kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

চন্দন আনোয়ারের গল্প: মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিচ্ছবি


কালচিত্র | ড. মোঃ আব্দুর রশীদ প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২১, ০১:০২ পিএম চন্দন আনোয়ারের গল্প: মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিচ্ছবি

. মোঃ আব্দুর রশীদ

চন্দন আনোয়ারের গল্প : মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিচ্ছবি

প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিকের রেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশের নাটোর জেলায় জন্মগ্রহণকারী চন্দন আনোয়ার [জ. ৮ জানুয়ারি, ১৯৭৮] বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত-সৃষ্টিশীল একজন লেখক। মেধা এবং নিরন্তর শ্রমের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় চন্দন আনোয়ারের কথাসাহিত্য। তাঁর পেশা অধ্যাপনা কিন্তু নেশা লেখালেখি। তিনি বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অধিকতর সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিপুল অভিজ্ঞতা না হলেও গভীর জীবনবোধ ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির সমবায়ে তিনি তৈরি করেন তাঁর গল্পের ভূমি। চন্দন আনোয়ার লেখকের সাহিত্যিক নাম। তাঁর পৈতৃক নাম মোঃ আনোয়ার হোসেন। সর্বমহলে চন্দন আনোয়ার নামে পরিচিত হয়ে উঠলেও পেশাগত জীবনে তিনি সমস্ত কার্যাদি সম্পন্ন করেন মোঃ আনোয়ার হোসেন নামে। নতুন নামে সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ তাঁর লেখাকে যেমন উজ্জীবিত করেছে, তেমনি বিষয় বৈচিত্র্যের সাথে সাথে স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ এবং শিল্প-নৈপুণ্যের সার্থকতা তাঁকে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্য জগতে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। গল্প-রচনার উন্মেষলগ্নে চন্দন আনোয়ারের সাহিত্যিক মন আবর্তিত হয়েছে এদেশের সমাজ-ইতিহাস ও তার পরিপার্শ্বকে ঘিরে। ফলে, স্বদেশের সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে তাঁর গল্পে।

চন্দন আনোয়ারের লেখকসত্তা গঠনে তাঁর কিছু শৈশব-কৈশোর স্মৃতি স্মরণ করা যায়। তিনি যখন স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন তখন তাঁর এক চাচা গ্রাম্য ডাক্তার মকবুল হোসেন তাঁকে শরৎচন্দ্র রচনাসমগ্র পাঠ করে শোনাতেন এবং ক্ষেত্র বিশেষ অভিনয়ও করে দেখাতেন। সেই সূত্রে বাল্যকালেই তিনি শরৎ রচনাসমগ্রের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা কিশোর চন্দনের চিত্তজগতে বহুমাত্রিক শিক্ষা ও প্রেরণার সঞ্চার করে। পরবর্তীকালে বা মাধ্যমিক শিক্ষাজীবনে তাঁর এক ফুফা মনু মিয়া তাঁকে রূপকথা, আষাঢ়ে গল্প, কেচ্ছা-কাহিনি,  বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর-জনপদের হাজারো সুখ-দুঃখ এবং ভাঙা-গড়ার ইতিহাস শোনাতেন। এ-সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেনÑ

 

আমার লেখার সূচনা গল্প লেখা দিয়েই। সে আবার বাল্যকালের কথা। মনু ফুপা নামে আমার দূর সম্পর্কের একজন ফুপা আছে। কুলা-ডালি এসব সখের জিনিস বানাতেন, আর নানা ধরনের রূপকথা গল্প বলতেন আমাদের কাছে বসিয়ে। আমরা কয়েকজন মিলে প্রায় উনার কাছে প্রায়ই গল্প শোনার বায়না নিয়ে উপস্থিত হতাম। তখন তিনি এমন সব আজগুবি-আষাঢ়ে গল্প বলতে কখনও হেসে হয়রান, কখনও ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠত। রাজকুমার যখন রাজকন্যাকে নিয়ে উটের পিঠে চড়ে আকাশে উড়ে যেত, তখন ভয় হত, না জানি রাজকন্যা-রাজকুমারকে নিয়ে ভারী উটটা হঠাৎ কওে এখনই আমাদের মাথার উপরে পড়ে। তবে তাঁর বলা গল্পগুলো আমি গোপনে লিখে রাখার চেষ্টা করতাম, সেগুলো লেখার জন্য গোপন একটা খাতা ছিল আমার। উদ্দেশ্য একটাই, আমি বড় হয়ে ফুফার মতো গল্প করে বেড়াব। গল্প বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব। তারপর যখন আর একটু বড় হলাম, মাধ্যমিকে ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, হঠাৎ একদিন আমার মকবুল চাচার (উনি আমার বাবার চাচাত ভাই, কিন্তু একই বাড়িতে ছিলাম ) কাছে গল্পের নতুন ভাণ্ডার আবিষ্কার করলাম। শরৎচন্দ্রের এমন কোনো বই নেই,  যা তাঁর সংগ্রহে ছিল না।

চন্দন আনোয়ার তাঁর লেখকসত্তা গঠনে শৈশব-কৈশোরের অর্জিত অভিজ্ঞতা, প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ প্রভাব এখনও কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করেন। তিনিই যতই শৈশব-কৈশোর-রূপকথা-কেচ্ছাকাহিনির জগৎ ছেড়ে বস্তু ও বাস্তব জগতে প্রবেশ করেন ততই তিনি দেখেন সমাজ ও জীবনের নানামাত্রিক রূপ, ইতিহাসের চোরাস্রোত। শিক্ষাজীবনের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি উত্তরোত্তর সাহিত্যের পথে চালিত হয়েছেন। মূলত কালিকভাবনা লেখকের মানসচেতনাকে প্রভাবিত করে শিল্পচেতনার পথে চালিত করেছে। এটা প্রমাণিত সত্য যেÑ শিল্পিসত্তার বা ব্যক্তিপ্রতিভার বিকাশসাধনে ব্যক্তিত্বসান্নিধ্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে বিভিন্ন গুণী ব্যক্তি বা লেখকের সফল অর্জনসমূহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়সূত্রে কোনো শিল্পিমানসে সমৃদ্ধি এবং শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এক্ষেত্রে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের নিবিড় ব্যক্তিসান্নিধ্য চন্দন আনোয়ারের শিল্পিসত্তার বিকাশে, সাহিত্যের বৈচিত্র্যপ্রয়াসে এবং পরিপুষ্টিদানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে তা স্বচ্ছন্দে অনুমেয়।

চন্দন আনোয়ার তাঁর লেখার বিষয়ে জানিয়েছেনÑ “নব্বই দশকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় দেয়াল পত্রিকায় লেখালেখির হাত মকশো হয়েছিল। এরপর দুই দশক তোতলা কলম আর থেমে থাকেনি। নব্বই দশকের অবশিষ্ট সময় লেখার চেয়ে পড়ার নেশা-ই ছিল বেশি।” [চন্দন আনোয়ার : নির্বাচিত ৩০ গ্রন্থের প্রসঙ্গত অংশে উল্লিখিত] বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-মানিক-বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-সতীনাথ-কমলকুমার এঁদের লেখা চন্দনের উত্তরাধিকার; একইভাবে শঙ্খঘোষ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ মস্তফা সিরাজ, রিজিয়া রহমান, মামুন হুসাইন, অমর মিত্র, আফসার আহমেদ, সব্যসাচী দেব, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, রবিশংকর বল, শহীদুল জহির প্রমুখ এঁরাও চন্দনের অগ্রজÑউত্তরাধিকার। বিশিষ্ট লেখক আবদুশ শাকুর [১৯৪১-২০১৩] তরুণ লেখক চন্দন আনোয়ারের নিষ্ঠা ও শ্রমসাধ্য উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছিলেনÑ “ও বড়ো লেখক হতে পারবে। ওর মধ্যে সম্ভাবনা আছে।” আবদুশ শাকুরের সেই ভবিষ্যৎ-বাণী সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। চন্দন আনোয়ার নিরন্তর লিখে চলেছেন উভয় বাংলার সাহিত্য-গবেষণাধর্মী পত্রিকায়। তাঁর উপন্যাস : শাপিতপুরুষ [২০১০]; অর্পিত জীবন [২০১৯ ]; গল্পগ্রন্থ : প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন [২০১০], অসংখ্য চিৎকার [২০১২], পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর [২০১৪], নির্বাচিত ৩০ [২০১৭], ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ [২০১৭], ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার [২০১৮], আঁধার ও রাজগোখরা; প্রবন্ধগ্রন্থ : নজরুলের জীবন ও কর্মে প্রেম [২০০৯], বাংলা ছোটগল্প ও  তিন গোত্রজ গল্পকার : মানিক-হাসান-ইলিয়াস [২০১২], উজানের চিন্তক হাসান আজিজুল হক [২০১২], হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : বিষয়বিন্যাস বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণকৌশল [২০১৫], কথাসাহিত্যের সোজাকথা [২০১৬];  বাঙালির চিন্তাবিভূতি : সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ [২০১৯], সম্পাদিত গ্রন্থ : গল্পপঞ্চাশৎ : শূন্যদশকের গল্প [২০১৩], হাসান আজিজুল হক : নিবিড় অবলোকন [২০১৫], এই সময়ের কথাসাহিত্য ১ম খণ্ড ও ২য় খণ্ড [২০১৫], হাসান আজিজুল হকের ‘আমার ইলিয়াস’ [২০১৬], জুলফিকার মতিনের উপন্যাসসমগ্র [২০১৭], সেলিনা হোসেনের সাহিত্য : পাঠ ও মূল্যায়ন [২০১৮]।

চলমান ঘটনাপ্রবাহ, সমাজ-সংস্কৃতি, মানুষের স্বপ্ন, আশা-নিরাশার চিত্র চন্দন আনোয়ার তাঁর গল্পে তুলে আনেন সচেতনভাবেই। সামগ্রিকভাবে সমাজ, দেশ, রাজনীতিন দুর্বৃত্তায়ন, মানুষের মুল্যবোধের অবক্ষয় গল্পকারকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। যে-বিষয়গুলো তাঁর মনে রেখাপাত করেÑ সে-বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্তর্তাগিদেই তিনি গল্প লিখতে বাধ্য হতেন। মানুষের স্বপ্ন, মানুষের বিশ্বাস ভাঙতে দেখলে লেখক স্বপ্নভঙ্গ কিংবা বিশ্বাসহারা মানুষের পক্ষ নিয়েই লিখতে শুরু করেন। চলমান বাস্তবতায় অবক্ষয় আর বিনাশে বিনষ্ট মানুষ-সমাজ-দেশ-সভ্যতার পঁচনধরা বিষয়ে চন্দন কলম-চালান চাবুকের রূপকল্পে। তাঁর সব গল্পই এ-ধরনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। 

চন্দন শুধু গল্পলেখার জন্য গল্প রচনা করেন নাÑ এ পিছনে সক্রিয় আছে তাঁর সমাজশোধন, কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক শুদ্ধাচার এবং ব্যক্তিজাগরণের চিন্তা। এ-সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেনÑ “ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি কিছু করতে পারছি না, কিন্তু প্রতিবাদ তো জানিয়ে রাখতে পারি। কে জানে, কোনো একদিন হয়তো আমার কাক্সিক্ষত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।” আর এ কারণেই বলা সঙ্গত হবে যেÑ চন্দন তাঁর গল্পে বাদ-মতবাদ-তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেননাÑ সমাজসত্য-বাস্তবসত্য প্রতিষ্ঠাই তাঁর অন্বিষ্ট। আর একই কারণে তিনি আশাহীন সমাজ-সময়ের মধ্যে হয়ে ওঠেন আলোকপিয়াসীÑ ইতিবাচক গল্পকার।

