kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটি সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব


কালচিত্র | ড. শ্যামল কান্তি দত্ত* প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২০, ০২:১২ এএম সিলেটি সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব

কোনো অঞ্চলের সংস্কৃতির অন্যতম দৃশ্যমান উপাদান ভাষা। অন্যদিকে ভাষা সংস্কৃতির প্রধান ধারকও বটে। কাজেই বাংলার সংস্কৃতি থেকে সিলেটের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে এর উপভাষায়। ইন্দোইউরোপীয় ভাষাবংশের আর্য শাখার ভাষা বাংলা। বাংলাভাষার উপভাষা আলোচনায় গ্রিয়ার্সন, সুনীতিকুমার প্রমুখÑসিলেটের উপভাষাকে বঙ্গ শ্রেণিভুক্ত করলেও সুকুমার সেন ও রামেশ্বর শ’ কামরূপী শ্রেণিভুক্ত দেখিয়েছেন। সিলেটের উপভাষা এক না একাধিক এ নিয়েও বিতর্ক আছে। এ বিতর্কেরও সূত্রপাত গ্রিয়ার্সন হতে। তাঁর মতে, পশ্চিম-সিলেট পূর্ববঙ্গ ঘেঁষা আর পূর্ব-সিলেট বঙ্গীয় বলয় মুক্ত ও বেশি ‘পিকিউলিয়ার’। এই বঙ্গীয় বলয় মুক্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই অনার্য প্রভাব বেশি দৃশ্যমান। বর্তমান সিলেটের মানচিত্রে দেখা যায় এ অঞ্চলটির পশ্চিমে বাংলাভাষী নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা। দক্ষিণে ককবরকভাষী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে অসমিয়া (কামরূপী উপভাষা) ভাষাভাষী আসাম (কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা ) ও উত্তরে খাসি ভাষাভাষী মেঘালয় (খাসিয়া ও জৈন্তীয়া পাহাড়) রাজ্য । অর্থাৎ সিলেটের পূর্ব-পশ্চিমে আর্যভাষা অবস্থান করলেও উত্তর-দক্ষিণে  যথাক্রমে অস্ট্রিক ও চিনা-তিব্বতীয় অনার্যভাষা আজও বিদ্যমান। সিলেটের রাজনৈতিক ইতিহাসেও দেখা যায় বিভিন্ন সময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ত্রিপুরা, অসম, বর্মা কিংবা খাসিয়া রাজ্যসীমানায় তার অবস্থান। আবার প্রতিবেশি রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাত্র, মণিপুরি, কুকি, প্রভৃতি অনার্য জাতিগোষ্ঠী সিলেটে এসে বসবাস করেছে এবং এখানে অনার্য সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে।

জানা মতে, অস্ট্রিক ভাষাবংশই ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষাবংশ। এককথায় এটাই ভারতের আদিম দেশজ ভাষা।  অস্ট্রিক ভাষা ও সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে বাংলা ভাষা ও বাংলার জীবনচর্চাকে। অনুমান করা যায়, আর্য-সংস্কৃতি ভারতের পশ্চিম দিকে প্রবেশ করে মধ্য-ভারত অতিক্রম করে পূর্বে আসতে কয়েক শতক কেটে যায়। সে-সময়ে স্থানীয় অস্ট্রিক ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি আর্য কর্তৃক বিতাড়িত দ্রাবিড় সংস্কৃতি এখানে বিকাশ লাভ করে। অন্যদিকে, মঙ্গোলীয়রা উত্তরপূর্বের পাহাড়ী পথ ধরে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে বঙ্গের উত্তর-পূর্বে এ পাহাড়ী অঞ্চলে স্থায়ী বসবাস গড়ে তুলেছিল। তাই দেখা যায়, সিলেটের উত্তরদিকের খাসিয়া পাহাড়ের অধিবাসী এবং সিলেটে বসবাসরত মঙ্গোলীয় গোত্রের খাসিয়া জনগোষ্ঠী এখনও আর্যসংস্কৃতির লাঙলনির্ভর কৃষিকাজ না করে জুম চাষে এবং মাচাঙে বসবাসে অভ্যস্ত। এখানে উল্লেখ্য, খাসি ভাষা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভারতীয় শাখার অন্তর্গত। সুজিৎ চৌধুরীর মতে: খাসিদের (খাসিয়াদের) ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম ঘটেছে। নৃতাত্ত্বিক ও দেহ বিচারে তারা মোঙ্গলয়েড আর ভাষিক পরিচয়ে অস্ট্রিক। ভারতীয় ভূখ-ের আদিমস্তরে সর্বত্রই অস্ট্রিক ভাষার প্রচলন ছিল। পরের যুগে দ্রাবিড় ও আর্য ভাষা পশ্চিম দিকে এবং ভোট-বর্মি ভাষা (চীনা-তিব্বতি ভাষাপরিবারের তিব্বতি-বর্মি) পূর্ব দিকে অস্ট্রিক ভাষাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে অধিকাংশ জায়গাতেই তাকে গ্রাস করে একেবারে হজম করে ফেলেছে। কথিত আছে, অস্ট্রিক ভাষাভাষী কোলগণ ‘সবর’ নামক দ্রাবিড় জাতির আক্রমণে মগধ হতে পলায়ন করে। ‘সবর’ এখনও উড়িষ্যার সন্নিকটে বর্তমান। এরপর ভারতে আর্য আগমন আরম্ভ হলে পরাজিত ও বিতাড়িত দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়রাও সিলেটে আশ্রয় লাভ করে।

