kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উমা ও মা দুর্গা


কালচিত্র | ড. শ্যামল কান্তি দত্ত প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২২, ১১:৫৪ পিএম উমা ও মা দুর্গা

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

 

উমা ও মা দুর্গা

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

 

‘উমা যারায়গি নি গো তিন দিন থাকিয়া,

শিবর লাগি কিতা নেরায় কটরা ভরিয়া?’

 

দেবী দুর্গা
ছবি সৌজন্যে: উইকিপিডিয়া

অর্থাৎ, তিন দিন থেকেই চলে যাচ্ছ নাকি গো উমা; শিবের জন্যে কী নিচ্ছ কৌটায় ভরে? সেই ছোট্টবেলা থেকে দশমীর দিনে মনু নদীতে প্রতীমা বিসর্জনের সময় ঢাক-ঝাঁঝরের তালে তালে সমস্বরে গাওয়া গানের কলিটি আজও মনে পড়ে। একালে অবশ্য গান কমে স্লোগান চলে: বল দুর্গা মাই কি, জয়। সেকালে দশমীর ভোরে ঘুম থেকে জেগে পুজোর ফুল তোলা শেষে কাগজে একশ’ আটবার ‘শ্রীশ্রীদুর্গা’লিখে দেবীমূর্তির চরণে দিতাম মায়ের আশীর্বাদের আশায়। ভাসানের সময় গানের শুরুতে উমা নাকি ওমা বলতাম তাও ঠিক মনে পড়ে না। অবশ্য একালেও ‘উমা’ নাকি ‘ওমা’ এ নিয়ে লোকগানের শিল্পীদের মধ্যে দ্বিমত আছে। সিলেটি ভাষার উচ্চারণে ‘ও’ ধ্বনির উপস্থিতি অতি অল্প। প্রমিত বাংলার ‘তুমি- তোমার সিলেটি ভাষায় ‘তুমি-তুমার’ হয়ে যায় যে-কারণে; সে একই কারণে অতিশুদ্ধি প্রবণতা থেকে ‘উমা’ বদলে ‘ওমা’/ ‘অ মা’ হতে পারে। এতে অবশ্য ভাবের তেমন পার্থক্য ঘটে না। তবে উমা কেমন করে মা দুর্গা হলেন সে সূত্র অন্বেষণই বর্তমান আলোচনার লক্ষ্য। প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় সমাজে শক্তির দেবী বা নারী মূর্তি পরমা প্রকৃতিরূপে পূজিত হয়েছেন বিভিন্ন নামে ও রূপে। বাঙালি সমাজে তিনি দুর্গা নামে পূজিত। দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া এবং নারীরূপে বিশ্বের পরম শক্তির প্রকাশ। মহিষ-মর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে বিভিন্নভাবে তাঁর পূজা হয়ে থাকে।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে অবাঙালিরা ভিন্ন ভিন্ন নামে দুর্গাপূজা করেন। যেমন, জম্মুতে ‘বৈষ্ণোদেবী’, কাশ্মীরে ‘অম্বা’ হিমাচলে ‘ভীমা’, হরিদ্বারে ‘হরিপ্রিয়া’, গুজরাটে ‘হিঙ্গলা’ ও ‘রুদ্রানী’, রাজস্থানে ‘ভবানী’, অমরকন্টকে ‘চণ্ডিকা’, মিথিলায় ‘উমা’, কর্নাটকে ‘কল্যাণী’ ও ‘জয়দুর্গা’, বিন্ধ্যচলে ‘বিন্ধ্যবাসিনী’, দাক্ষিণাত্যে ‘অম্বিকা’ এবং কন্যাকুমারিকায় ‘কন্যাকুমারী’ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই সমস্ত দেবী শক্তির এক একটা রূপ বলে পরিচিত এবং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বিগ্রহ বা মূর্তি আছে।

