kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চেন্নাই: কেন যাই কী পাই


কালচিত্র | ড. শ্যামল কান্তি দত্ত প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২০, ০৪:১১ পিএম চেন্নাই: কেন যাই কী পাই

চেন্নাই: কেন যাই কী পাই

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

 

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাই শহর। ভারতীয় উপমহাদেশে চিকিৎসা নগরী হিসেবে পরিচিত। এখানকার খ্রিস্টান মিশনারী হাসপাতাল (সিএমসি) এবং অ্যাপোলো হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে একথাও সত্যি তামিল অধ্যুষিত হাসপাতাল দুটিতে শতকরা নব্বই ভাগ রোগী বাঙালি। আবার বাঙলি রোগীর শতকরা নব্বই ভাগই বাংলাদেশী। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকেও সরাসরি চেন্নাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করেছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না এর কারণ চিকিৎসার আশায় বাংলাদেশীর চেন্নাই যাওয়ার হার বাড়ছে। ফলে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক, চেন্নাই : কেন যাই ? কী পাই? চেন্নাই ভ্রমণের কাহিনী থেকেই সে-উত্তর খোঁজার প্রয়াস।

২০১৭ সনের প্রথমদিকে, বাবাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাই সিলেটে। নিকট-আত্মীয় ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, “আপাতত ঔষধ দিচ্ছি, তবে সময়-সুযোগ মতো ঢাকায় গিয়ে হার্ট ফাউন্ডেশনে একবার দেখিয়ে নিন। এনজিওগ্রাম করানোর সময় অন্তত দুটো রিং পরানোর প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন।” বাবা বাড়ি ফিরেই মনুনদীর চরের গাছ বিক্রি করে টাকা সংগ্রহের তোড়জোড় শুরু করলেন। গ্রামের করাত-কলের দালাল ফাড়িয়ারা গাছের যে-দর দিতে চায় তা অনেকটা ইটভাটার লাকড়ির দরে ফার্নিচারের কাঠের গাছের দর। বাবাকে ফোনে বললাম, চট্টগ্রাম চলে আসতে এবং টাকা পয়সার চিন্তা না করতে। ক’দিন পর বাবাকে ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার ফজিলাতুন্নেসা মালিক প্রথমে এনজিওগ্রাম করাতে বললেন। পরক্ষণেই আবার বললেন, হাতে সময় থাকলে প্রথমে ইটিটি করিয়ে নিন, এর রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনে পরের দিন এনজিওগ্রাম করানো যাবে। কথা মতো ইটিটি করাতে নিলাম। ঘন্টা দুয়েক পরে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার সিলেটি ভাষায় বললেন, “ই পঁচাত্তর বছর বয়সঅ আইয়াও ছয় মিনিট দৌড়াইতা পারছইন। আপনার তো হার্টঅ ব্লক থাকবার কথা নায়। এনজিওগ্রাম করানি লাগত নায়। আমি থুড়া ঔষদ দিলাম ওগুইন খাউকাগি।” ডাক্তারের কথা শুনে বিমল বিন্দু দত্ত খুব উৎফুল্ল হলেন। ফিরে এসে ক’দিন আমার সরকারি নিবাসে খুব আনন্দে-হাসি-খুশি দিন কাটালেন। মাসখানেক থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরে গেলেন। এর মাস তিন পরে (৪ অক্টোবর, ২০১৭) দুপুর বেলা আচমকা হার্ট এটাকে মারা গেলেন বাবা। আমরা দু’ভাই বাড়িতে থেকেও বাবাকে জীবিত অবস্থায় ডাক্তারের কাছে নিতে পারিনি; মৃত্যুকালে চিকিৎসা দিতে পারিনি। ছোট ভাই নিজের গাড়ি চালিয়ে বাবাকে নিয়ে যখন ব্রাহ্মণবাজার মুসলিম এইডে পৌঁছলাম তার কয়েক মিনিট পরে ডাক্তার ইসিজি করে বাবাকে মৃত ঘোষণা করলেন।

চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের দেশের জনগণের কয়েকটি স্তর আছে। এক. দেশের সাধারণ লোক ভেষজ ও হোমিও চিকিৎসার পাশাপাশি এখনও ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ ও স্বপ্নে পাওয়া ওষুধে চিকিৎসা করেন। দুই. অল্প পড়াশোনা জানা লোক নিজে নিজেই ফার্মেসি থেকে ঔষধ কেনেন অথবা ফার্মেসির ঔষধ বিক্রেতাকে রোগের বিবরণ দিয়ে বিক্রেতার পরামর্শে ঔষধ কেনেন। এ দু’স্তরের লোকই অসুখ বেড়ে গেলে পরে অবশ্য সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। তিন. দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি সচরাচর সরকারি হাসপাতালে যান না। তারা ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে রোগের ব্যবস্থাপত্র নেন, প্রয়োজনে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা করান। এ শ্রেণির লোক একটু জটিল সমস্যা হলে আত্মীয়-স্বজন সরকারি হাসপাতালে থাকলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। আর অর্থ-সামর্থ একটু ভালো হলে বা সমস্যা জটিল হলে এরাই ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ছুটেন। তাদেরই একটি প্রধান স্রোত চেন্নাইমুখি। দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণি বাংলাদেশ বা ভারতের চিকিৎসার প্রতি মোটেই আস্থাবান নয়। তাঁরা দেশে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও বছরে একবার সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড গিয়ে চিকিৎসা করাতেই অভ্যস্থ। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলারা শুধু না তাঁদের পরিবার পরিজনও অন্তর্ভুক্ত এ শ্রেণিতে। ফলত, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্রের অতোটা মাথাব্যথা নেই, থাকার কথাও নয়।

বাবার এমন আচমকা অকাল প্রয়াণে আমরা দু’ভাইই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। ছোটো ভাই বিপ্লব দত্ত বাপ্পি মাধ্যমিক স্কুল-শিক্ষক। সে বেশ কিছুদিন থেকে ফুসফুসের প্রদাহের ঔষধ সেবন করছে। আমিও ফ্যাটি লিভারের ঔষধ সেবন করছি; আলট্রাসনোগ্রামে কিডনিতে ৪.২ মিমি একটি পাথরও ধরা পড়েছে। ফলে দু’ভাইয়ের মধ্যেই উদ্বিগ্নতা আরও বাড়লো। বাবার শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠান শেষ করে আসার সময়েই বাপ্পিকে পাসপোর্ট করতে কিছু টাকা দিয়ে এলাম। দুই ভাই একমত হলাম পরের কোনো বন্ধে আমরা চেন্নাইতে ডাক্তার দেখাতে যাব। নানান ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যদিয়ে পাসপোর্ট করা হল। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আমার বহিঃবাংলাদেশ ভ্রমণে ১০ দিনের অনুমতি আসলো। দশ দিনের মধ্যে চিকিৎসা করাতে হলে বিমানে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সহধর্মিনী তপতী রাণী দে’র সহকর্মীর স্বামী মো. মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী বিমান বন্দরে চাকুরি করেন। সেই আজাদ ভাই’র বদৌলতে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে চেন্নাই পর্যন্ত দু’টো টিকেট পাওয়া গেল বাইশ হাজার টাকায়।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দুপুর ১২:৪৫ এ ফ্লাইট। বাপ্পি আগের দিন সিলেট থেকে আমার চট্টগ্রামের বাসায় এল। তপুর দেবর-আপ্যায়নে কোনো ঘাটতি নেই। সাম্যর সাথে তার কাকুর খুব ভাব হয়েছে, ছেলেটা তার কাকুর নেওটা হয়েছে। দেশের দুই প্রান্তে থাকলেও রক্তের বন্ধন-পারিবারিক বন্ধন অটুট আছে ভেবে ভালো লেগেছে। সকাল দশটায় আমরা বাসা থেকে বের হব। বউ আমাকে বাসা থেকে বিদায় জানিয়ে একটু দেরিতে স্কুলে যাবে বলে তার হেড স্যারকে ফোন করলে। বিদায় মুহূর্তে বধূ সজল নয়নে বিদায় জানালো; দেড় যুগের বিবাহিত জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতা। অবশ্য এই প্রথম দু’জনের মধ্যে এতোটা ভৌগোলিক দূরত্ব হচ্ছে। সে যাক, প্রতি মুহূর্তে ফোনে যোগাযোগের প্রতিশ্রæতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সিইউএফএল কলোনী থেকে রিকসায় পনেরো নম্বর ঘাটে পৌঁছলাম। বাপ্পিকে দেখালাম, এই ঘাটে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার এর এই জেটিতে ২০০৪ সালে দশ ট্রাক অস্ত্র গোপনে আনার চালান ধরা পড়েছিল। যে কারণে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রীসহ এই কারখানার এমডি-জিএম এখন ফাঁসির আসামী হয়ে জেলে আছেন। নৌকায় কর্ণফুলী পেরিয়ে পায়ে হেঁটে বিমান বন্দর পৌঁছালাম সাড়ে এগারোটার দিকে। শাহ্ আমানত বিমান বন্দরের উদ্বোধন-ফলক দেখালাম ভাইকে। জানালাম ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার চট্টগ্রাম বিমান বন্দরকে এম.এ. হান্নান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নাম দিয়ে নির্মাণ-কাজ শুরু করেন। এই এম.এ. হান্নান প্রথম চট্টগ্রাম থেকে বেতারে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে বিমান বন্দরের নাম পাল্টে করে শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। কারণ, এম এ হান্নান-এর নাম ইতিহাসে ঢুকলে পরে, ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’ শ্লোগান অর্থহীন হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার একই উপায়ে ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পাল্টে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর করে দেয়।