প্রাচীন সাহিত্যের নিষাদরাই যে আদি-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত কোন জাতি, সে-বিষযে কোন সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, প্রতœ-মংগোলয়েড নরগোষ্ঠীর লোকদের হিমালয়ের পাদদেশে এবং আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম প্রভৃতি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। এদের আমরা মংগোল-উদ্ভূত জাতি বলেই অভিহিত করি। মনে হয় বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত ‘কিরাত’ জাতি এই নরগোষ্ঠীভুক্ত। প্রাচীন সিলেট এবং এর পশ্চিম প্রান্তের প্রতিবেশি প্রাচীন বাংলার নিষাদরা অস্ট্রিক-দ্রাবিড় আর কিরাতরা ছিল মঙ্গোল। বাংলার দেশজ মুসলমানরা এবং তথাকথিত নি¤œবর্গের লোকগুলি (তফসিলী) অস্ট্রিক-দ্রাবিড়। আর উচ্চবর্ণের হিন্দুর মধ্যে আলপীয় (আর্য) রক্ত বেশি বলে প-িতগণের ধারণা। অবশ্য সিলেটে ভানুনারয়ণের পুত্রদের মত উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও ইসলামধর্ম গ্রহণ করে। এখানে মুসলমানদের মধ্যেও আলপীয় (আর্য) রক্ত দুর্লক্ষ্য নয়। সিলেটের পূর্ব-প্রান্তের প্রতিবেশি রাজ্যের অধিবাসী অসমীয়া সম্পর্কে বলা হয়: অস্ট্রিক জাতির বংশধর কার্বিসরাই সম্ভবত আসামের আদি অভিবাসী। কিরাতরা (মঙ্গোলীয়) চীনের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ থেকে এসে বসতি গড়ে। একই এলাকায় উভয় জাতির সহাবস্থানের কারণে এদের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটে এবং এ পটভূমিতেই শুরু হয় অসম জাতি বিনির্মাণের প্রক্রিয়া। এর পরই বাংলা থেকে দ্রাবিড় জাতির উত্তরসূরি কৈবর্ত্য ও বানিয়ারা সেখানে অভিবাসিত হয় এবং কমবেশি পারস্পরিক সংমিশ্রণ ঘটায়। ইংরেজ আমলে বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিক এবং বাঙালি মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী চাকুরিজীবী অভিবাসিত হয়। বর্তমান প্রতিবেশি এবং এক কালে আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রেও এগুলো প্রযোজ্য। সুতরাং বলা যায় প্রাচীন সিলেটের অধিবাসীদের জাতি-বিনির্মাণে ধারাবাহিকভাবে অস্ট্রিক, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় ও আর্য (আলপীয়-নর্ডিক) জাতির অবদান অনস্বীকার্য।

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বিষয়ে আজও পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হয়নি। তবে বলা চলে বাঙালির রক্তে শতকরা ষাট ভাগ অস্ট্রেলীয় (ভেড্ডিড), বিশ ভাগ মঙ্গোলীয়, পনেরো ভাগ নেটিগ্রো এবং পাঁচ ভাগ অন্য নানা নরগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে বলে আনুমান করা অসঙ্গত নয়। অবস্থানগত কারণে সিলেটের মানব সমাজে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণ বাংলার তুলনায় আরেকটু অধিক। অবয়ব দেখেও অনায়াসে অনুমান করা যায়: সিলেটের প্রতিবেশি আসামের ‘চুটিয়া’ জাতি, কাছাড়ের ‘কাছাড়ি’ ও ত্রিপুরার পাহাড়িগণ অনার্য জাতি। তাঁদের অবয়ব মঙ্গোলীয়। ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকগণ টিপরা, হাজং, কোচ ইত্যাদি ইন্দো-মঙ্গোলীয়দের সাধারণত বডো নামে অভিহিত করে থাকেন। এ সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও মেনে নিয়েছেন: সমগ্র আসাম এবং উত্তর-পূর্ব বাংলা এককালে বড়োদের বাসভূমি ছিল। এই বডোরা নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে মঙ্গোলীয় হলেও সিলেট অঞ্চলের আদিম অধিবাসী অষ্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়েছে।