বাংলাদেশে যে মূর্তিতে দুর্গাপুজো হয় তা সাধারণ ভাবে মহিষাসুরমর্দিনী রূপ হিসেবে পরিচিত হলেও আদতে এটা একটা মিশ্র রূপ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয় যে বঙ্গ জনপদে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই মূর্তিপুজোর প্রচলন হয়েছিল। সেই সময় কৌম-সমাজে পূজিতা বিভিন্ন দেবী মূর্তিতে যে আদিম মাতৃকা রূপ ছিল, সেগুলিই পরবর্তীকালে পরিশীলিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিবর্তন অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকের মধ্যে ঘটেছে। প্রাক-আর্য্ যুগের যক্ষী, নাগী, অপ্সরা, দোহদ পরিচয়ের নারী মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এদে মধ্যে যক্ষীদের কেশের খোঁপার দু’পাশে বাণ, পরশু, অঙ্কুশ, বজ্র ও ত্রিশূল—এই পাঁচটি ছোট আকারের অস্ত্র দেখা যায়। দেখা গিয়েছে, ওই পাঁচটি অস্ত্রই পরবর্তীকালে দ্বিভুজা, চর্তুভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা বা অষ্টাদশভুজা দেবী মূর্তির হাতে উঠে এসেছে। কোনও ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু অস্ত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রাপ্ত দুর্গার মূর্তিগুলির দু’টি রূপ পাওয়া যায়—মহিষমর্দিনী এবং সিংহবাহিনী। এর মধ্যে সম্ভবত মহিষমর্দিনী রূপটিই প্রাচীন। রাজস্থানের নাগোর থেকে পাওয়া আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের একটি ক্ষুদ্রাকৃতি ফলককে মহিষমর্দিনী রূপের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। সিংহবাহিনী রূপটি সম্ভবত এসেছে ভারতের বাইরে থেকে। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকেই খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে নির্মিত মহিষমর্দিনী ও সিংহবাহিনীরূপী দেবীমূর্তির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ওই সময়কার কিছু পাথরের তৈরি চতুর্ভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি আবার সিংহবিহীন। উত্তরপ্রদেশের নিকটবর্তী ভিটা ও বিহারের বৈশালী অঞ্চলে পাওয়া সিলমোহরের মহিষমর্দিনী মূর্তিতে সিংহ নেই। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, সিংহসহ মহিষমর্দিনী মূর্তি এসেছে সপ্তম শতাব্দী থেকে। অর্থাৎ, বুদ্ধযুগ থেকে হিন্দুযুগে প্রত্যাবর্তনের গোড়ার দিক থেকে মহিষমর্দিনী মূর্তি আস্তে আস্তে সিংহবাহিনী হয়ে উঠেছে। ওই সিংহসহ মহিষমর্দিনী রূপ অনুসরণেই পরবর্তীকালে বাংলার দুর্গামূর্তি গড়ে উঠেছে। বাংলায় কবে থেকে মৃন্ময়ী অর্থাৎ, মাটির মূর্তি তৈরি আরম্ভ হয়েছে তা ঠিক নির্ণীত নয়। পাথরের মূর্তির স্থায়িত্ব অনেক বেশি বলে বহু যুগ পূর্বের মূর্তিও মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় কিন্তু মাটির তৈরি মূর্তি রোদে, জলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে খুব প্রাচীন মৃন্ময়ী প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি পাওয়া যায় কম। অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ার সর্ষবাজ গ্রাম থেকে পাওয়া আনুমানিক তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর অষ্টভুজা সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী রূপের পোড়ামাটির মূর্তিই এখনও পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম মৃন্ময়ী দুর্গামূর্তি। এ ছাড়া পাহাড়পুরে পাওয়া নবম-দশম শতাব্দীর একটা পোড়ামাটির দশভুজা মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। বাংলার শাস্ত্রকারেদের অনেকের বর্ণনাতেই মৃন্ময়ী মূর্তিতে পুজো করার উল্লেখ রয়েছে। বাংলার বর্তমান পুজো পদ্ধতি ও সামাজিক রীতিনীতির প্রবর্তক চৈতন্য সমসাময়িক স্মার্ত রঘুনন্দনের ‘দুগোর্ৎসবতত্ত্ব’ ও ‘দুর্গাপুজো পদ্ধতি’তে মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ার আলোচনা আছে। বাঙালির দুর্গাপূজায় দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকেন তাঁর কন্যা বিদ্যাদেবী সরস্বতী, ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী, পুত্র সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বীর কার্তিক। মাথার উপরে শায়িত থাকেন স্বামী মহাদেব। পায়ের নিচে বাহন হিসেবে থাকে সিংহ। দেবীর হাতে ধরা ত্রিশূলবিদ্ধ অবস্থায় থাকে মরণোন্মুখ মহিষসমেত অসুর। দেবী সত্ত্ব, সিংহ রজঃ আর অসুর তমঃ গুণের প্রতীক। তবে সপরিবার মূর্তি বেশিদিন আগের নয়। হাওড়া-আমতার রাউতাড়া গ্রামে অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি মন্দির টেরাকোটায় পাওয়া যায় সপরিবার দুর্গামূতি, হুগলি জেলার বালি দেওয়ানগঞ্জের জোড়বাংলার ওপর নবরত্ন মন্দিরেও রয়েছে এমন দুর্গামূর্তি। আরেকভাবে বলা যায়, সরস্বতী-কার্তিক-লক্ষ্মী-গণেশযুক্ত দেবী দুর্গার যে সপরিবার মূর্তি দেখা যায় তা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র— এই চার বর্ণকে উপস্থাপিত করে ( গৌতম , 2017)। ভারতীয় পুরাণ-সংস্কৃতিতে সরস্বতী বহুমাত্রিক দেবী হিসাবে পরিচিত। আদিতে সরস্বতীর পরিচয় ছিল উত্তর ভারতের সপ্তনদীর (গঙ্গা, যমুনা, শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও সরস্বতী) অন্যতমা সরস্বতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে। পরবর্তীকালে সেই নদীর দেবতা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে, যা ব্রাহ্মণ্যত্বের প্রতীক। কার্তিক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল তিনি শিব-পার্বতীর দ্বিতীয় পুত্র, রণনিপূণ, ময়ূরবাহন, স্বর্গরাজ্য বা দেবতাদের সেনাবাহিনীর প্রধান। সেই সূত্রে কার্তিক ক্ষত্রিয়ত্বর প্রতীক। বৈদিক শাস্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে লক্ষ্মীর উদ্ভব ও পরিচিতি নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিছু পুরাণ অনুযায়ী লক্ষ্মী দেবসেনা রূপে জন্ম নিয়ে কার্তিকেয়র পত্নী হন। আবার কিছু পুরাণ মতে তিনি গণেশপত্নী। আবার শস্যের দেবী হিসাবে গণ্য হবার কারণে লক্ষ্মীকে ধরিত্রী বা বসুমতী হিসাবেও ভাবা আরম্ভ হয় বলে তিনি বৈশ্যত্বের প্রতীক। পার্বতী-সুত ‘লম্বোদর’ বা ‘গণেশ’ মূলত ভারতের পশ্চিম অংশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেও ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানেও এর পুজোর প্রচলন আছে। ইতিহাবিদ ও ধর্মতত্ত্ব বিশারদদের মতে এই গণেশ বা গণপতি মূলত লৌকিক দেবতা, যাঁর উদ্ভব প্রাগার্য যুগে। লৌকিক দেবতা গণপতি তাই আমজনতা শুদ্রত্বের প্রতীক। বাঙালির দুর্গাপূজার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, দুর্গার মতো শক্তিময়ী, অস্ত্রধারী ও জগদ্ধাত্রী দেবীকে কন্যারূপে ও মাতৃরূপে কল্পনা করা। বাঙালির দুর্গা যেন তার একান্ত ঘরের মেয়েটি যে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুদিনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। পরম শক্তির সংহারক  ভীতিকর রূপের পরিবর্তে তাঁকে আপনজনের মতো কোমল রূপে দেখা, ভয়ের বদলে তাঁকে স্নেহ ও ভক্তি করার মধ্য দিয়ে উপাসনায় উৎসবের যে রূপবদল সেটা বাঙালির একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতিগতভাবে বাঙালি মারমুখী ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের নয়। পলিমাটির মতো তার স্বভাব নম্র। পার্বত্য নদীর মতো খরস্রোতা নয়, বরং মোহনায় বিস্তৃত হয়ে কল্যাণীরূপে প্রবাহিত এদেশের নদীর মতোই বাঙালি ধীরলয়ে প্রবাহিত, উদাসী। ‘দেবী ভাগবত’, ‘মার্কণ্ডেয় চণ্ডী’ ও ‘কালিকা পুরাণ’ অনুসারে: বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতাদের সম্মিলিত তেজে পরম শক্তি নারীরূপে আবির্ভূত হন দুর্গা। সব দেবতা নিজের নিজের অস্ত্র ও তেজ এই দেবীকে দেন। এই শক্তি নিয়ে দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। প্রথম বার অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডারূপে; দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার দশভুজা দুর্গারূপে। এর আগে, পুরাকালে দুর্গ বা দুর্গম নামে অসুর বধ করেছিলেন বলে এবং জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলে তার নাম ‘দুর্গা’। দেবী দুর্গার উপাখ্যান আরও পাওয়া যায় ‘কালীবিলাসতন্ত্র’, ‘মহাভাগবত’, ‘বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’, ‘দুর্গোৎসববিবেক’, ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’ ইত্যাদি বইতে। দেবী-পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র, বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিস্কার করেন দেবীসূক্ত। এই দেবীসূক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। তার মানে দেবীসূক্তের আবিস্কারও করেন একজন নারী। পুরান অনুসারে রাজ্যহারা রাজা সুরথ রাজ্য ফিরে পাবার জন্য বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। তাই এ পূজার নাম হয় ‘বাসন্তী পুজা’। রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য শরৎকালে দেবীর পূজা করেন। অকালে পূজা করেন বলে এর নাম হয় ‘অকালবোধন’। রামায়ণের বাংলা অনুবাদকালে কৃত্তিবাস এ কাহিনি বর্ণনা করেন। শারদীয়া দুর্গাপূজাই তখন থেকে বেশি প্রচলিত হয়। রাজাহারা যুধিষ্ঠির বিপদনাশ ও রাজ্য ফিরে পাবার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে। সবগুলো ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যুদ্ধজয়দায়িনী ও বিপদতারিনী রূপে দেবীর পূজা হয়েছে। দেবী দুর্গা তাই জয়-প্রদায়নকারী ও দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু, একটু ভাবলেই যে কারে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে: দুর্গাপুজোর দুর্গা যাঁকে নিয়ে মেনকার মুখে এত আগমনী গান সে কত কাল ধরে বাঙালি মনকে মথিত করছে! উমা উমা ডাকে কাকে ডাকেন মেনকা ( অমর্ত্য , ২০১৫)? পুরাণ পুরনো কথা, তাতেও উমা দুর্গা নন। রামায়ণে তিনি মহাদেবের স্ত্রী। তাঁর পিতা দেবতাত্মা হিমালয়। মাতা সুমেরুকন্যা মেনকা তথা মেনা। আগমনী গানে মেনা যখন ডাকেন, ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী’, তখন সেই গানের উদ্দেশ্য হিমালয় পর্বতের পাষাণ গলানো। বিধেয় উমাকে বাপের বাড়ি আনা। অর্থাৎ গিরিজাই আসেন ছেলেমেয়ে কোলে কাঁখে, সগৌরবে, বাপের বাড়ি, তিনটি দিনের তরে। তিনি কি দুর্গা? বোধহয় না, ইনি তো পার্বতী। সেই পার্বতী যিনি গিরিরাজের গৃহে রাজার দুলালী হিসেবে যত্নপালিত হয়েও এক ভোলানাথকে পেতে চূড়ান্ত গ্রীষ্মে উষ্ণস্রোতে, কঠিন শীতে ঠাণ্ডা জলে গা ডুবিয়ে, একবেলা খেয়ে, শেষে গলিত পত্র পর্যন্ত না খেয়ে বাজারে অপর্ণার বদনাম কিনে, আর শিবব্রত বা বিয়েপাগলামির শেষ করে ছাড়লেন! মেনাকে পর্যন্ত বলতে হলো, ‘উ মা তপ’, আর তাঁকে নাম দিতে হলো উমা!  আগের জন্মে তিনিই ছিলেন দক্ষের মেয়ে সতী। দক্ষ হিমালয়ের মতো জামাইভক্ত ছিলেন না।  বাড়িতে যজ্ঞ করলেন অথচ মেয়ে-জামাইকে দাওয়াতই দিলেন না। অনিমন্ত্রিত স্বয়মাগতা মেয়ের সামনেও

