য রাজপথ ধরে হাঁটে তিন বখাটে বালক। এই বালকেরা একটি পোড়া গাড়ি থেকে একটি মানুষের মাথা আবিষ্কার করে। অর্থাৎ গান পাউডার দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে দেবার সময় মানুষও পুড়ে মরেছে। এই বখাটেরাই দিনের বেলায় নেতার টাকার বিনিময়ে পিকটিং করে, ককটেল ছোঁড়ে। এক রাজনৈতিক নেতা পিতৃহীন এক দরিদ্র বালকের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে কিভাবে সন্ত্রাসী বানিয়েছে ‘করোটির ছাদে গুলি’ গল্পে তাই দেখি। বিধবা মা’র শত আহাজারীতেও ছেলেকে ঠেকানো যায়নি, ‘-মোকাদ্দেস আলি! ও মোকাদ্দেস আলি! বাপ তুই মিছিলে যাইস না রে! আমার কোলটা খালি করিস না রে! বাপ! ও বাপ! তোর পা টা ধরি, তোর মরা বাপের কিরা দিছি! বুকের দুধের কিরা দিলাম!’ (পৃ. ৩৮) ঠিকই নেতার কাছে থেকে টাকা নিয়ে অস্ত্র নিয়ে তারা অপকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গল্পকার চন্দন আনোয়ার সুকৌশলে রাজনীতির কদর্যচিত্র, নেতাদের মুখোশ উন্মোচন এবং মা’দের চিরন্তন সন্তান প্রীতির পরিচয় তুলে ধরেন।
চন্দন আনোয়ারন তাঁর গল্পে তরুণ সমাজের সদর্থক অবদানকে শিল্পরূপ দিলেও তাদের নৈতিক অবক্ষয়কে উপেক্ষা করেননি। উঠতি বয়সের নবীন নেতাদের নারীলিপ্সার গোপন ভয়াবহ চিত্র ‘গিরগিটি ও একজন মেয়ে’ গল্পে বিধৃত। গিরগিটি দেখলে অনেকেই আতঙ্কিত হয়। সুন্দরী তরুণী যখন লম্পট নেতাদের ভোগের শিকার হয়, তখন সে সভ্য মানবিক পুরুষকে দেখলেও ভয়ে কুঁকড়ে যায়। দিনের আলোয় শান্তির পক্ষে সন্ত্রাসের বিপক্ষে স্লোগান দেয় যে ছাত্রনেতারা, রাতের আঁধারে তারাই আবার নেশাগ্রস্ত হয়ে পালাক্রমে এক যুবতীর সর্বনাশ করে। গল্পে ধর্ষিতা মেয়েটি বর্তমান বাংলাদেশের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ঘটনাক্রমে ধর্ষণের ঘটনাটির স্বাক্ষী হয় হাজি বাড়ির ছেলে জামাল। মেয়েটিকে কোন প্রকারে উদ্ধার করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসে। জানালার শিক ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল মেয়েটা। জামাল কিছু বলার সাহস পেল না। কী বলবে তাই-ই খুঁজে পেল না। ওরাই দেশের ভবিষ্যত নেতা! একদিন সংসদ কাঁপাবে। ওদের গাড়িতেই লাল সবুজের পতাকা পত্পত্ করে উড়বে! স্বাধীনতার ঝকমকে সোনালি ফসল ওদের ভোগ দখলে যাবে! অলরেডি পেতে শুরু করেছে! ভবিষ্যত মন্ত্রী-এমপিদের এই কুৎসিত রূপ কোনদিনই মানুষ জানবে না! শকুনের মতো খাবলে খেল মেয়েটাকে! ওরকম কত মেয়ে ওদের ক্ষুধা চরিতার্থ করতে অন্ধকারে এইভাবে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে কে জানে! পত্র-পত্রিকায় আর কয়টা আসে। সকালে এরাই মিছিল বের করবে- শিক্ষা-সন্ত্রাস এক সাথে চলবে না! পিস্তলÑকলম একসাথে চলে না! বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তর, একাত্তর, নব্বই-ওরা কারা আর এরা কারা? এত পতন! এত পচন! কারা করল এত বড় ক্ষতি? দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মেয়েটা কোথায় দাঁড়াবে ? (পৃ. ৬২)
হাজি বাড়ির একমাত্র ছেলে জামালকে নিয়ে বাবা- মায়ের বড় শখ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাজরানী বউ ঘরে আনবে। কিন্তু সে সুখ-স্বপ্ন বিফলে যায়। জামাল এই ধর্ষিতা মেয়েকে নিয়ে ঘরে ওঠে। সম্ভ্রম হারিয়ে আতঙ্কিত মেয়েটি জামালকেও আর বিশ্বাস করে না। যদিও জামাাল বলে, ‘ বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে ভয়ানক শব্দ করে চিৎকার করে- আমাকে বিশ্বাস কর! আমি ওদের মতো হিংস্র নই! আমি ওদের মতো শকুন নই! আমি ওদের মতো কুকুর নই! আমি মানুষ! আমি মানুষ!! (পৃ. ৬৩) কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। মেয়েটি করুণার চোখে জামালের দিকে চেয়ে ওড়নাটাকে একগোছা দড়ির মতো হাতের মধ্যে প্যাঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গল্পকার চন্দন আনোয়ার জানান, এই দেশ-সমাজ মেয়েটিকে বাঁচেত দেয়নি।