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের আগে থেকেই আরবি, ইরানি, তুর্কি, আফগান, মোগল ও আবিসিনীয় বণিকগণ চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যে এসে অভিবাসিত হন এবং বংশবিস্তার ঘটান। এদের মধ্যে ইসলামপূর্ব পারস্যের সুফি-মতবাদ নিয়ে আসা মুসলিম সাধকবৃন্দের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের প্রভাবে এদেশের বর্ণবাদের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত নির্যাতিত হিন্দু-বৌদ্ধগণ সর্বপ্রাণবাদ ও গুরুভক্তির সাযুজ্য দেখে ধর্মান্তরিত মুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্রিয় হয়। শাহজালালের ৩৬০ আউলিয়াসহ সিলেট আগমন (১৩৫৪ খ্রি.) একে আরও বেগবান করে। বণিক-সুফি-সাধক-পীর-আউলিয়া যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ফেলে এসেছিলেন স্বদেশ ইয়েমেন কিংবা অন্যান্য জন্মভূমি। তাঁদের সেমেটিক ভাষার শব্দ, ভঙ্গী, প্রবাদ শুধু নয় ধ্বনিমূল পর্যন্ত এখানে প্রভাব ফেলেছে। এতে সিলেটের ভাষা শুধু নয়, সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনেও এনেছে ব্যতিক্রম ও বৈচিত্র্য।

শাহজালালের সিলেট আগমন সিলেটের সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে কতোটা প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলের সিলেটের কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে’র লেখায়। তিনি লিখেছেন, “এখানে নতুন কালেক্টর এলে তাঁর প্রথম কর্তব্য ছিল এই দরগাহ জিয়ারত করে হজরত শাহজালালের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।” শুধু শাহজালাল নয়, শাহজালালের মাজার এমনকি শাহজালালের মাজারের কবুতরের প্রতিও মানুষের অগাধ বিশ্বাস। এপ্রসঙ্গে ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী লিখেছেন, ‘পূর্ব-বঙ্গের জনসাধারণের বিশ্বাস, যদি কাহারও বাড়িতে জালালী কবুতর আসিয়া বাসা বাঁধে তবে বুঝিতে হইবে তাহার সমৃদ্ধির দিন আসিতেছে। এই বিশ্বাস হিন্দু-মুসলমান জনগণের মধ্যে অদ্যাপি সমান প্রবল। লেখক ব্যক্তিগত জীবনে বহুবার এই বিশ্বাসের সাক্ষাৎ পাইয়াছেন।’ এখনও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করে শাহজালালের মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে।

১৮২৪-১৮২৬ সালে ব্রহ্মযুদ্ধে কাছাড় হতে ফিরে গিয়ে ব্রহ্ম (মায়ানমার) সৈন্য মণিপুর দখল করে। তখন মণিপুর বাসী অনেকে পালিয়ে এসে কাছাড় ও সিলেটে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সিলেটের মণিপুরী রাজবাড়ী এসময়ে নির্মিত হয়েছিল। ১৮৯৭ সালের ভীষণ ভূমিকম্পে এ রাজবাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছে। কাছাড়ের পূর্ব-সীমান্তের মণিপুর রাজ্যের মণিপুরীরা পুষ্পসজ্জা ছাড়াও কপালে তিলক কাটে ও দেহে চন্দন চর্চিত করে। এরা খুব সঙ্গীতপ্রিয়। মণিপুরিদের মধ্যে মোঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্য থাকলেও এরা সুন্দর দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী, এ থেকে অনুমিত হয় এদের সঙ্গে কোনো এক সময়ে ইন্দো-ভূমধ্য নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত কোনো নৃজাতিরূপের জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে। ভাষাগত দিক থেকে মণিপুরি জাতি দুই ভাগে বিভক্তÑ মৈতেয় মণিপুরি ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। মৈতেয় মণিপুরি-ভাষা আসাম-বর্মি উপশাখার কুকি-চিন গোষ্ঠীর অন্তর্গত। অন্য দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি-ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত বাংলা ও অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাদের এসব বৈশিষ্ট্য সিলেটের সংস্কৃতি ও সমাজ-জীবনকে প্রভাবিত করে। ১৯০১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী সিলেটে মণিপুরীর সংখ্যা ছিল ১৬০৪৩ জন।