বিমান বন্দরে পৌঁছানোর ঘন্টখানেকের মধ্যেই বোডিং পাস ও ইমিগ্রেশন শেষে দোতলায় আন্তর্জাতিক যাত্রী-বিশ্রামাগারে পৌঁছলাম। এ যেনো বাংলাদেশে থেকেই বিদেশ দেখছি মনে হলো আমার। তিনটি খাবারের দোকান এর মধ্যে একটি চা-কফি ও কোমল পানীয় সহ দেশীয় ফাস্টফুডের দোকান, আর বাকি দুটো ট্যাক্সফ্রি হার্ড ড্রিংক্স এর দোকান। সেখানে আবার ইংরেজিতে নির্দেশিকা লেখা রয়েছে বিদেশীরা বিদেশ ভ্রমণে যেতে এবং বাংলাদেশে প্রবেশ করতে কিনতে পারবে তবে বাংলাদেশীরা দেশে প্রবেশের সময় কিনতে পারবে না। ভাবলাম, আহারে বাংলাদেশের আইন! আমার নিজ দেশের নাগরিক দেশে বসে সুরা-সুধা পান করতে পারবে না, আর বিদেশীরা পারবে। দেশের ভেতর সুরা মাদকদ্রব্য; পান করা অপরাধ, আর বিদেশ গেলে অবাধ অনুমতি। ওমর খৈয়মের রুবাইয়াৎ মনে পড়ছিল খুব। তাঁর কল্পিত স্বর্গে তিনি সুরা-সাকী আর বই চেয়েছিলেন। বেদ থেকে শুরু করে হাল আমলের অনেক ধর্মেই স্বর্গসুখের আয়োজনেও সুরা-সুধা পানের আড়ম্বর আছে, শুধু আমার জন্মভূমিতেই তা আমার জন্য মাদকদ্রব্য এবং নিষিদ্ধ; অথচ বিদেশ যাবার সময় আমি কিনতে পারবো !