ক্ষমতার রাজনীতির অস্থিরতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সহনশীলনতার অভাব, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাটের কারণে তৃণমূলের মানুষের মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতা বিরাজ করে। ‘একটি পুকুর মরে যাচ্ছে’ গল্পে স্বামীর একটি পুকুরকে নিয়ে দুই স্ত্রীর ক্ষমতার লড়াই আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা লড়াইকে প্রতীকী করার হয়েছে। ‘কতিপয় অনাথ শিশু’ গল্পে ক্রশফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে লেখকের অবস্থান। আবার ‘মৃত্যু অথবা ঘুম’ গল্পটি অত্যন্ত করুণ। প্রাইভেট পড়তে গিয়ে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত অধ্যাপক ও মুক্তিযোদ্ধা আহমদ জামিলের ছেলে স্বাধীন। ছেলেকে বড় ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখা স্বাধীনতার এই স্বপ্নপুরুষ ও মানুষ গড়ার কারিগর একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ট্রাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি। লাশ আছে মর্গে। ছেলের মৃত্যুর সংবাদের মা মূর্চা গেলে অধ্যাপক জামিল আরও বিপদে পড়ে যায় । হার্টের রোগী জামিল স্বপ্নহারা, বুকভাঙা, বিপর্যস্তÑমৃতপ্রায় অথবা চিরনিদ্রায় বিলীন।
শেকড় কেটে দিলে গাছ যেমন আলগোছে পড়ে যায়, কোন সাড়াশব্দ না করে মিসেস জামিল ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন তেমনি। অধ্যাপক জামিল অন্ধকারের ধকল কাটিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার ছেলে এখন মর্গে। মরা-থেতলানো ইঁদুরের মতো মুখগুঁজে পড়ে আছে। তুমি হাত-পা ছেড়ে মরা চিতল মাছের মতো চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লে! আমার শরীরেও তো মরণের মতো ক্লান্তি। নয় মাসের যুদ্ধের ক্লান্তি তো গেল-ই না! আমি কি এখন তোমার পাশে ঘুমুবো? বুকের ভিতরে নিশ্বাস আটকে গেল মনে হয়। অধ্যাপক জামিল কোন কর্তব্য পালন করবেন? (পৃ. ৪৯)
‘মৃত্যু অথবা ঘুম’ গল্পের মতোই মর্মান্তিক কাহিনি ‘অমৃত্যু শ্বাসকষ্ট’ গল্পে। একমাত্র কন্যাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্নে বিভোর মা-বাবার দীর্ঘদিনের শ্রম-স্বপ্ন-সাধনা ব্যর্থ হয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কারণে। এক শ্রেণির অসাধু সরকারি অফিসারের কারণে প্রশ্ন ফাঁস হয়। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না। নারীর নির্যাতন ও নারীর মনস্তত্ত্ব শিল্পায়নে চন্দন আনোয়ারন একজন পরিণত লেখকের মতোই দক্ষ। ‘বাড়ন্ত বালিকার ঘর-সংসার’ গল্পে শাহিদার পরিণতিও করুণ। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে- মেয়েদের নানারকম শারীরিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কখনো মনের গভীরে অজানা ভয়ও বাসা বাঁধে। শাহিদা তার শরীরের পরিবর্তন দেখে কৌতূহল আর আনন্দে নাচতে থাকে। বাইরে ছুটে যাবার জন্য অস্থির হয়। এটি তার বাবা-মা পছন্দ করে না। বিশেষ করে বাবা মনে করে মেয়ে সেয়ানা হয়েছে। মা- মেয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক কালো বীভৎস মহিষের মতো পেশিবহু দীর্ঘদেহী মানুষের সাথে শাহিদার বিয়ে দেয়। বিয়ের রাতেই শাহিদা ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করেÑÑমা উদ্বিগ্ন, বাবা নীরব, বিমূঢ়। মহিষতুল্য পাষণ্ড লোকটি যৌনতাণ্ডবে মত্ত।