চন্দন আনোয়ারে নির্বাচিত ৩০ সংকলনের গল্পগুলো পড়ে পাঠক্রিয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট লেখক সাধন চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেনÑ

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, যারা একবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা নিয়ে সৃষ্টিশীল চর্চা করছে, ছোটগল্পের আখ্যান চরিত্র ও          দেশকালের ঐতিহ্যকে কতটুকু এবং কীভাবে বিনির্মাণ, পুনর্নির্মাণ করছে, জানবার জন্য। চন্দন আনোয়ারদের লেখক-প্রজন্ম নিয়ে এ-পারেÑপশ্চিমবঙ্গেÑআমি সামান্য কাজ করেছিলাম। তাই, তুলনামূলক একটি গ্রাফ আঁকবারও তাগিদ জেগে উঠেছিল।           বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে সামান্য অভিজ্ঞতায় শ্রদ্ধার বেদী তৈরি হয়ে আছে আমার। প্রাণিত হই। মনে হলো একমেটে রং- এর মতো, বেদীটিতে একটু পোঁচ পড়ল। অক্টোবরের অবসরে টানা পড়ে ফেললাম চন্দনে তিরিশটি গল্প। টের পেলাম, দূর জেলা শহরের কোন তরুণ ক্রিকেটার যেন দেশের হয়ে মিরপুরের মাঠে টেস্ট খেলার জন্য দরজায় খটখটাচ্ছে।... উনচল্লিশ বছরের যুবক-লেখকটির কলম যে পাহাড়ি জলপতনের মতো—কোনো বিতর্ক থাকে না।... উভয় বঙ্গের সাম্প্রতিক লেখালেখিতে এমন গল্পের তুলনা খুবই বিরল। এছাড়াও, বর্তমান উন্নয়ন ও ভোগের বাজারে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে, বাংলাদেশেও তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও মন খারাপের নিঃশ্বাসের পাশপাশি বিপুল বস্তিবাসীর মধ্যেও মিথ্যা মরীরিচকার হাতছানির ইঙ্গিত— চন্দন আনোয়ারের গল্পে বার্তা দিচ্ছে। [চন্দন আনোয়ার : নির্বাচিত ৩০ গ্রন্থের পাঠপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা অংশে উল্লিখিত]

চন্দন আনোয়ার বহমান সমাজকে নিরীক্ষণ করেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে তাঁর গল্পের পটভূমি-বর্ণনা-পরিণতি নির্মিত হয় ভিন্ন মেজাজে। গল্পের বিষয়-নির্বাচন, গল্পভাষা, আঙ্গিক-শৈলী, চরিত্র নির্মাণ কৌশল, ঘটনার গতিবেগ পাঠককে নিবিষ্ট মনে গল্পপাঠে মগ্ন করে রাখে। 

এদেশের সমাজ-জীবন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদের গভীরে প্রোথিত চন্দন আনোয়ারের শিল্পী-মানস। গল্পকার জানিয়েছেনÑ “একথা বলতে দ্বিধা নেই, আমার লেখকসত্তা বাঙালির একক অখণ্ড জাতীয়তার প্রতি নির্দ্বিধায় ও নিঃশর্তে আজীবন নতজানু। তাই আমি যখন লিখতে বসি, তখন বাংলা ভাষার বাঙালি লেখক হিসেবেই লিখতে বসি। ... আমি যেখানে লেখক, সেখানে বাঙালি জাতিসত্তায় বিভক্তি নেই, সীমানা পিলার নেই, কাঁটা তারের বেড়া নেই, পাসপোর্ট ভিসা নেই।” [চন্দন আনোয়ার : নির্বাচিত ৩০ গ্রন্থের প্রসঙ্গত অংশে উল্লিখিত] আর এসব কারণেই চন্দন আনোয়ারের গল্পের জমিন ধারণ করে আছে বাংলা-বাঙালির জাতিসত্তার নির্মেদ দলিল। তাঁর লেখার প্রাথমিক পর্ব থেকেই তিনি এদেশের বিভিন্ন জনপদ, সমাজ-জীবনের ও ঘটনা-প্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী। যে-সব ঘটনা-প্রবাহ তাঁকে আন্দোলিত করেছেÑ তা তিনি অবলীলায় তুলে ধরেছের গল্পের শিল্পভাষ্যে। জীবন কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে তিনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেন তাঁর মনোবীণায় সব সময় বাঙালি জাতিসত্তা তথা স্বদেশ-ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করেন। সাহিত্য-সাধনার সূচনা থেকেই স্বদেশ-ভাবনা এবং স্বদেশের মূল্যবোধ তাঁকে সাহিত্য-রচনাতে প্রেরণা যুগিয়েছে। স্বদেশ-বিনির্মাণ এবং স্বদেশ অন্বেষা তাঁর শিল্পীমানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি আপন অস্তিত্ত্বে দেশ এবং দৈশিক ঐতিহ্য সম্পর্কে যে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন তা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত কলেবরে উপস্থাপন করেছেন।

তিনি গল্পের বিষয় ও শিল্পভাষ্যে সমাজ এবং সময়ের নানামাত্রিক দ্বন্দ্বজটিলরূপ অতি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে তুলে ধরেছেন। মূলত তাঁর ছোটগল্পগুলো সময়, সমাজ ও দেশকালের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রবহমাণ। ফলে তাঁর গল্পে যুগ-জীবন, যুগ-মানস ও সমাজের বিচিত্র প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাঁর গল্পের বিষয়-চরিত্র কল্পনার জগৎ থেকে নয়Ñ বাস্তবতার যুগজীবন থেকে সংগৃহীত। চন্দনের গল্পের বিষয় হিসেবে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ, দেশভাগ, স্বদেশ ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিচ্ছবি, নগরজীবন, সামাজিক অবক্ষয়, শ্রেণিবৈষম্য, পতিতাবৃত্তি, অবদমিত যৌনাকাক্সক্ষা, নারীচেতনা, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। এ-নিবন্ধে চন্দন আনোয়ারের গল্পে প্রতিফলিত মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিচ্ছবি-বিষয়ক নানাদিক তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে।

চন্দন আনোয়ারের জন্মের সাত বছর আগেই বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ নামক ভূখণ্ডটি নয়মাস মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায়। তাই চন্দন আনোয়ারের গল্প-আখ্যান, নতুন প্রজন্মের লেখক হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতা অনুবীক্ষণে দেখার নতুন ইতিহাসপাঠ। উল্লেখ্যÑ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির দীর্ঘকালের আত্মানুসন্ধান, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ইতিহাসের অমোঘ পরিণতির বাস্তব দলিল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বাঙালির বীরত্বগাথা, আত্মপ্রত্যয়ের দীপ্ত শপথ, জাতির মুক্তির ইতিহাসের উজ্জ্বল বাঁক চিহ্নের সূচক এবং হর্ষ-বিষাদের এক মহাকাব্য। তাই, আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে এবং সমাজ-সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা ধারণ করে আছে এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণি ও পেশার জনসাধারণ। ‘রোমাঁ রোলাঁর বিখ্যাত বই ও ডরষষ ঘড়ঃ জবংঃ-এর মূল  বক্তব্য ছিল সভ্যতার সঙ্কটকালে লেখক ও শিল্পী নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন কিংবা স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশি-বিদেশি শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীগণও এই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আন্দোলিত হয়েছিলেন এবং এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে তাঁরাও বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। আমাদের শিল্পী সাহিত্যিকগণও ছিলেন এই অবিরাম সংগ্রামের সহযাত্রীÑপ্রতিবাদী-দ্রোহী; তাঁরাও ৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা- কেউ কলমকে বন্দুকের সমকক্ষ করেছিলেন। স্বাধীনতা-সংগ্রামকালীন কিংবা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ তাই এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপিত। শিল্পী-সাহিত্যিকগণ তাঁদের মনের তাগিদেই হোক, কিংবা শিল্প সৃষ্টির প্রেরণায় হোকÑ তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজস্র কবিতা গল্প-উপন্যাস-নাটক রচনা করেছেন। ফলে, শিল্পী সাহিত্যিকদের রচনায় মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর চিত্রের সমাবেশ ঘটেছে নানামাত্রিক আয়োজনে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ এদেশের সমাজ জীবনে এবং জাতীয় ইতিহাসে যে পালাবদল রচনা করেছে তা মুক্তিসংগ্রামের সময় থেকে অদ্য সমাজ সচেতন শিল্পী সাহিত্যিকেরা তার প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছেন তাঁদের সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে আমাদের মননে যে নবচেতনার জাগরণ ঘটে, বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো ছোটগল্পেও অনিবার্যভাবেই তার প্রতিফলন ঘটেছে। এদেশের যে সমস্ত কথাসাহিত্যিকের রচনায় মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিচ্ছবি অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে সত্যেন সেন [১৯০৭-১৯৮১], আবু জাফর শামসুদ্দীন [১৯১১-১৯৮৯], শওকত ওসমান [১৯১৭-১৯১৮], সরদার জয়েনউদদীন [১৯২৩-১৯৮৬], আলাউদ্দিন আল আজাদ [১৯৩২-২০০৯], জহির রায়হান [১৯৩৩-১৯৭২], সৈয়দ শামসুল হক [১৯৩৫-২০১৬], শওকত আলী [১৯৩৬-২০১৮], রিজিয়া রহমান [১৯৩৯-২০১৯], মাহমুদুল হক [১৯৪১-২০০৮], আখতারুজ্জামান ইলিয়াস [১৯৪৩-১৯৯৭], হাসান আজিজুল হক [জ.১৯৩৯], সেলিনা হোসেন [জ.১৯৪৭], কায়েস আহমেদ [১৯৪৮-১৯৯২], হুমায়ূন আহমেদ [১৯৪৮-২০১২], শাহরিয়ার কবির [জ.১৯৫০], আনিসুল হক [জ.১৯৬৫] অন্যতম। এঁদেরই উত্তরসূরী-মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের লেখক হিসেবে চন্দন আনোয়ারের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ পরবর্তী স্বদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় পরিবেশ, রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা, স্বপ্নভঙ্গের হতাশা, যুদ্ধপরাধীদের দৌরাত্মÑ বিচার প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে প্রতিকায়িত হয়েছে চন্দনের গল্প।

বাঙালি জাতির গৌরবময় এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। সমগ্র বাঙালির জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রতিক্রিয়াকে গল্পকার গভীর জীবনাসক্তি এবং নিরাসক্ত দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে তার অন্তঃর্সত্যেরই রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর গল্পে। এ-মুক্তিযুদ্ধোত্তর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে চন্দন আনোয়ার অনুবীক্ষণীয়দৃষ্টিতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ-কারণেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে চন্দনের গল্প ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। তিনি যুদ্ধোত্তর গল্পসমূহে নতুন পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক কাঠামো এবং চেতনার বিবর্তনের পটভূমিতে নবতর সমস্যা এবং সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেছেন। এ-জাতীয় গল্পে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কোনো চিত্র নেই, তবে আছে যুদ্ধ-পরবর্তী মানুষের জীবনসংগ্রাম, নানামাত্রিক সংকট ও সমস্যা, যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া, দেশ গড়ার এবং নতুন পরিবেশে নতুন সমাজ কাঠামোর জন্য নবতর যুদ্ধের চিত্র।