যথাসময়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান আসলে আমরা প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যেই কোলকাতা পৌঁছালাম। নিজেদের ঘড়ির সময় ৩০ মিনিট পিছিয়ে দেওয়াতে ঘড়ি দেখে মনে হলো পনেরো মিনিটেই চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতা এসেছি। মানুষের জীবনটা যে কতোটা যান্ত্রিক বা যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত তা আবার মনে হলো। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিয়মানুযায়ী ইমিগ্রেশনে ভারতের কোথায় ও কেন যাব ইত্যাদি তথ্য ও ফোন নাম্বার দিয়ে বিমান বন্দর থেকে বেরোতে আরও আধা ঘন্টা সময় ব্যয় হলো। বিমান বন্দরের বাইরেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, নির্ধারিত ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে মানুষজন কতো দ্রুত সুশৃঙ্খলভাবে চলে যাচ্ছে। হেঁটে একটু যেতেই  দেখলাম বাসস্ট্যান্ড। বিমান বন্দর থেকে শহরের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের মতো যাত্রীর জন্য হাঁক-ডাক নেই। বাসের গায়ে গন্তব্যস্থান লেখা পড়ে যাত্রীরা উঠছে। ওপাশেই একটি ভাতের হোটেল। একজন নারীকর্মী টাকা দিয়ে খাদ্য-মেন্যু লিখে টোকেন দিচ্ছেন। টোকেন নিয়ে খাবার খেলাম দু’ভাই মিলে। কিছুক্ষণ হেঁটে আবার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমান বন্দরে প্রবেশ করলাম। সারিবদ্ধ কম্পিউটারে অনলাইনে কেনা টিকেটের তথ্য দিয়ে বোডিং পাস সংগ্রহ করলাম। আমাদের দেশের মতো লাইন ধরে দাঁড়াতে হলো না। অবশ্য ওখানে দুটো ব্যবস্থাই আছে: যারা কম্পিউটার থেকে নিজে টাইপ করে প্রিন্ট নিতে পারছে না তারা লাইনে দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যা ছ’টায় ইন্ডিগো এয়ারে চড়লাম। রাতের বেলা আগের মতো আকাশ থেকে কোলকাতাকে আর দেখা গেল না। মেঘের ভেতর দিয়ে কিংবা মেঘের ওপর দিয়ে বিমান যাওয়ার কারণেও আর জানালা দিয়ে দেখা গেল না আকাশের সৌন্দর্য কিংবা মেঘের উপর দিয়ে ভেসে যেতে যেতে রোম্যান্স মিলল না। আগের মতো আকাশ থেকে দেখা গেল না পৃথিবীর রূপ। ভারতীয় বিমানবালারা কোমল পানীয়, চা-কফি-আইসক্রিম-ফাস্টফুড নিয়ে এলা। তবে এবারে কোন কিছুই বাংলাদেশের বিমানের মতো ফ্রি নয়। মূল্য পরিশোধ করে নিতে হলো এবং সে মূল্য বাজার মূল্যের সাথে আকাশ-পাতাল ব্যবধানে আকাশ-মূল্য। রাত ৯ টায় চেন্নাই বিমান বন্দরে অবতরণ করলাম। বিমান বন্দর এতো বড় যে, বিমান থেকে নেমে বাসে চড়ে বিমান বন্দরের যাত্রী ছাউনীতে পৌঁছতে হলো। এ বাস সার্ভিসটা ফ্রিতে পাওয়া গেল। বিমান বন্দরের ভেতরেই ট্যাক্সিক্যাবের টোকেন সংগ্রহের কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে অ্যাপলো হাসপাতালে যাওয়ার ট্যাক্সির টোকেন নিলাম। বাইরে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে টোকেনটা দেখাতেই সিরিয়াল নম্বর অনুযায়ী ট্যাক্সিক্যাবের নাম্বার পেলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা পর রাত এগারোটায় অ্যাপলো হাসপাতালে পৌঁছলাম।