ভোলানাথের নিন্দা করলেন দক্ষ। অপমানিতা সতী শিবনিন্দা শুনে দেহত্যাগই করে বসলেন। তারপর ‘দক্ষযজ্ঞ’ ঘটল। এক্কথায় ‘রে সতি! রে সতি! কান্দিল পশুপতি পাগল শিব প্রমথেশ’। সতীকে কাঁধে নিয়ে, তাঁর তাণ্ডব দেখে বিষ্ণু তো তাঁর চক্র দিয়ে সতীকে একান্ন টুকরো করে ফেললেন, আর সেখানে এক এক পীঠে এক এক দেবী এলেন। সতীর বিরহে শিব সব কটি পীঠে তপস্যা করলেন বলে সবেতেই একান্ন ভৈরব আর সতীর দেবাংশী একান্ন দেবী। এঁদের কারুর নামে সরাসরি দুর্গা নেই। করবীরপুরে মহিষমর্দিনী (ত্রিনয়ন); করতোয়া তটে অপর্ণা (বামকল্প); বৃন্দাবনে উমা (কেশপাশ); শ্রীহট্টে মহালক্ষ্মী (গ্রীবা); নলহাটিতে কালী (গলার নলী); মিথিলায় মহাদেবী (বাম স্কন্ধ); চট্টগ্রামে ভবানী