চন্দন আনোয়ারের কবি কাপালিক [অসংখ্য চিৎকার] গল্পের বিষয়-বর্ণনা থেকে মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিবর্তিত সমাজ-ব্যবস্থায় প্রগতিশীল শ্রেণির ওপর প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণির নির্মমতার চিত্র লক্ষ করা যায়। স্মরণীয় যেÑ ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের মাধ্যমে নব পাকিস্তান রাষ্ট্রে রবীন্দ্রচর্চা কিংবা জাতীয় সংগীত চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কিন্তু নির্র্ভীক বাঙালি জাতি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার দ্বারা সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে আবহমান বাংলায় সম্প্রীতির বিজয় পতাকেই সঙ্গী করেছেন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পরেও স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সংবিধান-অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরোধীরা বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে বারবার আঘাত করেছে। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লেখক গল্পটি শুরুতেই দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ-গণতন্ত্র বিরোধী সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পেশাদার খুনী [গল্পের ভাষায় আগন্তুকÑ গল্পের নামানুসারে কাপালিক] দেশসেরা কবি-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্ধানে শহরে প্রবেশ করছে। গল্পকারের ভাষায়Ñ

শহরে আগন্তুক ঢুকেছে। এসেছে রাতের ট্রেন ধরে। কমলাপুর স্টেশনে নেমেই প্রথমে নিজের দিকে তাকিয়েছে একবার। আগন্তুক কালো, ঋজু ও খর্বকায়। খয়েরি রঙের প্যান্টের উপরে অ্যাপ্রোনের মতো একটা ফতুয়া শরীরে। প্রশস্ত করোটিতে দুইটা কাটা দাগ। প্রায় গিরগিটির মতো লম্বা ঘাড়। ঝোপের মতো ভুরু, নিচের দুটো চোখের একটি কিছুটা অস্বাভাবিক। ডান চোখের মধ্যমণি নাই বলেই মনে হচ্ছে। হাত দুটো সাগর কলার মতো ঝুলছে। অস্বাভাবিক চোখটাকেইস্টেশন দেখার কাজে লাগাচ্ছে। দুম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ব্যস্ত সে। খড়ের মতো অগোছালো চুলে চিরুনি চালায় ক্ষিপ্রতার সাথে। এক ফাঁকে চিরুনি চালায় দূর্বাঘাসের মতো ছাঁট করা ঘন দাড়িতে। এরপর হাতে তুলে নিল খয়েরি রঙের ব্রিফকেস। সিনা উঁচু করে সাহসি এবং স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে এবং মৃদু গলাখাকারি দিয়ে পরীক্ষা করে নিয়েছে নিজের কণ্ঠনালি। আগন্তুক বেঁটে হওয়ায় লম্বা করে পা ফেললেও এগোতে পারছে অল্প। অবশেষে স্টেশন ছেড়ে মিশে গেল জনমিছিলে। জনমিছিলের ঘনত্ব ছেড়ে একটা কালো রঙের ক্যাবে উঠে বসল। শহরের নীরব একটা গলির প্রবেশমুখে দরজা খুলে নেমে পড়ল। [পৃ. ৯]

অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে কবিতা রচনা করেন কবি: যাঁর একটি কবিতার বই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় একদিনে দশহাজার কপি বিক্রি হয়। এই কবি নিরন্তর লিখে চলেছেন বাঙালি জাতিসত্তার মর্মবাণীকে ধারণ করেই। এ-কবিকেই হত্যা করতে অত্যন্ত সুকৌশলে অগ্রসর হয় ধর্মীয় লেবাসধারী আগন্তুক-কাপালিক। স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ পছন্দনীয় নয়Ñ তাই দেশের প্রধান কবিকে দিয়ে তারা জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে তৎপর। তাই একই সাথে আগন্তুক কবিকে প্রাণনাশের হুমকি এবং প্রলোভন দেখায়। এ-কবির কবিতা এমন শক্তিশালী এবং প্রেরণাদায়ী যেÑ তাঁর পাঠক-ভক্ত সংখ্যা অগণিত। তাঁর কবিতা পড়েই অনেক স্বাধীনতাবিরোধীরাই চলার পথ পরিবর্তন করেছেন। আগন্তুক কবিকে জানিয়েছেনÑ “আপনারাই আমাদের খুব ক্ষতি করেন। বিশেষ করে আপনি আমাদের বড়ো ক্ষতি করছেন। শতে শতে কর্মী আপনার কবিতা পড়ে সংগঠন ছেড়েছে। আগে আমি এক নিশ্বাসে দশটা খুন করতে পারতাম। এখন একটা ফেলতেই হাত কাঁপে। এমন ঘটছে আপনার কবিতা পড়ে।” [পৃ. ১৩] এরপর স্বাভাবিকভাবে আগন্তুক এবং কবির মধ্যে আলাপচারিতা শুরু হয়। কবিকে আগন্তুক প্রশ্ন করেÑ “আপনার লেখায় এইসব কী থাকে? গণতন্ত্র! সমাজতন্ত্র! জাতীয়তাবাদ! বস্তাপঁচা বাতিল এইসব আইডিয়াকে আমি খান্কিবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই মনে করি না। হু! বিকৃত হাসি দিতে দিতে শান্ত হতে হতে আগন্তুক বিড়বিড় করে, গণতন্ত্র! সমাজতন্ত্র! মুক্তিযুদ্ধ! এইসব ছাড়া আপনারা কবিরা কবিতা লিখতে পারেন না!” [পৃ. ১১] তারপর আগন্তুক কবিকে সরাসারি জানায় কবিকে তাদের নিশানা করার কথাÑ খুন করার কথাÑ “আপনি যে খুন হবেন, আপনি নিজেও জানেন! বিচক্ষণ কবি আপনি ... যদি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের চশমা চোখে না পরতেন আর দালালি না করতেন, শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম, আল্লামা ইকবালের মতো বড়ো কবি হতে পারতেন! সেই শক্তি আপনার আছে। থাক, সে কথা বলে কী লাভ! আপনার মগজে তো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের পানি জমে আছে।” [পৃ. ১১-১২] 

আগন্তুকের ভাষায় কবি স্তব্ধ হনÑ কিন্তু আগন্তুকের কথা শেষ হতে চায়না। আগন্তুক তাকে ঐদিনই খুন না করে একটা ‘গোল্ডেন চান্স’ দিয়ে যায় শর্তের বিনিময়ে। আগন্তুকের ভাষায়Ñ

আপনাকে লিখতে হবে, ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালবাসি’Ñএই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেমানান! এখন আর চলে না। আপনি কেবল নতুন জাতীয় সঙ্গীতের প্রস্তাবনা দেবেন। আর বাকিটা আমাদের কাজ। আপনি দেশের প্রধান কবি! আপনার কথা দেশের মানুষ শুনবে! সাথে ছোট্ট একটা লাইন যোগ করে দিতে হবেÑআপনার কবিতায় যা লিখেছেন তা আপনি    বিশ্বাস করেন না! শুধুই কবির উদ্ভট কল্পনা! [পৃ. ১৩]

আগন্তুকের সামনে কবি অসহায়-নির্বাক অবস্থায় গলাকাটা গরুর মতো ছটফট করেন। কবির সামনে শুধু দুটো পথ খোলা থাকেÑ হয় তিনি খুন হবেনÑ নতুবা বিনাবাক্যে দুই লাইন লিখে দেবেন। আগন্তুক তথা ‘যমদূত’ যাবার বেলায় এটাও কবিকে সতর্ক করে দিয়ে যায়Ñ”নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে খামাখা বউ-বাচ্চাদেরও আমাদের খরচের খাতায় নাম উঠাবেন না।” স্বাধীন সোনার বাংলায় আবার স্বাধীনতাবিরোধী-প্রতিক্রিয়াশীলদের চরম অরাজকতার দৌরাত্ম্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কবি। কবি দেখতে পান ‘রাষ্ট্রের তৃণমূল থেকে টপে স্বাধীনতার বিরোধীদেরই ভয়ানক আস্ফালন’Ñ যারা স্বাধীনতা-সংবিধান-বাংলাদেশ কিছুই স্বীকার করেনা। কিন্তু কবি ‘মরবেন তবু মানবেন না’Ñ আদর্শ-চেতনাকে বিসর্জন দেবেন না।

মধ্যরাতে কবি তাঁর শেলফ থেকে চল্লিশটি বই [প্রতীকী অর্থে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর] নিচে নামিয়ে তার সামনে গুনগুন করে গাইতে থাকেনÑ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।Õ কিন্তু সোনার বাংলায় স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপতায় ক্ষুব্ধ কবি ভেঙে ফেলেন তাঁর এতদিনকার অর্জিত সম্মানের-আবেগের সনদ-মেডেলগুলো। মধ্যরাতে কবির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক জানাচ্ছেনÑ

অপ্রকৃতিস্থের মতো কবি একের পর এক পদক ভেঙে বহুখণ্ড করে ফেলছেন! একুশের পদক ভেঙে গুড়ো হয়ে আছে! স্বাধীনতার  পদক দুই টুকরো হয়ে আছে! কবিপত্নী কোলমাজা করে জড়িয়ে ধরে কবিকে শান্ত করল। মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে কবি জখম জন্তুর মতো চেঁচিয়ে উঠলেনÑ এই সব তামাশা! তামাশা!! [পৃ. ১৫]

কবিকে বুকে জড়িয়ে বিনিদ্র রাত পার করে কবিপত্নী। গলাকাটা মুরগির মতো চিৎকার করে কবি। এরকম চিৎকার কবিকে আরও একবকার করতে দেখেছে কবিপত্নীÑ যখন তার বাবার খুনি, আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীকে পার্লামেন্টে ঢুকতে দেখেছেন। অন্যান্য দিনের অভ্যস্ত সকালের মতো কবির জীবনে ভোর আসেÑ কিন্তু কবি প্রতীক্ষারত তাঁর জীবনের শেষ সময়ের জন্য। ‘কবির বাবার রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীন’ দেশে কবি আজ সারাদেশে প্রত্যক্ষ করেন সর্বনাশের কালোছায়াÑ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের সর্বাত্মক আগ্রাসন, এসিড সন্ত্রাস, একযোগে জঙ্গি হামলা। ভয়াবহ পরিণতির কথা জেনেও কবি বুকে ধারণ করেন দেশকেÑ এগিয়ে যান মৃত্যুর সদর দরজায়। নিজের জীবন, পরিবারের নিরাপত্তার থেকেও কবি দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখাই গুরুদায়িত্ব বলে মনে করেছেন। পরের দিন এবার আগন্তুক একা নয়Ñ আরও দুজনকে সাথে নিয়ে আসে। কিন্তু কবি নির্বিকারÑ তাদের আদেশ মানতে অপারগ। আগন্তুক চিৎকার করেÑ

দুই কলম লিখে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে আপনার? Ôআমার সোনার বাংলাÕ পাল্টে নতুন জাতীয় সঙ্গীত দেশের মানুষের দাবি। আপনাদের মতো কবি-সাহিত্যিকদের জন্য পারছি না। সামান্য এই কাজটি করে আপনি নিজে বাঁচবেন, সন্তান দু’টা এতিম হবে না! একজন নারী বিধবা হবে না! দেশের মানুষও মালাউনের হাত থেকে বাঁচে! আমার সংগঠনও বেগবান হবে। [পৃ. ১৬]

এরপরেই গল্পের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি লেখক বর্ণনা করেনÑ

কবি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। দুই হাত টানা সোজা সোজা করে এবং সিনা উঁচু করে স্কুল বালকের মতো সুর করে গাইতে লাগলেনÑ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তো ...  [পূর্বোক্ত]

পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয়না যে জাতীয় সংগীত গাওয়া শেষ করার আগেই ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে নিভে যায় কবির জীবনপ্রদীপ। তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশ আবার নতুন করে রক্তাক্ত হয় শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানÑ দেশের প্রধান কবি। উল্লেখ্যÑ এই গল্পপাঠে প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা কবি শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ [২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪] এবং বিশিষ্ট লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের [৩ মার্চ, ২০১৮]  হত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলোই সজীব হয়ে ওঠে।

চন্দন আনোয়ার ‘অসংখ্য চিৎকার’ [অসংখ্য চিৎকার] গল্পে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী-প্রজন্ম কর্তৃক যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার দাবীকে জোরালে করে তুলেছেন। স্মরণীয়Ñ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যুদ্ধপরাধের সাথে জড়িত সকলের সর্বোচ্চ সাজা প্রদান, জামায়াত ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান বয়কট করার দাবীতে ৫ ফেব্রয়ারি ২০১৩ সালে প্রজন্ম চত্বরের তরুণ প্রজন্ম অহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে জোরালে আওয়াজ তোলে। সমাবেশে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের উপায় হিসেবে আন্দোলনকারীরা বেছে নিয়েছিলেন স্লোগান, গান, কবিতা, নাটকÑ পোড়ানো হয়েছে যুদ্ধপরাধীদের কুশপুত্তলিকা। এ-আন্দোলন যত এগিয়েছেÑ তত নানা শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণের মানুষেরা বিভিন্নভাবে সংহতি প্রকাশ করেছেন। একসময় তা দেশব্যাপী সব তরুণ এবং জনসাধারণের গণদাবীতে রূপান্তরিত হয়।

এখানে আরেকটু উল্লেখ করা জরুরি যেÑ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবী জোরালো হয় ২০১৩ সালেÑ অন্যদিকে ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পটি রচিত হয়েছিল ২০১১ সালে। এক্ষেত্রে আমরা একজন দূরদর্শী গল্পকারের পরিচয় পাই আলোচ্য গল্পের মধ্য দিয়ে। এ-সম্পর্কে চন্দন আনোয়ার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেনÑ

২০১১ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি নিয়ে অসংখ্য চিৎকার নামে একটি গল্পটি রচনা করি। গল্পটি প্রথমে  দৈনিক ভোরের           কাগজ পরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েটি পত্রিকায় ও সংকলিত গ্রন্থে প্রকাশ পায়। এই গল্পে আমি দেখিয়েছি, তৃণমূল থেকে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের নিকট থেকে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি জোরালোভাবে না উঠে আসলে সংসদমুখী ক্ষমতাপ্রিয়         রাজনৈতিক     দলেরা কিছুতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করবে না। বাস্তবে দেখেছি কি, যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হলো। ঠিক তখনি তরুণ সমাজ রাস্তায় নেমে এলো, তাদের অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকারে প্রকম্পিত হলো দেশ। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করতে বাধ্য হলো রাজনৈতিক সরকার। শাহবাগের অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকার রাজশাহীতে আমার বুকে এসেছে বেজেছে, আর আমি এইভাবে ভেতরে ভেতরে উল্লসিত হয়েছি যে, আমি ঠিক এমন একটি জাগরণই চেয়েছিলাম। আমার ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পটির কথা বার বার মনে হচ্ছিল।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকসেনারা এদেশীয় দোসর আলবদর-আলশামস-রাজাকারবাহিনীর সহযোগিতায় অসংখ্য বাঙালি নারীনির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যাযজ্ঞের মতো বর্বর ঘৃণিত কর্মে মেতে ওঠে। কিন্তু হার না-মানা বাঙালি দুইশত ছেষট্টি দিনে এক সাগর রক্ত পেরিয়েÑ অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে- অগণিত নারী-পুরুষের আত্মত্যাগÑ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ-প্রচেষ্টার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। কিন্তু মুক্ত স্বাধীন দেশে যুদ্ধপরাধীরা বিভিন্ন কৌশলে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়Ñ এমনকি তারা রাষ্ট্রক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত হয়। চন্দন আনোয়ার বেশ পরিকল্পিতভাবেই ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্প-বর্ণনায় অগ্রসর হয়েছেন। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পকার টানটান উত্তেজনা বজায় রেখে পাঠককে বুঝতে সময় দিয়েছেন যেÑ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার-সম্পর্কিত। গল্পপাঠে দেখা যায় শহর থেকে আগত সাতজনের একদল তরুণ গহরডাঙ্গা গ্রামে বটগাছের ছায়ার আচ্ছাদিত বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যাওয়া একটি ডোবা-সদৃশ্য বদ্ধভূমি আবিষ্কার করে লাল নিশানা দ্বারা চিহ্নিত করেন। এ-কাজে তারা সহযোগী করে উক্ত গ্রামের সুলায়মান মাস্টারের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে নাসরিনকে। এরপরই দ্রুত গ্রামের পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়Ñ শুরু হয় গুঞ্জন আর আতঙ্ক । লেখকের ভাষায়Ñ

তারপর হাত ধরাধরি করে দাঁড়াল ডোবাটার পাশে। সাতজনেই আকাশের দিকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে তাকায়; কিছু একটা প্রার্থনা করেছে বলে মনে হয়। ওরা আর সময় নিল না। সাতটি লাল নিশানা পুঁতা হয়ে গেল চোখের পলকে। ...এরপর হতেই ক্ষিপ্রতা সাথে নিশানা উড়ছে। ... নতুন এক বিস্ময় আর অদ্ভুত এক আতঙ্ক জাগল মানুষের মনে। ছোট-বড় সকলেই নিশানাগুলোর দেমাগি উড়াকে দেখতে আসে। এক টুকরো লাল কাপড় এত সশব্দে এত দেমাগে ওড়ে কী করেÑ        মানুষেরা বলাবলি করে। ছেলেরা মাটির নিচের ডিনামাইট সেট করে রাখতে পারে। ... বাতাসের শ শ শব্দ আর নিশানার ফোঁস          ফোঁস শব্দের সম্মিলনে ট্রেনের হুইশেলের মতো শব্দ বহু দূর হতে শোনা যাচ্ছে। [পৃ. ৫৫-৫৬]

তরুণদের এ-কাজে মুক্তিযোদ্ধা শফিক নতুন ইঙ্গিত পায়; তাঁর মতে ‘লাল নিশানা ফের যুদ্ধের ডাক দিচ্ছে।’ এরই মধ্যে থানার ওসি এসে লাল নিশানা চিহ্নিত পরিত্যক্ত ডোবাটি আলিয়া মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা বোরহান উদ্দিনের মাধ্যমে পাহারার ব্যবস্থা করে। এরপর একটা রুদ্ধশ্বাস-আতঙ্ক গহরডাঙ্গার প্রাত্যহিক জীবনপ্রবাহে বিরাজ করে। কিন্তু একজন মানুষ দারুণভাবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েÑ তিনি স্বাধীনতাবিরোধী জমির খাঁÑ দুবারের নির্বাচিত দাপুটে চেয়ারম্যান। এতদিন তার কুকর্মের অনেক ইতিহাস চাপা পড়লেও নতুন তরুণ প্রজন্মের নতুন নিশানা উড়ানোর মধ্যে দিয়ে তা যেন আবার জীবন্ত হয়ে পড়ে। জমির খাঁর মনে হয় ঔ নিশানার লক্ষ-ই সম্ভবত তিনি নিজে। কেননা তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীর বিচার-প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। অজানা আতঙ্কেÑ আগামী মৃত্যু-ভাবনায় ‘মাজাভাঙা কলাগাছের মতোই’ তিনি তাঁর-ই স্কুলের মাস্টারের মেয়ে নাসরিনের কাছে একই সাথে করুণা প্রার্থনা করেÑ “অনেকটা মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে বিড়বিড় করে বলল, তুমি আমার মেয়ের মতো। এই গ্রামের মেয়ে। এতবড় সর্বনাশ তুমি করো না, মা!” [পৃ. ৫৮]। কেননা নাসরিন তথা তরুণ প্রজন্মের কাছে ততদিনে জমির খাঁর স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে এবং তার বিচারের দাবীতে তরুণ প্রজন্মের সংঘবদ্ধ কণ্ঠস্বর, চিৎকার, শক্তি, দাবী জোরালো হচ্ছে। গল্পপাঠে মনে হয় যেনÑ এরই পথরেখা ধরে যেন সমবেত শক্তির উদ্বোধন ঘটে ঢাকা শহরের শাহবাগ-আন্দোলনে।

প্রশস্ত একটি পুকুর ঊনচল্লিশ বছর আগে [১৯৭১] 'খানসেনাদের' তাণ্ডবলীলার সাক্ষ্য বহন করে আজ ডোবার পরিণত হয়েছে। আর এ-সময় স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হিসেবে খানসেনাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল জমির খাঁ। সত্যচাপা দেওয়ার প্রয়াসে নাসরিনের কাছে জমির খাঁর করুণা-প্রার্থনা কোনো করুণা জাগাতে ব্যর্থ হয়। নাসরিনের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ে ঘৃণামাখা প্রতিবাদের আগুন। নাসরিনের ভাষায়Ñ “পশুদের ক্ষুধার খোরাক জুগিয়ে কয় টাকা পেয়েছিলেন? আপনার মা-মেয়েকে ওদের কাছে পাঠাননি কেন?” [পৃ. ৬২]  জমির খাঁ হিংস্র জানোয়ারের মতো গর্জন করে আবার নিমিষেই ফুরিয়ে যাওয়া বাতির মতো নিভে যায়। নাসরিন তার চিৎকার তথা প্রতিবাদে জাগাতে চায় অসংখ্য মানুষের কণ্ঠস্বরÑ যাঁদের সর্বনাশ করেছেন জমির খাঁ। এখানে নাসরিনের উদ্দেশ্যটি স্পষ্টÑ

বড়জোর আমার একার চিৎকারের সাথে যাদের সর্বনাশ করেছেন সেসব মানুষের অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকারে মিলে যেতে পারে। তারপর অবশ্য আমার কিছু করার দরকার পড়বে না, যাদের করবার তারা ঠিকই করবে। তারা ঠিকই খোঁজ করছে। রক্তের টানেই খোঁজ করছে। [পৃ. ৬১]

কিন্তু বিচারের পূর্বেই যেন মৃত্যু তাড়া করে ফিরে জমির খাঁকে। সে তার অতীত কর্ম যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান। তার হাতে নির্যাতিত কিংবা তার সহযোগিতায় ধর্ষিত-লাঞ্ছিত যুবতী নারীর অসংখ্য চিৎকার তাকে তাড়া করে। জীবনবাদী-দূরদর্শী গল্পকার গল্পের পরিণতিতে জমির খাঁর অতীত-বর্তমান অবস্থাকে যেমন একই সূঁতায় বেঁধেছেনÑ তেমনি সদর্থক এবং আলোকিত সময়ের প্রত্যাশাও উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কন করেছেন।

জমির খাঁ ভয়ানক একা হয়ে পড়েছে। অহর্নিশি ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত একটি লাশের ছায়া চোখে ভাসে। নিজেকেই প্রশ্ন করে-লাশটি কার?  ভুল করে দুপুর রাতে ডোবাটার নিকটে ছুটে যায়। সেখানে যেন একটা বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে। জানাজা হয়নি। কবর হয়নি। লাশটাকে ঘিরে এক ঝাঁক শকুনের উল্লাস। শকুনের শরীরের কদর্য কালিমায়, বক্র ঠোঁটে, কুটিল চোখে, তীক্ষè নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করছে লাশটাকে। নিজের শরীরে লাশের গন্ধ। অসংখ্য লাশ ডোবাটার ভিতর থেকে যেন উঠে আসছে। যুবতীদের লাশ!  অসংখ্য যুবতীর লাশ তাড়া করছে কাউকে। ভয় পেল জমির খাঁ। প্রাণভয়ে দৌড় দিল।

জমির খাঁ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে, একে একে প্রাণ নিয়ে কোমর সোজা করে দাঁড়াচ্ছে যুবতীরা। এবার অসংখ্য যুবতী একজোট হয়ে চিৎকার করতে করতে ডোবাটা থেকে উঠে আসছে এবং জমির খাঁকে ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। যুবতীদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাল নিশানা। যুবতীদের চেহারা বীভৎস। কারো স্তন নেই, কারো স্তন থ্যাতলানো, কারো স্তনের বোঁটা ছেঁড়া, কারো চোখ বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে, কারো বুকে-পিঠে নখ-দাঁতের দাগ কাটা, অনেকের যৌনাঙ্গ ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে, কারো যৌনাঙ্গ বেয়নেটের খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত!