সেদিন শনিবার রাত এগারোটা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছাড়া সর্বত্র সুনসান নীরবতা। পরদিন রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি। বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের নার্সদের বহনকারী স্টাফ বাসগুলো। আরেকটি থ্রিহুইলার বেবীটেক্সি নিয়ে আমরা দু’ভাই হোটেল খুঁজতে বেরোলাম। আধঘন্টার মধ্যেই একটি চারতলা হোটেলের তিনতলায় দুই বেডের রুম পাওয়া গেল, ভাড়া ৭০০ রুপি। রবিবার সকালে মোবাইলে ভারতীয় সিম কিনে নিলাম। হাসপাতালের আশেপাশের হোটেলগুলোতে কিছু বাংলা সাইনবোর্ড দেখে বিস্মিত হলাম। হোটেলগুলোতে আবার বড় করে বাংলায় লেখা আছে এখানে: ‘বাঙ্গালী খাবার পাওয়া যায়’। স্থানীয় মানুষজন দেখলাম হিন্দি ভাষাও বলছে না। ওরা দ্রাবিড় গোত্রের তামিল ভাষায় কথা বলছে। অবশ্য, বিদেশীদের কাছে বিক্রয়-দ্রব্যের মূল্য বোঝানোর জন্য ইংরেজি ব্যবহার করছে। এনএসআর গণাতে রচিত ‘৩০ দিনগুলিতে তামিল ভাষা’ নামক তামিল ভাষা শিক্ষার বাংলা বইটা কিনলাম। বাংলা ভাষায় অনার্য-দ্রাবিড় প্রভাব নিয়ে আলোচনায় কাজে লাগবে আশায়।

সোমবার সকালে আমরা হাসপাতালে পৌঁছেই সুন্দরীভবনে গেলাম। এখানে বিদেশী রোগীদের রেজিস্ট্রেশন মূল ভবনের পশের এই সুন্দরীভবনের নিচ তলায়। রেজিস্ট্রেশনের জন্য বাইরে তিনটি কম্পিউটার রাখা আছে । নিজেই নিজের তথ্য ইনপুট দেওয়ার ব্যবস্থা, তবে কেউ না পারলে সহকারী সাহায্য করছে। দেশে এসব কাজে যে হুড়োহুড়ি এখানে তা নেই। দেখলাম সবাই তিনটি লাইনে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রেজিস্ট্রেশনের তথ্য দেয়ার পর প্রিন্ট নিয়ে রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তার কক্ষে পাঠানো হলো। ওখানে আরেক বার সিরিয়াল অনুসারে যেতে হলো। রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দিয়ে রোগীর চাহিদা মতো ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে প্রত্যেক রোগীর হাতে ফাইল আর সার্টের বুকে রোগীর পরিচিতি নম্বরসহ স্ট্রিকার লাগিয়ে দেওয়া হলো। পাশের কাউন্টারে ডলার বিনিময় করে ইন্ডিয়ান রুপি নেওয়ার ব্যবস্থা। সে কাজটুকু সেরে দু’ভাই নিজ নিজ ডাক্তার দেখাতে গেলাম। আমি ডাক্তার উপল ধুসকে দেখালাম। আমি ইংরেজিতে সমস্যাগুলো বললাম। তিনি শুধু শুনলেন। ফলে বুঝতেই পারলাম না তিনি আমার কথা কতটুকু বুঝলেন। আমাকে লিভার ফেব্রোস্ক্যান এবং এন্ডোস্কপি করতে লিখে দিলেন। আমি জানালাম আমার তো স্টমাকে সমস্যা নেই, তবু কেন এন্ড্রোস্কপি ? ডা. ধুস ওটা কেটে দিলেন। সহকারী দেখিয়ে দিল টেস্টের জন্য কোথায় যেতে হবে। সেখানে টেস্টের ফি আট হাজার পাঁচশত রূপি জমা দিলাম। আড়াই ঘন্টা খালিপেটে থেকে টেস্ট করাতে হবে। অথচ পরে জেনেছি বাংলাদেশে এ টেস্ট করাতে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগে। পার্থক্যের কারণ অনুমান করি, আমাদের মেশিন আছে, দক্ষ অপারেটর নেই। ওদের ওদুটোই আছে। অতোটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই।