১৮৫৮ সালে সিলেটে চা-আবাদ শুরু হলে ভারতের তামিলনাড়–, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে প্রচুর জনগোষ্ঠীকে চা-বাগানের শ্রমিক বা কুলী হিসেবে সিলেটে অভিবাসিত করা হয়। ১৯০১ সালে এসে শুধু সিলেট জেলায় চালানী কুলীর সংখ্যা ছিল ১৫৩৮৫০ জন। তৎকালীন মোট জনসংখ্যার প্রায় ০৭% ভাগ বিভিন্ন ভাষাভাষী এ বিরাট জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে এসে এখানকার ভাষা ও সামাজ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। এসব কুলী-কামিনরা সিলেটে উড়িয়া নামে পরিচিত। হিন্দি, বাংলা এবং তাদের নিজস্ব (বিভিন্ন আদিবাসী ও পেশাগত) রূপমূলের মিশ্রণে সৃষ্ট তাদের বর্তমান ভাষা স্থানীয়দের কাছে ‘দেশোয়ালি’ নামে পরিচিত। নৃগোষ্ঠী হিসেবে সিলেটের চা-শ্রমিকরা উড়িয়া, র‌্যালি, কল, গড় ও মীর্দা প্রভৃতি বলে গবেষকগণ মনে করেন। এদের চেহারায় আদি-অস্ট্রাল জাতির দেহ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বর্তমানে চা-বাগানে কর্মরত নারী, পুরুষ, শিশু ও অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬৭২২, ৩৮৭৭৭, ১০০৫৩ ও ১৭৭৪২ জন। অবশ্য তামিলনাড়– রাজ্য থেকে সিলেটে আসা তামিল চা শ্রমিকদের তামিল ভাষাÑদ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। এছাড়াও সিলেটের চা-বাগানে অল্প কিছু ওরাওঁ বাস করে। এদের কুডুখ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা। কুডুখ দ্রাবিড়ীয় ভাষাÑবংশের সদস্য। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে ওরাওঁদেরকে দ্রাবিড় বা প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে।

 

এ ছাড়াও কয়লা ও চুনা পাথর ব্যবসার সাথে স¤পৃক্ত সর্বপ্রাণবাদী পাত্র সম্প্রদায়ের একটি ছোট আদিবাসী জনগোষ্ঠী সিলেট শহরের নিকটবর্তী এলাকায় বাস করছেন।  এরা খাসিয়া জাতি হতে পৃথক নয়। ১৮২৮ সালের ভূসংস্থানিক জরিপ বিবরণীতে সিলেটে মণিপুরী খাসিয়া ছাড়াও নাগা, লুসাই, কুকী, টিপরা প্রভৃতি বহুবিধ আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিশ শতকের শুরুতেও দেখা যায় সিলেটে হিন্দু ও মুসলমান ব্যতীত অন্যান্য জাতিও আছে, তন্মধ্যে খাসিয়া, নাগা ও কুকি বহুল। খাসিয়া ও নাগাগণ জৈন্তা পরগণায় এবং কুকিগণ লংলা ও প্রতাপ গড়ের পাহাড়ে বাস করে। অবশ্য সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব আদিবাসী সম্প্রদায়ের সিলেটে অভিবাসন অনিবার্য হয়ে উঠলেও নাগা ও কুকী সম্প্রদায়কে পরবর্তী কালে আর সিলেটে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়নি। ১৯০১ সালের আদমশুমারীতে সিলেটের মোট জনসংখ্যা ২২৪৯৮৪৮ জন। এর মধ্যে হিন্দু ১০৪৯২৪৮ জন, মুসলিম ১১৮০৩২৪ জন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ১২২৭৬ জন। এ হিসেবে বিশ শতকের শুরুতেই সিলেট মুসলিমপ্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যে তখন কুকি ৩৬১ জন, খাসিয়া ৩০৮৩ জন, গারো ৭৫৬ জন, টিপরা ৮২৬১ জন সিলেটের অধিবাসী।