পূব আকাশে নতুন একটি লাল সূর্য উঠেছে। সকালের লাল রোদ গহরডাঙ্গার ঘরে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উন্মত্ত শকুনের দল চিৎকার করতে করতে খোলা মাঠ দিয়ে উড়ে এসে ডোবাটার পাড়েই নামছে। [পৃ. ৬২]

অসংখ্য চিৎকার গল্পটির নামকরণে লেখক অসংখ্য মানুষের সমবেত কণ্ঠস্বরকেই প্রতিকায়িত করেছেন। এ-কণ্ঠস্বর মূলত যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবীকে জোরালোভাবে ঘোষণা করার প্রত্যয়। অবশ্য ইতোমধ্যে গল্পকারের প্রত্যাশিত সমবেত কণ্ঠের উদ্বোধন ঘটেছে এবং সাথে সাথে যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াও সংঘটিত হয়েছে।

পোড়োবাড়ি মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর গল্পগ্রন্থের নাম চিহ্নিত পোড়োবাড়ি মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর গল্পে চন্দন আনোয়ার রোমাঞ্চ, ম্যাজিক রিয়ালিজম, অতিবাস্তবতার সমন্বয়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবীকে জোরালো করে তুলেছেন। এ-গল্পের উদ্দিষ্ট স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার। গল্পে ছিয়াত্তর বছরের জুলমত বয়াতি, প্রবীণ জৈনুদ্দিন এবং তাঁদের সঙ্গে গ্রামের সকল নারী-পুরুষ, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কলেজ-শিক্ষক, তরুণ শিক্ষার্থীরা সমস্বরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সংঘবদ্ধ।

গল্প-বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে ১৯৭১ সালে সাদুল্যাহ মৃধা এবং বারেক মুন্সি ছিল স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী। তাদের অপকর্মের স্বাক্ষী গ্রামের অনেকেই। তাদের দাপটের কাছে এতদিন গ্রামের মানুষ ছিল অসহায়। কিন্তু সময়ের পালাবদলে এবার সর্বসাধারণ জাগ্রত হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে। লেখক জুলমত বয়াতির জবানিতে যুদ্ধপরাধীদের জন্য সৃষ্ট আদালতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। যেমনÑ

নরখাদক! নরপিশাচ! কুত্তার বাচ্চা! বিচার অইবো তোর! আদালত বানাইতাছি আমি! দাঁড়া! আদালত! হেই আদালতের জজ আমি। আমি Ñ আমি জুলমত বয়াতি! স্কুল মাস্টারের বেতের মতো চিকন নির্মাংস হাত শাসনের ভঙ্গিতে একবার উঠায়, একবার নামায়। [পৃ. ৫৪]

প্রকৃতপক্ষে চন্দন এখানে যে আদালতের কথা বলেছেনÑ তা আসলে বাস্তবের জারক রসে সিদ্ধ। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের জন্য ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার আদালত গঠিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই গঠন করা হয় “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল”; ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহিদ জননী জাহানারা ইমামের [১৯২৯-১৯৯৪] নেতৃত্বে গঠিত হয় “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” এবং ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল”। স্মরণীয় যে- এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

গল্পকার অতি সুকৌশলেÑ একটা ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করে নৃপেণ বিশ্বাসকে হাজির করেছেন তাঁর পোড়োবাড়িতেÑ যে বাড়িতে সে ১৯৭১ সালে সপরিবারে নৃশংসভাবে নির্যাতিত এবং নিহত হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় এলেই স্বাভাবিকভাবেই বাড়িটার পরিবেশ গ্রামবাসীর মনে ভিন্ন সম্মোহন জাগায়Ñ ভিতর থেকে কী সব আওয়াজ বের হয়Ñ জঙ্গলাকৃতি বাড়ির মধ্য থেকে সাপগুলো বাড়ির দখল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। নৃপেণ বিশ্বাসকে চল্লিশ বছর পরে  সেই পোড়োবাড়িতে আবিষ্কার করে ছদেরের ছেলে ছামাদ। আতঙ্কিত ছেলেটা গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত তীব্রভাবে দৌড়ে সংবাদটি পরিবেশন করেই বোবা হয়ে যায়। গল্পকার জানিয়েছেনÑ Ôনৃপেণ বিশ্বাস ফিরেছে কি ফেরে নাই, এই সত্যাসত্য যাচাই করার সুযোগ নেই। কিন্তু ছেলেটি যে মিথ্যা বলেনি, এর প্রমাণ ধূমায়িত বাতাস আর ধূপপোড়ার গন্ধ। [পৃ. ৫২] নৃপেণ বিশ্বাসের ফিরে আসার বিষয়টি আরো বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আধা-পাগলা (?) জুলমত বয়াতির ভাষ্যেÑ

জুলমত বয়াতি ওদের থেকে পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তারপরে সেও কণ্ঠ শাণিয়ে বলে, সত্যি মানে! ডাহা সত্যি! আগুনে পোড়াইলে মানুষ মরেনি? আগুনে পোড়াইলে মানুষ মরে না। মানুষ জিন অইয়া যায়। জিন আগুনের তৈরি না? বিশ্বাসের জিন এই বাড়িডা পাহারা দেয়। তোমরা আউজকা দেখলা! আমি চল্লিশ বছর ধইরা তারে দেইখা আইতাছি! আমি কই নাই! গোপন কথা ফাঁস কইরা দিল কলেজের ছেলেগুলা। হের লাইগাই তো বাড়িটার দিকে চাইলে চোহে আগুন জ্বলে! [পৃ. ৫৮]

নৃপেণ বিশ্বাসের পরিবারের উপর অমানবিক নির্যাতনের জন্য পাকসেনাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল সাদুল্যাহ মৃধা এবং বারেক মুন্সি। সেদিনের সেই অমানবিক-নির্মমতার স্বাক্ষী প্রবীণ জৈনুদ্দিন। তার ভাষ্যে সেদিনের ঘটনা-

আমি হের ন্যাংটাকালের বন্ধু। হেইদিন নিশুতি রাইতে কেডা পাক আর্মি নিয়াছিন হের বাড়ি, এইসব কিছু-ই কইলো না? হের স্কুলে পড়া মাইয়াডারে কেডা তুইল্যা নিল? কলেজ পড়া বড় মাইয়াডারে কেডা ব্যবহার কইরা ফালাইয়া গেছিন? হের আগুনের লাহান বউডার কী অইলো? কেডা ঘরে আগুন দিল! কামের মাইয়া হরিদাসীর যোনিতে কেডায় দাউ ঢুকাইছিন!” [পৃ. ৫৬-৫৭]

জৈনুদ্দিনের বক্তব্যে সাদুল্যাহ মৃধার যুদ্ধপরাধী-বিষয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। আবার সাদুল্যা মৃধার বক্তব্যে বারেক মুন্সির যুদ্ধপরাধীর ভূমিকাও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়Ñ “শালার মুন্সি! পাক ভাইরা বিশ্বাসের মাইয়া-বউ নিয়া ...। আর তুমি এই ফাঁকে মজা নিতা গেলা বিশ্বাসের কামের মাতারির! মাতারির দাউরের কোপ খাইয়া শালা মুন্সি হেইদিন মরলেই ভালো করতা!” [পৃ. ৫৬]। প্রায় বছর চল্লিশ বছর পূর্বের পরিত্যক্ত নৃপেণ বিশ্বাসের বাড়িতে হঠাৎ একদিন ধূপপোড়ার গন্ধে গ্রামে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। জুলমত বয়াতির ÔপাগলামিরÕ মাত্রাও বৃদ্ধি পায় এবং সাদুল্যার উপস্থিতিতে সে মড়া মানুষের গন্ধ পায়। কাদুর দোকানে চা পান করতে গিয়ে জুলমত বয়াতির আদালত সৃষ্টির প্রসঙ্গে মৃধা প্রচণ্ড আক্রোশ প্রকাশ করে। জুলমত বয়াতির গণআদালতের সমর্থনে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারে জন্য তরুণ ছাত্রদল এবং যুবক শিক্ষক গ্রামে পদার্পণ করে মুক্তিফৌজের প্রতীকে। লেখক দশ-বারো জনের তরুণবাহিনীকে গ্রামে উপনীত করার মধ্য দিয়ে সারাদেশব্যাপী স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে গণসংযোগ স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে খইল্যা মাতব্বরের তির্যক কথার বাণে, তরুণ ছাত্রের সাথে বিতর্কে, পাঁঠাকাটা বিলের ধার দিয়ে অগ্রসরমান দশ-বারো জন ‘নয়া মুক্তিফৌজের’ আগমনে সাদুল্যা মৃধা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মৃধা বুঝতে পারে জনতার আদালতে এবার তার বিচার হবেÑ ‘মউত আগাইয়া আইছে!’ আবার সে মনে মনে ভাবে Ôশালার গুষ্ঠিসুদ্ধা ছাপ কইরা দিলাম না কেরে! গণ্ডগোলের মধ্যে সুযোগ ছিল।Õ

গ্রামবাসীর তুমুল আগ্রহ আর আতঙ্কের মধ্যে গভীর রাতের নিস্তব্ধ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ভেসে আসে ফাঁসলাগা কণ্ঠের একটি আর্তিÑমাইরা ফেলাইলো রে! আমারে মাইরা ফেলাইলো! আমারে বাঁচাও! আমারে বাঁচাও।Õ অবিরত একটি আর্তি ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ করার গোঙানিতে রূপান্তরিত হয়। প্রবীণ জৈনুদ্দিন সে-চিৎকারে ঘর থেকে বের হয়। টিমটিমে হারিকেনের আলোয় সে দেখতে পায়Ñ জুলমত বয়াতি গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে নির্বিকার নিষ্কম্পকণ্ঠে আর্মির কমান্ডারের মতো কাদের যেন ফাঁসির রায় পড়ে শোনাচ্ছে তার কাল্পনিক আদালতে। মধ্যরাতে জৈনুদ্দিনের গগনবিদারী আহ্বানে একে একে গ্রামের মানুষ বয়াতির রচিত ‘শেখের গান’ শুনতে উপস্থিত হয়। জনগণের এ-উপস্থিতি লেখক রূপক অর্থে তুলে ধরেছেন। আসলে জনগণের সমবেত হওয়ার এই প্রতিচ্ছবি চন্দন আনোয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীকেই জোরালো করেছেন। দূরদর্শী-সাহসী লেখকের কলমে আঁচড়ে এ যেন শাহবাগ আন্দোলনেরই পূর্ব প্রস্তুতির প্রতিচ্ছবিই অঙ্কিত হয়েছে। গল্পকারের ভাষায়Ñ