(দক্ষিণবাহু); উজানীতে মঙ্গলচণ্ডী (কনুই); কালমাধবে কালী (দক্ষিণ নিতম্ব); কামাখ্যাতে কামাক্ষী (দেবীযোনি); জয়ন্তীতে জয়ন্তী (বাম জঙ্ঘা); কুরুক্ষেত্রে সাবিত্রী (বাম চরণের  চার অঙ্গুলি); বক্রেশ্বরে মহিষমর্দিনী (দেবীমন); যশোরে যশোরেশ্বরী (দেবীর পাণিপদ্ম); কন্যাশ্রমে সর্বাণী (পৃষ্ঠদেশ); ত্রিপুরায় ত্রিপুরেশ্বরী (দক্ষিণ চরণ); ইত্যাদি। তাঁরা সতীদেহী, দুর্গা নন; তবু সনাতন মতে তাঁরা দুর্গা হন। কেনোপনিষদে একটি আখ্যানে আছে দেবাসুরের একটি যুদ্ধে অসুরদের উপর জয় পেয়ে দেবতারা যখন আনন্দে নৃত্য করছেন, তখন এক জ্যোতির্ময়ী নারী নেমে এসে তাঁদের নৃত্যপরতার কারণ শুধোলে দেবতারা নিজের শৌর্য ও পরাক্রম বর্ণনা করার পর তিনি তাঁদের তা দেখাতে বললেন। পরাক্রম দেখাতে ব্যর্থ দেবতাদের হেনস্থা হওয়ার পর জ্যোতির্ময়ী তাঁদের ব্রহ্মজ্ঞান দিলেন। সেই একোহবর্ণ, অদ্বৈত, অনাদি, নিরাকার দেবতাদের সকল শক্তির উৎস দেবী মা দুর্গা। তিনি জ্যোতির্ময়ী তাঁরই প্রেরিতা শক্তিজ্যোতি। এঁকে বাপের বাড়ি আসা হিমালয়কন্যা উমা বা গৌরী কিংবা দক্ষকন্যা সতীর সঙ্গে মেলানোর মতো মুক্তবুদ্ধি দিয়ে বাঙালি হিন্দুগণ