রমিজা খাতুনের কলিজা ফাটিয়ে শাহিদা চেঁচিয়ে উঠল, মাগে! হামাক বাঁচা! মাগে হামাকে বাঁচা! ভূইষ! ভূইষ! ভূইষ! ছালামত এগিয়ে আসে। মারে, হাঁকে মাপ কইরা দে! হামি তোকে মাইরা ফেলেছি! মাগে হামার প্যাট ফাইটা গেছে! মাগে হামার প্যাট কাট্যা ফেলছে! মাগে হামার প্যাটে ছুরি ঢুকাইছে! ও মাগে! ও মাগে! ও মাগে! শাহিদা চরম নীরব হয়ে মাথা ফেলে দিল। (পৃ. ৭৮)
স্ত্রীর মৃত্যুর বছর না পেরুতেই বৃদ্ধ আজহারউদ্দিনের দ্বিতীয় বিয়ে ও তার পরণতি নিয়ে রচিত গল্প ‘বীজীপুরুষ’। বৃদ্ধের ছেলেমেয়েরা কেউ বাবার বিয়ের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধের বিয়ে হয় এক সুন্দরী তরুণীর সাথে। বৃদ্ধের শরীরে কুলোয় না। ব্যর্থ চেষ্টায় হাসপাস করে। নতুন বউ খলখল করে হাসে। পাশের ঘরে কলেজ পড়ুয়া নাতি অনন্ত সব শোনে, অনুভব করে। দাদি-নাতির মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। বছর খানেক বিছনায় অথর্ব হয়ে পড়ে থেকে শেষে বৃদ্ধ মারা গেলে বৃদ্ধের সন্তানরা জমিজমা-সম্পদের ভাগবাটোয়ারার হিসেব কষতে বসে। এ সময় : ‘ শুনতে পেল উঠোনের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ওয়াক্ ওয়াক্ শব্দের ঝড় তুলছে সদ্য বিধবা। প্রথমে শরফুদ্দিন ঘর থেকে বের হয়। তারপর আজহার উদ্দিনের দুই ছেলে, মেয়েরা, ছেলের বউরা একে একে সবাই এসে গোল হয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেল সদ্য বিধবাকে ঘিরে। শরফুদ্দিনকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে জায়গা করে নিয়ে সেই বৃত্তের ভেতরে প্রবেশ করল অনন্ত।’ (পৃ. ৮৬)। নাতি অনন্ত বিষয়ক শেষ বাক্যটি সংযুক্ত করে গল্পকার সদ্য বিধবা দাদি-নাতির সম্পর্ককে গভীর ব্যঞ্জনায় রঞ্জিত করেন, তাতে গল্পের গভীরতা বৃদ্ধি পায় বহুগুণ।
‘পিৃতত্ব ও তিনটি চিৎকার’ গল্পটি প্রথম পুরুষে লেখা। পিতৃত্বের স্বাদ পেতে চায় না এমন পুরুষ বিরল। এক কলেজ শিক্ষক, বিবাহিত, অথচ নিঃসন্তান। বহুরকম চিকিৎসা শেষে এসেছে অবিবাহিতা আয়ুর্বেদিক ডাক্তারের কাছে। পারিবারিক চাপ থাকলেও বিয়ের পিড়িয়ে বসতে আগ্রহী নন ডাক্তার। কলেজ শিক্ষক একদিন ডাক্তারের বাড়িতে যায় এবং নির্জন বাড়িতে একাকী পেয়ে ডাক্তারকে ধর্ষণ করে। কদিন পরেই পারবারিক ইচ্ছায় এক ব্যাংকারের সঙ্গে বিয়ে হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই গর্ভবতী হয়। সন্তান লাভে বাড়ির সবাই আনন্দিত। দাদি নাতি নিয়ে মেতে থাকে। ছেলের বাবা ব্যাংক ফেলে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও সন্তানকে দেখতে ছুটে আসে। ডাক্তার মা-দাদি মেলাতে চেষ্টা করে সন্তান দেখতে কার মতো হয়েছে। সন্তান-বাবা ঘুমালে ডাক্তার মিলিয়ে দেখে সন্তান হয়েছে কলেজ শিক্ষকের মতো। তার ভয় হয় কবে কখন কার কাছেধরা পড়ে। আরও ভয় হয়, ছেলে বড় হলে রক্তের টানে আসল বাবাকে খুঁজবে না তো? একদিন ছুটির দিন বাবা ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করার মুহূর্তে, “ হঠাৎ বাবু মুখ ফুটে ডেকে ওঠে, আব্বু! মানুষটা শান্ত সকাল কাঁপিয়ে বিকট চিৎকার করে ওঠেÑআমার বাবু আব্বু ডাকছে! আব্বু! সাথে সাথে আর একটি বিকট চিৎকার বেরিয়ে আসে আমার বুকের দেওয়াল ফেটে- হায় আল্লা রে!’ (পৃ. ৯৫)
নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে, অপ্রত্যাশিত যৌনকর্ম, গর্ভধারণ ও নারীর অধিকার নিয়ে চন্দন আনোয়ারের দুটি গল্প ‘নিজের দিকে দেখি’ ও ‘আমি কেউ নই’। ‘নিজের দিকে দেখি’ গল্পে মেধাবী মাস্টার্স পরীক্ষার্থী সেঁজুতির নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে হয় ব্যাংকার চয়নে সাথে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তুলে নেবার আগেই বিশেষ আবেগের মুহূর্তে মেসের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয় দুজন। সেঁজুতি সন্তানসম্ভাবা হয়। সেঁজুতির সব সুখস্বপ্ন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবে, বড় ডিগ্রি নেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে, যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বামীর ঘরে উঠবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সে সিদ্ধান্ত নেয় এ্যাবরশন করবে। কিন্তু নিজের মা ও স্বামী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বহু অনুরোধ, অনুনয়-বিনয়, কান্নাকাটি করেও যখন স্বামী চয়নের সম্মতি আদায় করতে পারে না। বরং স্বামী যখন বলে, ‘আমি তো একটা বেটার সার্ভিস করছি। এই সামান্য বিষয় নিয়ে এতো টেনশন করছো কেন?’ (পৃ. ১৯৬) তখন সেঁজুতি চরম আত্মঅবমাননায় ভোগে। নারীত্বের ও ব্যক্তিত্বের এই অবমাননার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবশেষে কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, ‘চূড়ান্ত অবহেলা আর মর্মান্তিক অপমানের সুতীব্র যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বিনিদ্র রাত কাটিয়ে ঠিক সূর্যোদয়ের মুহূর্তে সেঁজুতি এই চরম ও অলঙ্ঘনীয় সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছল যে, সে মা হবে এবং চয়নকে ডির্ভোস দেবে।’ (পৃ. ১৯৬) পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেকটি মানুষ যে পুঁজির দাস, বিশেষ করে নারী তো বটেই, এই সত্য পরিস্ফুটিত হয়েছে ‘আমি কেউ নই’ গল্পে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী উচ্চ মাধ্যমিক পাস স্ত্রীর উপরে পুঁজিদাতা বড় ব্যবসায়ী আড়তদারের দৃষ্টি পড়লে নারীটির উপলব্ধি ঘটে, সে আসলে পুতুল মাত্র। যার পুঁজি আছে, অস্ত্র-ক্ষমতা আছে তারই পৃথিবীটা। রাষ্ট্রের জনগণের দোহাই দিয়ে বিপুল পরিমাণের ঋণ আসে, সেই ঋণের ঋণীও আবার জনগণ, কিন্তু সেই ঋণ ভাগবাটোয়ারা করে নেয় মুষ্ঠিমেয় কিছু ক্ষমতাবান। নারীটি যখন অস্বীকৃতি জানায়, ‘ আমি কিছুতেই এই ঋণ মানি না। আমি এক পয়সাও দিবও না।’ তখ আড়তদার বুঝিয়েছে, ‘তুমি তো তুমি। এই মুহূর্তে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হল, নাড়ি ছেঁড়া হয়নি, ঠিক মতো চিৎকারটিও দেবার সময় পায়নি, সেও ঋণী। যে মানুষটি এই মুহূর্তে শেষ নিশ্বাস ফেলেছে, আর ফিরে আসবে না কোনদিন, সেও একগাদা ঋণ নিয়েই গেল।’ (পৃ.১০৩ ) আড়তদার গ্রামের এই বধূকে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির মারপ্যাচের পাঠ দিলে সে দিশেহারা হয়ে ওঠে। দুনিয়া জুড়েই যুদ্ধ চলেছে।
তার মতে, আমরা নাকি যুদ্ধের মধ্যেই আছি! কি সাংঘাতিক কথা-আমাদের বাড়ির থুড়থুড়ে বৃদ্ধা জহুরা বেওয়া অর্থাৎ আমার শাশুড়ি, সেও নাকি এই যুদ্ধেই আছে? তা সে কিসের যুদ্ধ? যুদ্ধের জন্য ঢাল-তলোয়ার কই? অস্ত্র-গোলাবারুদ কামান কোথায়? সৈন্য-সামন্ত তো কিছুই চোখে দেখি না। যুদ্ধটা কিসের? কার বিরুদ্ধে? কে কার শত্রু?