একটি সাংঘাতিক হাঁক প্রথমে শোনা গেল পশ্চিমের সৈয়দের বাড়ির দিক থেকে। দ্বিতীয় হাঁকটি শোনা গেল পুবের হেকিম ভুঁইয়ার বাড়ির দিক থেকে, উত্তরের ছালামের হাঁকটি এসে মিশে গেল দুইজনের হাঁকের সাথে, দক্ষিণের কুণ্ডু সাহার হাঁকটি বিলম্বিত হলেও তিনটি হাঁকতে ধরতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। এবার চারদিকে অসংখ্য হাঁক শোনা যাচ্ছে। নারীকণ্ঠও আছে। সবগুলো হাঁক এক হয়ে এখন একটি ইউনিট চিৎকারে পরিণত হয়েছে। চিৎকারটি ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে আসে। এখন আর একক কোনো কণ্ঠস্বর        শোনা যায় না। নারী-পুরুষ আলাদা করা যায় না। [পৃ. ৫৮]

জুলমত বয়াতি, প্রবীণ জৈনুদ্দিনসহ গ্রামের মানুষের রাত্রিজাগরণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জাগরণের প্রতীকে এবং জনগণের সমস্বরকে বিচারের দাবীর প্রতীকে ব্যঞ্জিত। গল্পপরিণতিতে গল্পকার একটি অতিবাস্তব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সাদুল্যাহ মৃধা এবং বারেক মুন্সির ফাঁসির বিষয়টিকেই ইঙ্গিতময় করে তুলেছেন। একাত্তর সালে পাকসেনা এবং তাদের দোসরদের আগুন দেওয়া পুড়ে যাওয়া নৃপেণ বিশ্বাসের পোড়োবাড়িতেই যেন যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় :

জুলমত বয়াতির একতারায় টুং টাং শব্দ করে হায় করে উঠতেই চিৎকার থেমে তৈরি হলো একটি ম্যাজিক নীরবতা! কিন্তু এই নীরবতাকে এক কোণে দুই ভাগ করে ফেলে নৃপেণ বিশ্বাসের পোড়োবাড়ির ভিতর থেকে আসা একটি মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর। সকলকে কাঁপিয়ে জনমের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলে কণ্ঠস্বরটি। কয়েক মুহূর্ত বিরতিতে আরো একটি কণ্ঠস্বর একইভাবে সকলকে কাঁপিয়ে নীরব হয়ে গেল। [পূর্বোক্ত]

যুদ্ধপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ গল্পে। গল্পে একাত্তরে সপরিবারে নিহত হওয়া নৃপেণ বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে চন্দন আনোয়ার শহিদদের আত্মার অবিনাশী শক্তি এবং সেই শক্তিকে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্যে সমবেত শক্তিতে রূপ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে আমরা লেখকের উদ্দিষ্টের সফল বাস্তবায়ন লক্ষ করি “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল”-এর মাধ্যমে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তি হওয়ার প্রক্রিয়ায়।

পোড়োবাড়ি মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর গ্রন্থের  পালিয়ে বেড়ায় বিজয় গল্পে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার করুণ কাহিনিকে উপজীব্য করা হয়েছে। এ-গল্পে মূলত পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক উত্থান এবং একই সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধার সামাজিক বাস্তবতার চিত্র স্থান পেয়েছে।

গল্পবর্ণনা থেকে জানা যায়Ñ দক্ষিণপুরের রহম আলি যুদ্ধ করেছিল স্বাধীন দেশের জন্য, “যেখানে ফুরফুরে বাতাস! ভাইয়ে ভাইয়ে দেশ! খানসেনা নেই। রাজাকার নেই! ... শুধু এক টুকরা স্বপ্ন। হের পোলাপাইনরা স্বাধীন দেশে জন্মাব। মনের মতো কাঁদব! হাসব! খেলব! চলব!” কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তীকালে রহম আলির সব স্বপ্নই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। রাজাকার ছানা মিয়ারা এখনও স্বাধীন দেশে বুক ফুলিয়ে বেড়ায় এবং রহম আলির পঙ্গু পায়ের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়। রহম আলি আত্মযন্ত্রণা বেড়েই চলেÑ তার মনে হয় বঙ্গবন্ধুর মতো যদি কেউ আরেকবার ডাক দিতোÑ তাহলে প্রথমেই সে Ôগুলি ঢুকিয়ে থেঁতলা করে দিত ছানা মিয়ার বুক।Õ

মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি স্বাধীন দেশে জীবিকার তাগিদে তেত্রিশ বছর ধরে পঙ্গু হয়ে যাওয়া বাম পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডিম বিক্রয় করে। স্ত্রী জরিনা আলসারের রোগী, বড় ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টেসে কাজ করে এবং ছোট ছেলে ভ্যান চালায়। স্বাধীন দেশে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা রহম আলিকে কেউ চেনে না, সম্মান করে না, খোঁজ নেয় নাÑ এমনকি তার নামেরও বিকৃতি ঘটে ‘ল্যাংড়া রইম্মা’ নামে। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করেছিল সময়ের পালাবদলে আজকে তারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতÑ তাদের গাড়িতে আজ স্বাধীন দেশের পতাকা শোভা পায়। Ôরহম আলির ঠ্যাঙের বিনিময়ে কেনা স্বাধীনতাÑ রণজিতের রক্তে কেনা স্বাধীনতা’Ñ এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের দৌরাত্মা রহম আলি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসীÑঅস্বীকৃত রাজনৈতিক দল ও যুদ্ধাপরাধীদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রহম আলিকে পুরস্কার ও সংবর্ধনা দেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পঙ্গু-মুক্তিযোদ্ধা রহম আলিকে সংবর্ধনা আয়োজনের পিছনে সক্রিয় ছিল স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর অপকৌশল। স্বাধীনতাবিরোধীরা মানুষেরা মন থেকে তাদের অতীত কর্মকে ভুলিয়ে দিতে তাদের সহযোগী হিসেবে সম্পৃক্ত করে প্রশাসনযন্ত্রকে। এ-সংবাদে মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি দারুণভাবে মর্মাহত হয়। আত্মযন্ত্রণায় ভুগতে থাকাÑ সংবর্ধনা গ্রহণে অস্বীকৃত রহম আলির মনের গভীরে ভিন্ন চিন্তা জাগ্রত হয়। তিনি কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি ভুলতে পারেন না। গল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কোনো চিত্র নেইÑ শুধু রহম আলির গভীর দুঃসহ স্মৃতি হিসেবে দুই বার যুদ্ধসময়ের চিত্র পাওয়া যায়। যেমনÑ

ক. এই যুবতী রহম আলির গুলিবিদ্ধ পায়ে ছেঁক দিয়েছিল রাতভর জেগে। এ খবর ফাঁস হলে সেখানকার এক রাজাকার যুবতীকে তুলে দিয়েছিল খানসেনাদের হাতে। ওরা রাতভর ব্যবহার করে যুবতীর নিথর দেহ ফিরিয়ে দেয় ঐ রাজাকারদের কাছে। তখনো প্রাণ ছিল। অর্ধমৃত যুবতীর যোনিপথে বাঁশ ঢুকিয়ে রাস্তার তে-মাথায় তিনদিন তিনরাত রেখেছিল। রহম আলির           আরো দুই সহযোদ্ধা গিয়ে গভীর রাতে দাফন করেছিল যুবতীকে। [পৃ. ৩৮]

খ. ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়িবহরের লাইট লক্ষ্য করে রাস্তার নিচের জমি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ফায়ার করতে করতে যাচ্ছিল রহম আলিরা। পাল্টা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছিল ওরা। হঠাৎ রণজিৎ লুটিয়ে পড়ে রহমদা রহমদা বলতে বলতে। রহম আলি অন্ধকারের মধ্যেই কণ্ঠের আওয়াজ ধরে ধরে খুঁজে পেয়ে জড়িয়ে ধরে গুলিবিদ্ধ রণজিৎকে।       অস্ফুট করে বারকয়েক মা, মা এবং দু থেকে তিনবার মালতি মালতি বলে নিশ্চুপ হয়ে যায় রণজিৎ। [পৃ. ৩৯]

আত্মস্বীকৃত রাজাকার ছানা মিয়ার ক্ষমতার দাপটে চরম নিঃসহায়তার পতিত হয় মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি। যেদিন ছানা মিয়ার সাথে তার দেখা হয়Ñ সে রাতে রহম আলি ঘুমাতে পারেনা। মনে হয় গভীরে জমে থাকা কষ্টগুলোকে বুক থেকে এক খাবলায় নখ দিয়ে টেনে তুলে ফেলবে। আক্রোশে-ঘৃণায় রহম আলি নিজের চোখ নিজেই উপড়ে ফেলতে চায়। তার মনে হয় সেদিন গুলি তার পায়ে না ঢুকে যদি চোখে ঢুকতো তাহলে সে আজ অন্তত একটু শান্তি পেতোÑ স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎরতা দেখতে হোতো না। গল্পকার রহম আলির অন্তর্বেদনার চিত্র এঁকেছেন এভাবেÑ

কম্পমান শরীর জাপটে শোয়াতে গেলে লাফিয়ে ওঠে রহম আলি।Ñ দাও দে! বুক ফাড়ুম! দাও দে! আমি মুক্তিযুদ্ধ করছি, এই মিথ্যা অহংকার বুক ফাউড়া বাইর করুম। আর কত পালাইয়া বেড়াইয়াম। পঁচাত্তর সালে পরে হেই যে পালাইয়া বেড়াইতাছি, আর কত ...। বলে জরিনাকে কামড়ে আছড়ে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে রহম আলি। [পৃ. ৪১]

সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলরে সবাই রহম আলিকে রাতারাতি ÔভিআইপিÕর চোখে দেখেÑ আশ্চর্য হয়। রহম আলির নিকট অনেকে নানা তদবির নিয়ে আসে মন্ত্রীর কাছে বলার জন্য। অথচ তেত্রিশ বছর ধরে রহম আলির বুকে এক বোবাকান্না বয়েই চলেছে। দারিদ্র্যজর্জরিত রহম আলি পরিবারÑ কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার গৌরবে সে গৌরবান্বিতÑ মনে মনে কারো নিকট থেকে কিছু হাত পেতে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। তাই সে তার স্ত্রী জরিনাকে জানায়Ñ

হেরা আমারে কিনতে চাইতাছে! মুক্তিযোদ্ধা রহম আলিরে কিনতে চাইতেছে! রাজাকার নিয়া সরকার করছে না! তুই ত খবর রাহোছ না। এই চেয়ারম্যান কেডা! এই যুবক ছ্যামড়ারা কার দলের লোক? ওসি কার বন্ধু? সব ছানা মিয়ার লোক রে বউ! সব ছানা মিয়ার খেউল! দেশটাই হেরার ওহনে! রহম আলির চোখ দিয়ে রক্তের মতো লাল অম্রু গড়িয়ে পড়ে। লুঙি দিয়ে মুছতে মুছতে বলেÑ কিছু পাওয়ার লোভে যুদ্ধ করি নাই রে বউ। [পৃ. ৪০]

রহম আলি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জীবন গেলেও সে কারো কাছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাত পাততে পারেনা। দারিদ্র্যনিপীড়িত অসহায় জীবনে সুখের প্রলোভনে স্ত্রী জরিনার অন্যের কাছে হাত পাতাকে তিনি তীব্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন :

রহম আলি বউয়ের লোভাতুর চকচকে চোখে তেত্রিশ বছরের পোড় খাওয়া জরিনাকে খোঁজে। আচমকা জখম বাঘের মতো হুংকার দিয়ে ওঠে-আমারে হাত পেতে ভিক্ষা লইবার কইলি? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? অ্যা! কথা কইস না কেরে? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? তুই না মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির বউ। তুই এতো নীচ! এতো লোভ ভিত্রে তোর! ছি জরিনা! ছি! রহম আলি এলোপাতাড়িভাবে থুথু ছিটাতে লাগল জরিনার স্বপ্নকাতর চোখে-মুখে। [পৃ. ৪১]

আত্ম-অবমাননার তীব্র যন্ত্রণায় চরম অস্থির রহম আলির ঘর-বাইর এক হয়ে যায়। অবশেষে সংবর্ধনা নেওয়ার পরিবর্তে পালিয়ে যাওয়াকে রহম আলি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। অভিমান-ক্রোধ-হতাশা এবং মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধের গৌরব বুকে ধারণ করে সে সংবর্ধনা আগের রাতে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে স্ত্রী জরিনাকে সাথে নিয়ে অজানার পথে পালিয়ে যায়।

কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত। কৃষ্ণকায় অন্ধকার চারদিক। বিলের মাঝখান দিয়ে আলপথ ধরে আগে হাঁটছে জরিনা। পেছনে হাঁটছে রহম আলি। জরিনার এক হাতে কাপড়ের গাঁটরি, অন্য হাতে ধরে আছে রহম আলির এক হাত।

অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছে না। [পৃ. ৪২]

রক্তেকেনা একটি স্বাধীন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার যে অবমাননা এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎরতায় ক্ষুব্ধ লেখকও গল্প শেষে প্রশ্ন তোলেনÑ ‘এভাবে আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবে আমাদের বিজয়?’ মূলত ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পে স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সন্তান একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির সংক্ষোভ অন্য অর্থে প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে।

পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর গ্রন্থের ‘একটি পুকুর মরে যাচ্ছে’ গল্পে লেখক ১৯৭৫ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার অস্থির কালপ্রবাহকে তুলে ধরেছেন। এ-গল্পে একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে দুই স্ত্রীর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা এক অর্থে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতা দ্বন্দ্বÑ আবার অন্য অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার প্রতীক হিসেবেও গল্পে স্থান পেয়েছে।

গল্পের প্রধান চরিত্র ধ্যানযোগী ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের সওদাগর আলি। দুই স্ত্রী রাহেলা-জমিলা এবং চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তার দাম্পত্যজীবন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জমিলার ভাই ছিল কুখ্যাত রাজাকার। গলায় ছুরি ধরে রাজাকারটি তার বোন জমিলার সাথে জোরপূর্বক সওদাগরের বিয়ে সম্পন্ন করে। দেশ যেদিন স্বাধীন হয় সেদিনই বড় স্ত্রী রাহেলা স্বামীর ঘরে আসে। অবশ্য স্মরণীয়Ñ এসময় দ্বিতীয় স্ত্রী কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বলা সঙ্গত সওদাগর দুই স্ত্রীকে সাথে নিয়ে সুখেই ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে সওদাগরের দাম্পত্যজীবনে চরম অশান্তি নেমে আসে জমিলার রাজাকার ভাইয়ের প্রত্যাবর্তনে। জমিলার ভাইয়ের পরাজয়ের যন্ত্রণাক্ত ক্রোধ-রক্তচক্ষু সওদাগরের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেÑ অন্য অর্থে তাকে বোবায় পরিণত করে। এতদিন দুই সতীনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি না হলেও রাজাকার-ভাইয়ের আগমনে জমিলার ব্যবহারে আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ করে সওদাগরÑ

শরীরের নানান ভাষা তৈরি করে জানিয়ে দেয়, এই সংসারের নেতৃত্ব এখন তার। দুবার করে ভাইয়ের মতো চোখ করে রাহেলার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। পাল্লা করে স্বামীর ঘরে যাওয়া, সব কিছু সমান ভাগাভাগি, এসব গণতন্ত্র আর এ সংসারে চলছে না।

এতদিন রাহেলাকে বুবু বলে ডাকলেও এই প্রথম রাহেলাকে নাম ধরে কথা বলল জমিলাÑ রাহেলা, তুমি নামাজ পইড়ো হে। [পৃ. ৬৭]

স্মতর্ব্য যেÑ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের পথে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। এদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিপথগামী একদল সৈন্যের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। এরপর আরম্ভ হয় সামরিক শাসনে রাষ্ট্রের পথচলা; এ কালপর্বেই গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়। উপরিউক্ত উদ্ধৃতিগুচ্ছে সওদাগরের সাংসারিক জীবনে গণতন্ত্রের পতনকে গল্পকার রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে একীভূত করেছেন। জমিলার ব্যবহারের আকস্মিক পরিবর্তন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, সামরিক শাসন ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রুদ্ধ করাকেই  চন্দন চিহ্নিত করেন।

সওদাগরে সংসারের সুখ-শান্তি ভাঙনের চূড়ান্ত রূপ লাভ করে জমিলার রাজাকার ভাই কর্তৃক উঠানের মাঝখানে একটি করবী গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে। উল্লেখ্যÑ করবী গাছে যে বিচি হয়, তা বিষের আধার। রাজাকার খুবই পরিকল্পিতভাবে সওদাগরের সংসারে বিষবৃক্ষ রোপণ করে এবং জমিলা বলে তাতে নিয়মিত পানি দেওয়ার জন্য। রাজাকার জমিলাকে উত্তরের ভিটা এবং রাহেলাকে দক্ষিণের ভিটা ভাগ করে দেয়। গল্পের ঘটনাস্রোতে এই বিভাজন রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষকেই নির্দেশ করে। তবে এই বণ্টন-ব্যবস্থার মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হয় বাড়ির উত্তর-দক্ষিণ অংশ জুড়ে থাকা পুকুরটিকে কেন্দ্র করে। তবে এই পুকুরটিও একদিন জমিলার অধিকারে দিয়ে যায় তার রাজাকার ভাই। এই ঘটনা আসলে বঙ্গবন্ধু মৃত্যু-পরবর্তী রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রভাবকেই স্পষ্ট রেখায় প্রতিকায়িত করেছেন গল্পকার। সওদাগর তার সংসারে বিভাজন প্রক্রিয়ায় বরাবরই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে; এভাবে কেটে গেছে ষোল বছর। এরই মধ্যে রাহেলা শক্তিসঞ্চয় করেছেÑ তার ছেলেমেয়ে দুটি কলেজে পড়ে। এরই মধ্যে মেয়েটার বিয়ে হয় এক পুলিশ অফিসারের সাথে। রাহেলা এবার পুকুরের অর্ধেক দাবি করে স্বামীর কাছে তার অধিকারের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরে। রাহেলার ভাষায়Ñ “পুকুর ষোল্ল বছর হেই খাইছে, আমি ষোল্ল বছরই খাইয়াম, দেহি কেডায় ঠেহায়।” [পৃ. ৭০] এখানে আবারও স্মরণীয় যেÑ ১৯৭৫-এর মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পরবর্তী ১৬ বছরের অধিককাল সামরিক, আধা-সামরিক বা ছদ্ম সামরিক শাসনে দেশ পরিচালিত হয়েছে। আদর্শগত দিক থেকে শাসকশ্রেণি সুচতুরভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির অঙ্গীভূত করা হয়েছে। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক হত্যাযজ্ঞ, সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান, গণতন্ত্রের লেবাসে সামরিক শাসন, এ ছিল এ-সময়ের রাজনৈতিক বিবর্তন। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজের তীব্র আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকার পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটে। দীর্ঘ সেনাশাসনের অবসানের পরে বাংলাদেশ নিয়মতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়।

ষোল বছর পরে মুক্তিযোদ্ধার কন্যা রাহেলার ঘুরে দাঁড়ানোকে সওদাগর মনে মনে সমর্থন করলেও তা প্রকাশ করতে পারেনা। পুকুর নিয়ে দুই স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সাংসারিক চরম অশান্তির মধ্যে সওদাগর বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বিশ বছর পরে সওদাগর তার পুকুরের খবর নিতে যায়। সেই পুকুরটি এখন মুমূর্ষু অবস্থাÑ কালো-পচা কিছু পানি তলানিতে মরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, পাড়গুলো ভেঙে মজে অর্ধেক হয়ে গেছেÑ চারপাশের সারিবদ্ধ গাছগুলো আর নেই। সওদাগর তার বড় স্ত্রীর ছেলের নিকট থেকে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেÑ

পুলিশ এসে নাকি ভাগ করেছে। দুই বছর করে এক বউয়ের দখলে থাকবে। এখন বড় বউয়ের দখলে আছে। ... গেছে দুই বছরে মা-ছেলেরা [ ছোট বউ জমিলা এবং তার ছেলেরা]  মিলে পুকুরের গাছপালা সব কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। জানেন, পুকুর পাড় কেটে মাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। গোটা পুকুরটা বিক্রির ষড়যন্ত্র করেছিল।

... পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়েই সেই করবিগাছটি দেখা  যায়। আশ্চর্য, এত বছরেও গাছটির একটি ডালও মরেনি। বরং আরো নতুন নতুন ডালপালা গজিয়ে পুরো উঠোনটাকেই নিজের ছায়ার মধ্যে নিয়ে এসেছে। [পৃ. ৭১]

গল্পের পরিণতিতে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের সমার্থক হয়ে ওঠে পুকুরটি। এরসাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির যে বিস্তার ঘটেÑ তা করবিগাছের ডালপালা বিস্তারের প্রতীকে প্রকাশিত। ‘একটি পুকুর মরে যাচ্ছে’ গল্প-কেন্দ্রে সওদাগর আলি থাকলেও লেখকের উদ্দিষ্ট ছিল তার সাংসারিক বিভাজন তথা রাজনৈতিক বিভাজন তথা চেতনাগত বিভাজনকে উজ্জ্বলরেখা ফুটিয়ে তোলা। উপস্থাপন কৌশলের শিল্পগুণে গল্পকারের উদ্দিষ্ট যেমন সিদ্ধ হয়েছেÑ তেমনি বঙ্গবন্ধু মৃত্যুপরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগত টানাপোড়েনও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

চন্দন আনোয়ারের নির্বাচিত ৩০, গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ গল্পটিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-সংক্রান্ত। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আব্দুর রহিমের শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে গল্পকার যুদ্ধপরাধীদের বিচারের আয়োজন করেছেন। আব্দুর রহিমের বাবা যুদ্ধের সময় শহরে কাঁচা তরকারি বিক্রি করতে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়। আবার রহিমের মা তার বাবার সন্ধানে শহরে গিয়ে আর ফেরে না। বাবা-মা হারানো কিংবা হত্যার পিছনে রহিমের সন্দেহের তীর তিন বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান জমির মৃধার দিকে। স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার হয়Ñএকারণে রহিম বিচারে দাবি নিয়ে মৃধার সামনে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।