বর্ণিত আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হচ্ছে টিপরা (মণিপুরী ও কুলি ব্যতীত)। টিপরা এবং ত্রিপুরা একই জনগোষ্ঠী। শ্রীমঙ্গলের টিপরা পাড়ার মেয়েরা বর্তমানে বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানেও আদিবাসী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। হবিগঞ্জের সাতছড়ি সীমান্ত অঞ্চলের টিপরা পল্লীগুলোতেও কিছু সংখ্যক ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাসস্থান আজও বিদ্যমান। এরা সিলেটি উপভাষা ব্যবহার করতে পারলেও তাদের নিজস্ব ‘ককবরক’ ভাষা রয়েছে। ককবরক ভাষা তিব্বতি-বর্মি পরিবারের ‘বডো’ ভাষার অন্তর্গত। বাংলাদেশে ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী প্রায় দশলক্ষ ত্রিপুরা বর্তমানে ককবরক ভাষায় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী-শাসিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক ভাষা প্রচলিত ছিল। ফলে সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতিতে এদের প্রবল প্রভাব রয়েছে। হিঙ্গাজিয়া, ঘুঙ, খাসিয়া, কুলাউড়া, লাতু, লাউতা ইত্যাদি স্থানের নাম এই ককবরক ভাষার প্রভাবজাত। ককবরক ভাষায় সুরের প্রাধান্য সিলেটের উপভাষাতেও বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর মন্তব্য স্মরণীয়: ‘আমার বিশ্বাস সিলেটী ঃড়হধষ ষধহমঁধমব; আমার জানামতে ইন্দোজার্মেনিক আর কোনো ভাষাতে এ ধরনের ঃড়হধষ রহভষঁবহপব নেই। শুনেছি টিবেটো-বর্মন, চীনা ভাষা ঃড়হধষ. খুব সম্ভব সিলেটীর উপর এই ঃড়হধষ রহভষঁবহপব নিকটবর্তী পাহাড় অঞ্চলের টিবেটো বর্মন থেকে এসেছে। ককবরক ভাষায় যেমন ধ যরময ধহফ ধ ষড়ি ঃড়হব এর পার্থক্য নির্দেশে াড়বিষ এর সাথে / য / সংযুক্ত করে যরময ঃড়হব দেখানো হয়। সিলেটের উপভাষায়ও এ পার্থক্য দৃশ্যমান হয়। যেমন: আ’ত [ ধħ:ঃ ] (হাত),  হাত [ যধ:ঃ ] (সাত)Ñহাত টেকা জেবঅ থইয়া কয় তার আ’ত খালি (সাত টাকা পকেটে রেখে বলে তার হাত খালি)। কিংবা, আ’ড় [ ধħ:ɽ ] (হাড়), হাড় [ যধ:ɽ ] (ষাঁড়)Ñডেকাগুরে হাড় বানাইলেও আ’ড় নরম অ’ইছে না (ডেকাটিকে ষাঁড় বানালেও হাড় নরম হয়নি)। সিলেটের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন উপাদানে এই ত্রিপুরা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য মিশে আছে। সিলেটে প্রচলিত মূলি বাঁশের ভেতর বিন্নিচাল দিয়ে তৈরি ‘চুঙ্গা পিঠা’ এ ত্রিপুরা সংস্কৃতির স্মৃতিই আমাদের স্মরণ করায়।                                                                                                                      

খাসিয়া ভাষার খড় অর্থবোধক শব্দ থেকে লাউড় স্থান নামের উদ্ভব। খাসিয়া পাহাড়ের কিছু অংশ, সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ এবং হবিগঞ্জ জেলার কিছু অংশ নিয়ে ছিল লাউড় রাজ্য। এর নিকট প্রতিবেশি জয়ন্তীয়াপতিগণ খাসিয়াবংশ সম্ভূত হলেও, লাউড়ের অধিপতিগণ ব্রাহ্মণ বংশজ ছিলেন। লাউড়ের শেষ রাজা গোবিন্দ সিংহ বাঙ্গালার নবাব আলিবর্দি খাঁ এর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করেন এবং রাজা উপাধির পরিবর্তে ‘রেজা’ উপাধি প্রাপ্ত হন। এ বংশের আবিদুর রেজার রাজত্ব কালে (১৭৯০ খ্রি.) খাসিয়াদের আক্রমণে আনোন্যপায় হয়ে নবগ্রাম থেকে বানিয়াচং-এ রাজবাড়ি স্থানান্তর করা হয়। আর তাই এসব অঞ্চলের ভাষা ও সমাজ-সংস্কৃতিতে আর্য-ব্রাহ্মণ ও ইসলামের পাশাপাশি খাসিয়া প্রভাবও কম নয়।