আমাদের স্কুলের মিয়ারুদ্দি মাস্টারের মতো সবজান্তার হাসি দিয়ে মানুষটা বলে, হিটলার, মুসোলিনির নাম শুনেছো?
আমি ঘাড় বাঁকিয়ে অসম্মতি জানালাম, না, শুনিনি।
বুশ-সাদ্দামের নাম শুনেছো? অ আ ক খ শিখাতে লাগলেন কেন?
উসামা বিন লাদেনের নাম শুনেছো?
ও ব্যাটা কি আমার বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের কেউ হয়, নাকি স্বামীকুলের কেউ হয়, যে নাম আমার জানতেই হবে। প্যাঁচাল ছেড়ে সোজা লাইনে আসেন। বুশ-সাদ্দাম যুদ্ধ করে, তেলের দাম বাড়ে এই দেশে, কথা ঠিক?
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম, ঠিক।
টুইন টাওয়ার কোথায় আর কোথায় বা বাংলাদেশ-এই জন্যে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে লালবাতি জ্বলে। সর্বস্বান্ত মানুষরা বুকে থাপ্পড় মেরে গলায় ফাঁস নেয়। গার্মেন্টেসে শ্রমিক ছাটাই হয়। কেন?
আমি তখন সম্মতি জানিয়ে বলেছিলাম, এই কথাটি সত্য বলেছেন। সে বছর আমাদের গ্রামের বিশ-বাইশজন মেয়েমানুষ বাড়ি ফিরে সে কি কান্না! ওদের গার্মেন্টস নাকি বন্ধ করে দিয়েছে মালিক। কোথায় নাকি কোন মুসলমান বদমায়েশ বুশের দেশের বিল্ডিং ভেঙে ছাতু বানিয়ে ফেলেছে, হাজারে হাজারে মানুষ মারা পড়েছে, এই কারণে।
তাহলে এবার বলো, দুনিয়াটার একটা শিকড় আছে। সেখানে কোপ পড়লে গাছের মতো সারা দুনিয়া নড়ে ওঠে। (পৃ. ১০৪-১০৫)
চন্দন আনোয়ারের ‘রুগ্ণতার গলি-ঘুপচি’, ‘বারবনিতা এসোসিয়েশন’, ‘আদিম কাব্যকার’ ‘পাঁচ শ টাকার নোট’ ‘পল্লিবালিকার সুখ-শাস্তি,’ ‘কাফন চোর’, ‘অন্তর্গত শূন্যতা’ গল্পগুলোতে সামাজিক অবক্ষয়, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্ট শ্রেণিবৈষম্য, পতিতাবৃত্তি, অবদমিত যৌনবিকৃতি ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় উঠে এসেছে।
সাতচল্লিশের দেশভাগের রাজনীতির শিকার হয়ে যারা জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন এবং যারা শত নিপীড়ন ও আতঙ্কের মধ্যেও সংখ্যালঘু হয়ে দেশে রয়ে গিয়েছেন, তাদের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার অপূর্ব রূপায়ণ ঘটেছে চন্দন আনোয়ারের ‘অনিরুদ্ধ টান’, ‘ইচ্ছামৃত্যু’ ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’ গল্প তিনটির বিষয়-বিন্যাসে।