গল্পে ইঁদুরের উপস্থিতি থাকলেও তাকে লেখক স্বাধীনতাবিরোধী-রাজাকারের প্রতীকে তুলে ধরেছেন। রহিম সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে দো-চালা টিনের ঘরে তুলেছিলÑ কিন্তু সে ঘরে ইঁদুরের উৎপাতে তার জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। রহিমের সাংসারিক জীবনের ইঁদুরের ক্রমাগত উপদ্রব স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা-বিরোধীদের উত্থানের বিষয়টির প্রতি লেখক ইঙ্গিত করেছেন। ইঁদুরদের সাংগঠনিক শক্তির কাছে আব্দুর রহিম বারবার পরাস্ত হয়; ইঁদুর তার গোলার ধান লুট এবং ঘরের মধ্যে কুয়ো সদৃশ পুকুর করছে। ইঁদুরের গর্ত বন্ধ করতে না পারার কিংবা ইঁদুর মারতে না পারার অক্ষমতায় সে তীব্র আত্মদহনে দগ্ধ। ইঁদুরের সাথে পাল্লা দিয়ে রহিমের বউ পর্যন্ত তার অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু আব্দুর রহিম স্বীকার করে তার অসর্তকতার কিংবা তার দয়ার কারণে ঘর তোলার সময় কিছু ইঁদুর বেঁচে যায়Ñ সেখান থেকেই বংশবিস্তার করে আব্দুর রহিমের সাংসারিক জীবনে চরম ভোগান্তি বয়ে এনেছেÑ

কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে পাতি পাতি করে ইঁদুর নিধন করেছিল আব্দুর রহিম। তারপরেও বিরাট অংশই বেঁচে গেছে। তা ঘটেছে মূলত আব্দুর রহিমের নরোম মনের কারণে। সে অবশ্য জানে, শত্রুর কোনো ধর্ম নেই।  শত্রু শত্রুই। ওদের প্রতি মায়া দেখিয়ে সাধারণ ক্ষমতা ঘোষণা দিলেও সুযোগ পেলে ঠিকই কামড়ে ধরবে অস্তিত্ব। সাপের কি ধর্ম আছে? সুযোগ আসলে ছোবল দেবেই। প্রথম কিছুদিনের জন্য ইঁদুরেরা নিজেদের শাসন হারিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। ঘরে ঢোকার সাহসে কুলায়নি। ওরা যে এখনও ঘরের আশেপাশে ঘুরে ফিরে আর সুযোগে সুযোগে থাকে, আব্দুর রহিমের রহমের জোরেই। পালাতে        সুযোগ দিয়েছে সে। পাশের বাঁশ ঝাড় এখন ওদের সাম্রাজ্য। ওরা যখন ক্রমাগত সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে এবং একদিন সদলবলে ঘরে ঢুকে লুটপাট করবে বলে আব্দুর রহিমের ধারণা হচ্ছে তখনই তার চেতন ফিরে। ওদের দয়া দেখিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো কাজ করেছে সে। [পৃ. ১২৮-১২৯]

ইঁদুরের প্রতি আব্দুর রহিমের ‘নরোম মনের’ প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উদারতার সমান্তরালে বিন্যস্ত। ১৯৭১ সালের মহান বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ছোটখাটো অপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা সাধারণ ক্ষমার সুযোগে অল্পকাল পরেই আবার স্বরূপে ফিরে আসে বাঙালি অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিষিয়ে তোলে। এ-গল্পে ইঁদুরের উপদ্রবে আব্দুর রহিমের জীবন বিষিয়ে ওঠার সমান্তরালে ইঁদুর-সদৃশ যুদ্ধপরাধীদের ভূমিকাকে লেখক বিন্যস্ত করেছেন।

আব্দুর রহিম স্বীকার করে তার অসতর্কতার কিংবা তার দয়ার কারণে ঘর তোলার সময় কিছু ইঁদুর বেঁচে যায়Ñ সেখান থেকেই ইঁদুরদের বংশবিস্তার এবং পুনরায় উৎপাতের শুরু। লেখক মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিবেশের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে ইঁদুরের প্রসঙ্গ এনেছেন। ইঁদুর যেমন সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে একটি বাড়ির সুখ-শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করেÑ তেমনি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীরা। গল্পের মূল বিষয়কে চন্দন আলোকিত করেছেন আব্দুর রহিমের দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের মাধ্যমেÑ

আব্দুর রহিম এই প্রথম ভিতরের কষ্টের এক খাবলা সাবিনা খাতুনের মাকে দিয়ে শেয়ার করে। খড়ের মতো খসখসে চুলে আঙুল ঢুকাতে ঢুকাতে বলে বউ, এই ইঁদুর তো আমাদের কান কামড়ে ধরেছে। ঘরের দখল নিতে চায়। আরো বড় ইঁদুর আছে। হেদের বড় দল আছে! দেশ দখলের চেষ্টায় তারা!” [পৃ. ১৩১]

আসলে দেশপ্রেমস্নাত আব্দুর রহিমের সংসার এ বাংলাদেশ। তাই তার মনোবীণায় সবসময়ই দেশের কল্যাণচিন্তা জাগ্রত থেকেছেÑ জাগ্রত থেকেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়া মায়ের স্মৃতিÑবাবার মুখ। স্বাধীনতাবিরোধী জমির মৃধাকে দেখলে তার সেই চিন্তা আরো প্রবল হয়ে ওঠেÑ

কারা যেন দ্রোপদীর শাড়ির মতো আব্দুর রহিমের মা-র শাড়ি ধরে টানছে আটত্রিশ বছর ধরে। সে মায়ের লাল পেড়ে আঁচল দেখতে পায়। মাকে দেখার চেষ্টা করেÑ কিন্তু পারে না। ... ঠিক সেই সময়ে সে দেখে তারই সামনে জমির মৃধা শিকার খাওয়া বিড়ালের মতো মুখ চাটছে জিহ্বায় আর জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। ... বাবার ছবি কিছুতেই স্মৃতিতে আনতে পারে না আব্দুর          রহিম। খুব বেশি একাগ্র হলে শিয়াল কুকুরের খাবলাখাবলির একটি বীভৎস লাশের ছবি দেখতে পায় কোনোমতে। ... আটত্রিশ বছর ধরেই বাবার কথা মনে হলে অন্ধকার দেখে আসছে! তার বাবার লাশটা যেন কেউ আলোতে আনছে না কিংবা আলোতে আনতে দিচ্ছে না! কারা আনবে আলোতে সেই লাশ। [পৃ. ১৩১]

স্বাধীনতার পর জমির মৃধা শুধু সামাজিকভাবেই নয়Ñ রাজনৈতিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত-সংগঠিত। বিজয়ের আটত্রিশ বছর পরে নারীলোলুপ মৃধার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে আসে। এবার আব্দুর রহিমের বড় মেয়ে সাবিনার প্রতি মৃধার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সাবিনার সংলাপে স্বাধীনতাবিরোধী মৃধার নারীলোলুপ চেহারা এবং আব্দুর রহিমের বাবা-মায়ের নির্যাতিতকারী-হত্যাকারী হিসেবে তার প্রকৃত মুখোশ উন্মোচিত হয়Ñ

          তাকে মৃধা চেয়ারম্যান যেতে বলেছে! ...

সাবিনা খাতুন বড় বড় চোখ করে বাপের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি নাকি দাদির লাহান দেখতে অইছি! দাদির লাহান নাকি বুক.সিনা ...। [পৃ. ১৩২]

আব্দুর রহিম এবার সন্দেহ মুক্ত হয় এবং বুঝতে পারে তার বাবা-মার হত্যার পিছনে সক্রিয় ভূমিকা আছে জমির মৃধা। যাবতীয় বৃত্তান্ত শুনে সাবিনার মা বলেÑ ‘দিন ফিরছে। ওদের বিচার হবো।’ আব্দুর রহিম এবার সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে মৃধার সাথে তার সব হিসাব-নিকাশ মেটাতে চায়। বাবা-মা চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আটত্রিশ বছর অপেক্ষার পর সে মৃধার বিচারকার্য নিজ হাতে তুলে নেয়। সে যুদ্ধপরাধী-রাজাকার জব্বর মৃধার মুখোমুখি দাঁড়ায়। মৃধা আব্দুর রহিমকে দেখে খুবই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। রহিমের বাড়ির সেই উপদ্রব করা ইঁদুর তথা দেশের উপদ্রব স্বাধীনবিরোধী জমির মৃধার হত্যার প্রকল্প গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে গল্পটির নামকরণে যেমন চমৎকারিত্ব সৃষ্টি হয়েছেÑ তেমনি লেখকের উদ্দিষ্টও শিল্পসফলতা লাভ করেÑ

সন্ধ্যার অন্ধকার ধেয়ে আসছে। মৃধা চেয়ারম্যান যেনো ভূতের মতো অন্ধকারে বিলীন হতে হতে নাই হয়ে যাচ্ছে। ক্ষীণ হতে হতে নেংটি ইঁদুরের মতোই দেখাচ্ছে তাকে। উ™£ান্ত— হয়ে পালাবার জন্যে গর্ত খুঁজছে সে! এমন করে এলোপাথাড়িভাবে দৌড়াচ্ছে যে, দেয়ালের সাথে দড়াম দড়াম করে হোঁচট খাচ্ছে। জখম কুকুরের মতো আব্দুর রহিমকে কামড়াতে এসে নিজেই খাবি খেয়ে উল্টে পড়ছে। আব্দুর রহিম খুক খুক করে একচোট হেসে নিলো। আটত্রিশ বছর পরে আসল ইঁদুরটাকে বাগে পেয়েছে সে। [পৃ. ১৩৩]

গল্পকার আব্দুর রহিমের আত্মগত চিন্তাপ্রবাহে মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিবেশকে বাক্সময় করে তুলেছেন। আটত্রিশ বছর পরে জমির মৃধার অবস্থা হয় নেংটি ইঁদুরের মতো। ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’-এর প্রতীকে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার জনসাধারণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলেই প্রতীয়মান হয়Ñ আর এখানেই গল্প এবং গল্পকারের সার্থকতা।

হাজার বছরের বাঙালি জীবনের শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত নব্য স্বাধীন দেশের এবং এ নবোত্থিত জাতিসত্তার সকল প্রতিচ্ছবি ছোটগল্পের ছোট ক্যানভাসে ধারণ করা সম্ভব নয়। তবুও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালের গল্পকারগণের মধ্যে চন্দন আনোয়ারের গল্পসমূহ স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক সংবর্ত তথা বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাস্রোত তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তাই তিনি শিল্পের প্রতি এবং শিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকেই সৃজনশীল সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হন। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম এবং লেখক হিসেবে তাঁর গল্পে পাক হানাদারদের বর্বরতা, নারী-নিপীড়ন, পাশবিক সব কার্যকলাপ এসেছে স্মৃতিভাষ্যে। স্বাধীনতাবিরোধী কর্তৃক গণতন্ত্র ও মানবতার বিরুদ্ধে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল ধরানোর চিত্র তার বেশ কিছু গল্পে ফুটে উঠেছে। চন্দনের গল্পে যুদ্ধবিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত, নবজাত দেশটির গঠনপ্রাপ্তির প্রাথমিক চিত্রটিও ধরা পড়েছে। তাছাড়া গল্পে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সদ্যজাত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বহুবিধ অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংকট, স্বাধীনতাবিরোধীদের গণবিরোধী অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ, প্রগতিশীল শ্রেণির উপর আঘাত, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন, যুদ্ধপরাধীদের বিচারের গণদাবী এবং যুদ্ধপরাধীদের বিচারের চিত্র উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত।

 

ঋণ স্বীকার :

১. চন্দন আনোয়ার, অসংখ্য চিৎকার, যুক্ত, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১২।

২. চন্দন আনোয়ার, পোড়োবাড়ি মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪।

৩. চন্দন আনোয়ার,  নির্বাচিত ৩০, একুশ শতক, কলকাতা, ২০১৭।

৪. সাধন চট্টোপাধ্যায়. চন্দন আনোয়ারের গল্পের বার্তা, একুশ শতক, কলকাতা, ২০১৭।

Side banner