 

হাঙ্কলা কুকিদের বাসস্থান হাকালুকি আর লেংলাই নামক কুকিদের বাসস্থানই লংলা। বাঁশের তৈরি ২-৩ হাত উঁচু পাদুকা ‘কুকির খড়ম’ নামে পরিচিত। কুকির খড়ম পরে দৌড় প্রতিযোগিতা খেলা এখনও সিলেটে কুকি জনগোষ্ঠীর স্মৃতি বহন করে। কুকিরা এ খড়ম পায়ে দিয়ে অনায়াসে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সমতল ভূমিতে নেমে লুটতরাজ চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেত বলে জনশ্রুতি আছে। এদের নাগাকুকি ভাষাও তিব্বতি-বর্মি ভাষা পরিবারের বডো শাখার অন্তর্গত। অবশ্য ত্রিপুরার ভূতপূর্ব মন্ত্রী ঠাকুর ধনঞ্জয় দেববর্মণ মনে করেন: মণিপুরি (মৈতেই) ভাষার সাথে কুকি ভাষার শব্দের বিস্তর পার্থক্য থাকলেও  ভাষাদু’টির স্বর ও গঠনে কতক সাদৃশ্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ গবেষক (কাপ্তান লেউইন, কৈলাসচন্দ্র) স্বীকার করেন: বাংলার পূর্বদিকস্থ পার্বত্য প্রদেশে ত্রিপুরা ভাষার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। নৃতাত্ত্বিক ভাবে কুকিগণ কিরাত বা লৌহিত্য বংশজ। অথচ বাঙালি রমণীগণের সংযোগে এজাতির আকৃতি ক্রমে পরিবর্তন হয়ে আসছে। এর কারণ  হিসেবে ইতিহাস পাঠে অনুধাবন করা যায়Ñসমতলের গ্রাম লুণ্ঠন করতে এসে এরা বাঙালি যুবতীদেরও লুণ্ঠন করতো। অন্য দিকে কুকি সমাজের নারীরা অনেকাংশেই স্বামী অপেক্ষা স্বাধীন। লুণ্ঠিত নারীরা অনেক সময় পালিয়ে এসেও বাঙালি তথা সিলেটের ভাষা-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। কুকিগণ বাঁশ ও বাঁশের তৈরি বেত দিয়ে ঘর এবং বাঁশের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি তৈরি করতো। সিলেটে বাঁশ ও বেতের বহুল ব্যবহারÑকুকি সংস্কৃতিরই স্মারক।

পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল থেকেই সিলেটে সাধারণত পুরুষেরা চওড়া পাজামা ও লুঙ্গি, গায়ে চাদর, নিমা, শীতকালে মিরজাই ও আঙ্গরাখা ব্যবহার করতেন। শীতকালে সাধারণ লোক  যুগীয়ানা গিলাপ, মধ্যবিত্ত প্রবীণ বনাত, তরুনরা দোলাই ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ শাল ব্যবহার করতেন। দরবারে বা রাজদ্বারে যেতে হলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আচকান চাপকান, লাটুদার পাগড়ী ও পায়ে নাগরা জুতা ব্যবহার করতেন। সম্পন্ন গৃহস্থ ছাতা বেহারা ছাড়া ঘরের বাইরে যেতেন না। বেহারা পাতার তৈরি বৃহৎ ছাতা দীর্ঘ বংশদ-ে উচু করে মাথার উপর ধরে রাখত। সম্ভ্রান্ত ধনীরা পাল্কী ব্যবহার করতেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের আধুনিক মানুষের মতই পুরুষেরা শার্ট পেন্ট গেঞ্জি লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি এবং নারীরা শাড়ি সেলোয়ার-কামিজ ইত্যাদি পরে থাকে। তবে বিলাত ফেরত সিলেটি পুরুষদের জুতা মোজা ও ব্লেজার এর সাথে লুঙ্গি ও মাফলার পরে শীতমৌসুমে চলতে দেখা যায়। সম্প্রতি সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল মুসলিম নারীদের ইরানীয় নকসা করা বোরকা পরতে দেখা যায়। অসমীয় সংস্কৃতির প্রভাবে সিলেটেও গামছার ব্যবহার বহুল। আসামের মত সিলেটেও উত্তরীয় হিসেবে গামোছা অতুলনীয় এবং  এর ব্যবহারও ব্যাপক। এছাড়াও মণিপুরি চাদর এবং মণিপুরি ও ত্রিপুরা উপজাতির পোশাকের প্রভাব সিলেটে রয়েছে। চা-শ্রমিকদের পোশাকে রয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ছাপ। মণিপুরি ও টিপরা নারীরা নিজেদের তাঁতে বোনা কাপড় ব্যবহার করে।