চন্দন আনোয়ারের গল্পের চলমান ভাষার সাথে যুক্ত হয় উপমা-তুলনা। যেমন, ‘খড়ের মতো অগোছালো চুল’, ‘দূর্বা ঘাসের মতো ছাট করা ঘন দাড়ি’, ‘পানবুড়ির দাঁতের মতো ইট’, ‘সুনামীর মতো অন্ধকার ছুটে আসে চারদিক থেকে’, ‘ পটকা মাছের পেটের মতো ফর্সা গাল’। এরূপ অসংখ্যা উপমার মতো তিনি গল্পের চরিত্রের মুখে তুলে দেন অসংখ্য গালি এবং ভিনদেশি শব্দ। দু-চারটি গালির উদাহারণ, ‘শালার চুদনার ব্যাটা’, ‘লাত্থি মারি তোর মুখে’, ‘পেচ্ছাব করি তোর সংসারের মুখে’. ‘মাদার চোদ, কাকে বলিস ভাড়াটে দালাল’, ‘হারামি মাগী কুণ্ঠেকার’ এরমক অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। আর ভিনদেশি শব্দ, বিশেষ করে ইংরেজি শব্দ প্রয়োগÑইমোশনালি ব্লাকমেইল, গোল্ডেন চান্স, বাউন্ডারি, ইনকামের শর্টকার্ট, অপজিশন ইত্যাদি। এসব উপমা-গালি বা ভিনদেশি শব্দ ঘটনাধারা কিংবা চরিত্রের ওপর আরোপিত নয়, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সার্থক সংযোজন। তবে এসব গল্প বাদ দিলেও গল্পের কোন ক্ষতি হতো না। প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষা নির্মাণে চন্দন আনোয়ার বেশ পরিশীলিত এবং গল্পের চিত্রকল্প তৈরিতে সিদ্ধহস্ত।
১. বোশেখের প্রথম সকালে লালচে রোদ উঠেছে। দুপুর হতেই মগজধোয়া আগুনরোদ কাউকেই ঘর হতে বেরুতে দেয় নি। সূর্য পশ্চিম আকাশে গা হেলিয়ে যে-ই না আয়েশ করতে গেল, তখনি লাটিমের মতো ঘুরে ঘুরে বাতাস কুণ্ডলি পাকাতে শুরু করেছে ঝাউতলি বিলের মধ্যিখানে। মুহূর্তেই সাঁই সাঁই শব্দ তুলে কালোঝড় উঠে আসছে লোকালয়ে। অন্ধকার দ্রৌপদীর শাড়ির মতো পেঁচিয়ে ধরছে আকাশের দিগম্বর শরীর।
২. শাকুর মাথায় চাটি মেরে আইনা বলে-মানুষ পিডানোর মজা রে বোকাচোদা! দুনিয়ার সেরা মজাডাই তো মানুষ পিডানির মজা! দেহিস না শালারা খুন দেওয়ানা অইয়া মানুষ পিডায়! মানুষের চিক্কুর হুনলে নাকি রক্তে নেশা বাড়ে! দেহিস না, মানুষ যতো চিক্কুর পারে ততো বেশি পিডায়! মা-বইন মানে না! গরু-ছাগলের মতো পিডায়া লাশ বানায়া লা! রাস্তার মইদ্যে পিডা! কাপড় খুইল্লা ন্যাংটা কইরা পিডা! হালাগো মুখের ভাষা হুনিস না, পশু-পাখিও শরমে পালা! শালারা মাইনষের মইদ্যেই পড়ে না!
চন্দন আনোয়ারের গল্প একবার পড়লে পুনর্পাঠের আকাক্সক্ষা শেষ হয়ে যায় না। বারবার পড়ার যোগ্য তাঁর গল্প। তবে ‘নির্বাচিত ৩০’ গ্রন্থের ৩০টি গল্পই যে সমমানসম্মত তা নয়। তথাপি বলতেই হয়, তাঁর সাফল্যের শুরু যেন বিফলে না যায়। পাঠক হিসেবে প্রত্যাশা রাখি, চন্দনের হাতে যেন অধিক গুণমানসমৃদ্ধ আরও গল্প পাই-যা বাংলা গল্প সাহিত্যের দিক-দিগন্তকে করবে প্রসারিত।
* ড. মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অধ্যক্ষ (অব), ক্যাডেট কলেজ।
আপনার মতামত লিখুন :