ইতোমধ্যে বাপ্পি এসে জানালো তাকেও হার্টের ডাক্তার কিছু টেস্ট করাবার পরামর্শ দিয়েছেন। এর ফি জমা দিতে গিয়ে জেনেছে সতেরো হাজার রুপি জমা দিতে হবে। সে কিছুতেই অতো দামের টেস্ট করাতে রাজি নয়। তাকে নিয়ে গেলাম যে ডাক্তার দেখিয়েছে তার সহকারীর কাছে। বাপ্পি ভাঙা হিন্দিতে বললো, সারা বডি চেক-আপ করাতে বারো হাজার রুপি আর হার্টের টেস্ট এতো বেশি দামের কেন? ওরা কোনো কথা না বলে ওর ফাইল রেখে দিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এবার আমি গিয়ে ইংরেজিতে বললাম এই রোগী আমার ছোট ভাই। আমি ইংরেজি জানেন এমন ডাক্তার বা তাঁর সহকারীর সাথে কথা বলতে চাই। এবার কাজ হলো, ফাইল পাঠানো হলো পাশের রুমে। আমাকে ও বাপ্পিকে সে রুমে যেতে ইশারা করলো। রুমে পরিচয় হলো ডা. শ্রুতির সাথে। তিনি সদ্য ডাক্তারি পড়া শেষ করে এখানে যোগ দিয়েছেন। তিনি রোগীকে বিছানায় শুইয়ে পেটে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে এবং বুকে থেটিস্কোপ লাগিয়ে চেক করলেন, রক্তচাপ মাপলেন, আমার কাছ থেকে রোগীর রোগের ইতিহাস শুনলেন। তারপর তিনি আমরা দু’ভাই শিক্ষকতা করি শুনে আননন্দিত হয়ে ধন্যবাদ জানালেন। বাপ্পিকে ধূমপান পরিহারের পরামর্শ দিলেন। বললেন, জীবনকে ভালো না বাসলে এবং নিজে থেকে ইচ্ছে না করলে কেউ কাউকে নেশার জগৎ থেকে ফেরাতে পারবে না। প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট আন্তরিক আড্ডার ঢঙে আলাপ করলেন, পরামর্শ দিলেন। এবার  ডা. শ্রুতি দেখালেন, হার্টের পরীক্ষায় অনেকগুলো প্যাকেজ আছে। তিনি এই রোগীর জন্য সাড়ে চার হাজার রুপির প্যাকেজটা দিলেন। এতে হার্ট, ফুসফুস, কলোস্টরেল ও ডায়েট বিষয়ক পরীক্ষা-পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত। আবার টাকা জমা দিয়ে কয়েকটি পরীক্ষা করানো গেল, কয়েকটি রইলো পরদিন সকালে খালিপেটে পরীক্ষা করানোর জন্য। পরদিন বাপ্পি পরীক্ষা শেষ করে রিপোর্ট পেতে পেতে দুপুর দুটো বেজে গেল। এবার রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা। ডা. রবার্ট মাও কয়েক জন রোগী দেখেন আবার অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে হার্টের অপারেশন করেন। এ ভাবে করতে করতে দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা। পাশাপাশি তিনজন ডাক্তারের কক্ষ, সুতরাং, রোগী ও রোগীর সহযোগী মিলে লোকজন প্রায় শ’তিনেক। অনেকে সিলিয়াল নম্বর জেনে সময় অনুমান করে চলে গেছেন। আবার যথাসময়ে এসে ডাক্তার দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের ডাক্তার যেহেতু ওটিতে যাচ্ছেন আসছেন তাই অনুমান করা যাচ্ছে না সিরিয়াল কখন আসবে। সুতরাং, ওখানেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অপেক্ষারত রোগী ও তাদের আত্মীয় বা সহকারী সবাই বাঙালি কেউ বাংলাদেশের কেউবা ভারতের আসাম-ত্রিপুরা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের। এমনকি আন্দামান দ্বীপের বাঙালি রোগীরাও আছেন। তবে আমি চেন্নাইয়ের একজন রোগীকেও এ হাসপাতালে দেখিনি। বাজারের ঔষধের দোকানে এর কারণ জানতে চাইলে বিক্রয়কর্মী জানালো ওদের দেশে ভালো ভালো সরকারী হাসপাতাল রয়েছে অনেক। ওরা এতো টাকা খরচ করে এসব হাসপাতালে আসতে চাইবে কেন!

দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা বাঙালি রোগীর সাথে কথা হলো। কেউ কেউ আগে থেকেই প্রতি বছর একবার এসে এখানে ডাক্তার দেখিয়ে যান। কেউ আগে এসে অপারেশন করিয়েছেন এখন আবার দেখাতে এসেছেন। কারো রোগী হাসপাতালে ভর্তি, সঙ্গী হয়ে এসেছেন। অবসরে নিজের সামান্য সমস্যাও একটু দেখিয়ে নিচ্ছেন। এদের বেশিরভাগের কোনো মারাত্মক সমস্যা নয়। সুতরাং সিরিয়ালের অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন নয়। তেমনি একজন সিলেট থেকে আসা এডভোকেট প্রতাপ রঞ্জন দাস। তাঁর আলোচনার মূল কথা: আমাদের দেশেও মেধাবী ভালো ভালো ডাক্তার আছেন। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। নব্য পুঁজিবাদী শ্রেণির ক্লিনিক-হাসপাতাল বানানোর সামর্থ্য-ইচ্ছাও আছে। তবে দেশে ভালো মানের মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও নার্স নেই। যা-ও আছে হাসপাতাল মালিকদের নগদ লাভের চিন্তার কারণে এঁদের সম্মান নেই-সুযোগ নেই ভালোভাবে সেবা দেওয়ার, নষ্ট হয়ে গেছে এঁদের সেবা দেওয়ার মানসিকতাও। কোলকাতা থেকে আসা কমলকৃষ্ণ দাস যোগ করলেন: একই অবস্থা কোলকাতায়ও । এই সব হাসপাতাল মানুষের আস্থাই তৈরি করতে পারেনি। চট্টগ্রাম থেকে আসা ডাক্তার জাহিদ হোসেন জানালেন, বাংলাদেশে ডাক্তারদের সামাজিক মূল্যায়ন নেই। স্কুল-কলেজের সবচেয়ে ভালো-মেধাবীরা ডাক্তারি পড়তে যায়, অথচ বিসিএস দিয়ে চাকুরিতে এসে দেখে তার সহপাঠী মাঝারি মানের একজন কলা অনুষদের শিক্ষার্থী অথবা মাদ্রাসা থেকে পড়ে আসা ছাত্র এসি (ল্যান্ড) হয়ে অর্থ-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। ডাক্তার টিএইচও হবার অনেক আগেই তার সহপাঠী বা ব্যাচম্যাট টিএনও হয়ে যায়। এর চেয়েও আক্ষেপের বিষয়, বাংলাদেশের ডাক্তারের ইউনিফরম-ই হাইজ্যাক হয়ে গেছে। কলেজের শিক্ষার্থী, নার্স, কম্পাউন্ডার এমনকি ফার্মেসী ব্যবসায়ীরাও ডাক্তারের ইউনিফরম পরেন। এতে করে ডাক্তাদের নিজেদের পোশাক হারিয়ে গেছে। এই সভ্য জগতে যে-পেশার মানুষ পোশাক হারিয়ে ফেলেন, তাঁরা সম্মান-শ্রদ্ধা-আস্থা অর্জন করবেন কেমন করে ?

(চলমান)

Side banner