সিলেটের উপভাষাতে সর্বনামের উত্তম পুরুষে ‘মুই’, সর্বনামের প্রথম পুরুষে ‘তাই’ ইত্যাদি আসামি ভাষায় আছে। এই সাদৃশ্য সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন,“হইতে পারে প্রাচীন বাংলা ভাষার একটি ¯্রােত উত্তরবঙ্গ হইতে পূর্ব অভিমুখে আসামে প্রবেশ করে। পরে সেই ¯্রােত আসাম হইতে দক্ষিণ অভিমুখে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এককালে বাংলাদেশের এই পূর্ব প্রান্তের ভাষা বোধ হয় আসামীর সহিত একরূপ ছিল; কিন্তু পূর্ববঙ্গের উপভাষার প্রভাবে তাহার বৈশিষ্ট্য লোপ হইয়া পূর্ববঙ্গের উপভাষা গোষ্ঠীর সামিল হইয়াছে। সিলহেটী উপভাষায় এবং ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে ‘তাই’ (ংযব) শব্দ তাহার প্রাচীনত্ব রক্ষা করিয়াছে।” এ উদ্ধৃতিতেই প্রমাণ পাওয়া যায় সিলেটি উপভাষার সাথে অসমিয়া ভাষার এক কালে মিল ছিল। বর্তমানে পূর্ব-বঙ্গীয় উপভাষার প্রভাবে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবধানে সে মিল লোপপেলেও  তা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি।

সিলেটের উপভাষার সাথে অসমীয়ার সম্পর্কের কথা ভাষাবিজ্ঞানী আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ-এর আলোচনাতেও বিদ্যমান। তাঁর ভাষায়, “পূর্বে সিলেট আসামের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং পরবর্তী কালে ব্রিটিশ যুগে সিলেট অবিভক্ত বাংলার অঙ্গীভূত করার পর সেখানে বাংলার প্রভাব বিস্তৃত হয়। এ-প্রভাব দু’ভাবে লক্ষণীয়, প্রথমত সিলেটে বাঙালিদের অনুপ্রবেশ ও নিজের ভাষা ব্যবহার, এবং দ্বিতীয়ত অসমীয়া ভাষার ওপর বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের প্রতিফলন। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা ক্রমশ অসমীয়ার স্থান দখল করায় ভাষা পরিবর্তনে ‘সুপারস্ট্র্যাটাম’ থিওরি প্রয়োগ করা যায়।” আবার বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলা ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষার প্রভাবও অনেকাংশে বিস্তৃত হয়। উপভাষাতত্ত্বে এই শ্রেণির প্রভাব অ্যাডস্ট্রাটাম নামে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে সিলেটের চার পাশের খাসি, অসমীয়া, ত্রিপুরি ও ময়মনসিংহের ভাষার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। ভাষার অবস্তরীয়  তত্ত্ব অনুসারে  কোনো ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী স্থানীয় ভাষা বর্জন করে ভিন্নতর ভাষা গ্রহণ করলে গৃহীত ভাষাটি তাদের মূল ভাষাটির প্রভাবে পরিবর্তিত রূপ লাভ করে। উদাহরণ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যভাষা তৎপূর্ববর্তী অনার্যভাষাগুলোর প্রভাবজাত বিস্তারে যে পরিবর্তন ঘটায় তার উল্লেখ করেন অনেকে। সিলেটের জনগোষ্ঠীর উচ্চারণে ফারসি, পর্তুগীজ ও ইংরেজি ভাষার অনেক শব্দের উচ্চারণ এভাবে পরিবর্তিত হয়ে সিলেটের উপভাষাকে প্রভাবিত করে।

অন্যভাবে দেখলে ইন্দোইউরোপীয় ভাষাবংশের পূর্ব প্রান্তের ভাষা হচ্ছে বঙ্গ-কামরূপী ভাষা। আর বাংলার পূর্বপ্রান্তের উপভাষা হচ্ছে সিলেটি উপভাষা। এর পূর্বে একমাত্র কামরূপী ভাষাই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাবংশের পূর্ব প্রান্তের ভাষা। এখানে আমরা মূলসহ ভাষান্তরিত অসমিয়া বিহু গীতের সংগ্রহ মোষের শিঙের শিঙাটি গ্রন্থ থেকে কিছু শব্দ-পদ নিয়ে সিলেটের উপভাষার সাথে মানবাংলা ও অসমিয়া ভাষার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য প্রদর্শনের প্রয়াস চালাই:

মানবাংলা             সিলেটি উপভাষা                অসমিয়া ভাষা

আকাশে               আকাশত্                            আকাশত্

আমার                  মুর                       মোর

আমি                    মুই                       মই

একঘেয়েমি           আমনি                        আমনি

কপালে                 কপালত্                    কপালত্

কে                কুনে                           কোনে

গালে                    গালত্                          গালত্

ঘটির                    লুটার                          লোটার

চুমু                চ’ুমা                           চুমা

ঢোলে                   ঢুলত্                           ঢোলত্

তাকাই                  চ’াই                           চাই

তোমার                 তুমার                          তোমার

নড়ে                     লড়ে                           লরে

বললেও                কইলেও                      ক’লেও

বিলে                    বিলত্                          বিলত্

বুকে                     বুকুত্                          বুকুতো

বোনটিকে             ভইনটারে                    ভনীয়েকক

ভুলে                     পাউরি                         পাহরি

শপথ                    শপত                          শপত

শরীরে                  শরিলত্                       শরীলত

সাথে                    লগে                     লগে

 

এখানে উল্লেখ্য, কামরূপী মূলত অসমিয়া ভাষা ও বাংলা ভাষার উপভাষা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের পূর্ব প্রান্তের ভাষা অসমিয়া। এর দুটি উপভাষাÑকামরূপী ও গোয়ালপাড়িয়া। আবার বাংলা ভাষার প্রধান পাঁচটি উপভাষার অন্যতম কামরূপী ভাষা। এই উপভাষার পূর্বী আঞ্চলিক বিভেদ থেকেই অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ। উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া উপাত্তের আলোকে মান বাংলার সাথে সিলেটি কামরূপী ও অসমিয়া ভাষার সম্পর্ক এভাবে দেখানো যায় :

 

         মান বাংলা          সিলেটি                 কামরূপী       অসমিয়া

       খাওয়াব                খাওয়াইমু              খুওয়াম          খুওয়াম

       বিড়াল                  মেকুর                  মেকুর           মেকুরি

       যাবেকি                 জ’াইবায়নি          যাবানা           যাবানে

       সত্য              হাসা / হাছ’া         হোসা             হোসা

       সে (পু.)                হে / তা                 হি           হি

       সে (স্ত্রী.)                তাই               তাই        তাই।

 

রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যাবে সিলেট বাংলার প্রান্তে অবস্থিত হবার কারণে বিভিন্ন সময় প্রতিবেশি রাজ্য (অসম, ত্রিপুরা, লুসাই ও বর্মা) কর্তৃক অধিকৃত হয়েছে; কিংবা বাংলা থেকে ছিটকে গিয়ে স্বাধীন রাজ্য (সমতট/হরিকেল) হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আর একারণেই হয়তো বাংলাদেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের ভাষা-সংস্কৃতির চেয়ে সিলেটের  ভাষা-সংস্কৃতিতে অনার্য (অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও  ভোটবর্মী) প্রভাব সর্বাধিক। প্রতœতাত্ত্বিকগণও  দেখেন:

সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া পশুমূর্তির মধ্যে ঘোড়া পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সিন্ধুবাসীদের কাছে ঘোড়া অপরিচিত ছিল। কিন্তু আর্যদের গুরুত্বপূর্ণ পশু ছিল ঘোড়া। সিলেটে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান অবধি ঘোড়ার প্রচলন পাওয়া যায়নি, বরং হাতি বিক্রি এবং হাতি ব্যবহারের নিদর্শন বর্তমান। এমনকি মহাভারতে বর্ণিত প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্ত হাতিতে চড়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রসঙ্গ প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতার ছোঁয়া এই অঞ্চলে পৌঁছেছিল। সুতরাং এখানকার সভ্যতা বৈদিক-পূর্ব যুগের এবং বৈদিক প্রভাবমুক্ত। এমনকি আর্য-প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম থাকায় এখানে ভূমধ্যসাগরীয় সেমেটিক ভাষা-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে। এভাবে প্রতীয়মান হয় সিলেটের সংস্কৃতিতে বৈদিক বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অনার্য উপাদান অধিক।

*সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), সিইউএফ কলেজ,  চট্টগ্রাম। সদস্য নম্বর: ৪২১অবশ্য

Side banner