বানিয়েছে তাঁদের শারদোৎসব দুর্গাপূজা। সিলেটের দুর্গাপূজা পদ্ধতি মিথিলার কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘দুর্গা ভক্তিতরঙ্গিনী’-র নির্দেশ অনুযায়ী। তার কারণ সিলেটের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় প্রধানত মৈথিলী ব্রাহ্মণ, উত্তর বিহার থেকে

আসা (অমিতাভ, ১৯৭৪: ৩২)। শ্রীচৈতন্যের পিতামহ মৈথিলী ব্রাহ্মণ উপেন্দ্র মিত্র ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে কটক জেলার জাজপুর থেকে সিলেটের ঢাকাদক্ষিণে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন (শ্যামল, ২০১৮: ৫৫)। মিথিলা বা বিদেহ রাজ্য বর্তমান বিহার প্রদেশের অন্তর্গত। সেখানকার ব্রাহ্মণ অভিবাসন কেবল সিলেট নয় সমগ্র বাংলাতেও ঘটেছে। ‘শ্রীশ্রী গুরুচাঁদচরিত’ গ্রন্থে পাই ষোলো শতকে গুরুচাঁদের পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণ রামদাস মিথিলা নগর থেকে নবদ্বীপ আসেন। তখন—

 

‘একেতো শিক্ষার কেন্দ্র তাহে উচ্চ গৌরচন্দ্র নবদ্বীপ ধন্য ধন্য হয়। বিভিন্ন প্রদেশ হতে অবিরাম জনশ্রোতে

নবদ্বীপ পানে সবে ধায় ।’ (উদ্ধৃত, প্রহ্লাদ, ২০১০: ২)।

 

আবার নবদ্বীপ থেকে শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস নিয়ে উড়িষ্যার পুরীতে প্রস্থান করেন। এভাবে সমগ্র ভারতেই জনমানবের অভিবাসন ঘটেছে সাথে সাথে তাঁদের সামাজিক উৎসব কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস আচরণ স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেক আচার অনুষ্ঠানের সমন্বয়-সম্মিলন ঘটেছে। এমনিভাবে লোককথা, লোক-কাহিনি, পুরাণ এমনকি তন্ত্র-স্মার্ত মিলে মিশে গড়ে উঠেছে সংকর জাতি বাঙালির ধর্মীয় উৎসব। তাইতো অস্ট্রিক দেবী কালী, হিমালয় পাদদেশের বিদেহ নগর বা মিথিলার উমা আর লোককাহিনীর কৈলাসের দক্ষকন্যা সতী সকলের বৈশিষ্ট্য মিলে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংসারি নারীমূর্তি দেবী মা দুর্গা। তাঁর আরাধনায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪—১৯১২) লেখেন, ‘কত লোকে কতই বলে শুনে প্রাণে মরে যাই/ কেমন করে হরের ঘরে ছিলে উমা বল মা তাই’। তারও শত বছর আগে সাধক রামপ্রসাদ সেন (১৭২০—১৭৮২) লেখেন: ‘বলে বলুক লোকে মন্দ / কারো কথা শুনবো না। / এবার আমার উমা এলে / আর উমায় পাঠাবো না’। এভাবে দেবীকে মা বলে কখনো কন্যা রূপে আপন করে ভেবে মায়ের উপাসনা বাঙালির এক সমৃদ্ধ সাধনা পদ্ধতি। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯—১৯৭৬) গভীর আবেগ দিয়ে গেয়ে ওঠেন: ‘মা আয় মা উমা! রাখব এবার/ ছেলের সাজে সাজিয়ে তোরে / মা’র কাছে তুই রইবি নিতুই / যাবি না আর শ্বশুর ঘরে/ মা হওয়ার মা কী যে জ্বালা/ বুঝবি না তুই গিরি-বালা/ তোরে না দেখলে শূন্য এ বুক/ কী যে হাহাকার করে তোর টানে মা/ শঙ্কর-শিব আসবে নেমে জীব জগতে / আনন্দেরই হাট বসাব নিরানন্দ ভূ-ভারতে/ না দেখে যে মা তোর

লীলা/ হয়ে আছি পাষাণ-শীলা/ আয় কৈলাসে তুই ফিরবি নেচে/ বৃন্দাবনের নূপুর পরে।’ এভাবে তিনি আনন্দময়ীর আরাধনায় ভক্তি-বিশ্বাসের বন্যায় প্লাবিত করে দুর্গা-কালি-শ্যামার সাথে শ্যামকেও একাকার করে দিয়েছেন । সকল দেবতার মিলত শক্তি থেকে যেমন দুর্গার সৃষ্টি তেমনি সকল দেবীকেই দুর্গা ধারণ করেন। আবার সাম্প্রতিক সংস্কৃতিতে দুর্গা পুজোর প্যাকেট-প্রসাদের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। প্যাকেটে কোনো ধর্মের নিষিদ্ধ কোনো খাদ্য নেই। ফলে দুর্গা পুজোর প্রসাদ আজ যে-কোনো ধর্মের মানুষ চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করতে পারে এবং করেও ( সৌমিত্র, ২০১৫: ১১)। এতেকরে

লোককথা পুরাণ বেদ সবকিছু মিলে দুর্গা পুজো হয়ে উঠছে সকলের শরদীয় উৎসব। সাথে সাথে প্রতিনিধিত্ব করছে বাঙালি সংস্কৃতিরও। সর্বোপরি, শরৎ-হেমন্তে ফসল তোলার সময় আবহমানকাল থেকেই বঙ্গ জনপদে উৎসবের রীতি। সে উৎসবেরই একটি অংশ শারদীয় পূজা। ফসল তোলার সময় বাবা-মায়ের ঘরে বেড়াতে আসে প্রিয় কন্যা। সঙ্গে আসে তার স্বামী ও ছেলেমেয়েরা। দেবী দুর্গার পূজা রূপ পায় বাঙালির গৃহস্থ পরিবারের মিলনোৎসবে। পূজামণ্ডপগুলোতে যে ঐতিহ্যবাহী চেহারায় প্রতিমা দেখা যায় তাঁর দশহাতে অস্ত্র, বাহন হিসেবে সিংহ এবং পায়ের নিচে অসুর থাকলেও দেবীর মুখ সুন্দর ও কোমল। এই দেবী পরিপূর্ণভাবে বাঙালি নারী। আর্যদের মতো তার চুল সোনালি নয়, বরং অনাযর্সুলভ কালো ও কুঞ্চিত। তাঁর শাড়ি বাঙালি ঢঙে পরা; অলংকারগুলো প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত অলংকারের প্রতিরূপ। তিনি ত্রিনয়না বটে, তবে তাঁর দীঘল কালো চোখ ও মুখাবয়ব চিরন্তন বাঙালি নারীর। বাঙালি নারীও দেবীরই প্রতিরূপ। দশভুজা দেবীর মতোই বাঙালি নারী ঘরে-বাইরে সব কাজ সামলে চলেন। তাঁর নবপত্রিকা বা কলাবৌও বাঙালি ঘোমটা টানা নববধূ বৈ নয়। তাঁর উমা-সংগীতও তাই মিথিলার গান নয়, বাঙালির ঘরের কথা—পরিবার জীবনের কথা। সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে আমাদের জীবনের মিল পেলেই মানুষ আনন্দিত হয়। আমাদের উমা ও মা দুর্গা তাই আনন্দময়ী। সকলের ঘরে তাঁর আগমন ঘটুক।

 

লেখক : ভাষাবিজ্ঞানী ও কবি

সহ. অধ্যাপক, সি ইউ এফ কলেজ, চট্টগ্রাম-৪০০০

স্থায়ী ঠিকানা: সর্দারের বাড়ি, সালন, টিলাগাঁও, মৌলভীবাজার-৩২৩১ ফোন: ০১৭১২১৩০৭৪৭

 

Side banner