kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পল্লী বাংলার ইতিহাস এবং একটি পাঠ পর্যালোচনা


কালচিত্র | জাফর জয়নাল প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২২, ১২:৪২ পিএম পল্লী বাংলার ইতিহাস এবং একটি পাঠ পর্যালোচনা

 

 

প্রতিটি বিদ্যাশৃঙ্খলকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ইতিহাস চর্চার কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাসের পাতায় যে জ্ঞান সঞ্চিত থাকে তার উদ্ধারের ভিতর দিয়েই ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হতে

        জাফর জয়নাল

পারে। কিন্তু ভারতের ইতিহাস চর্চায় ছিল না সাধারণ মানুষের ভূমিকার কথা। ১৯৮২ সালের দিক থেকে জ্ঞানেন্দ্র পণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, শহিদ আমিন, ডেভিড আর্নল্ড, রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র এবং গায়ত্রীচক্রবর্তী স্পিভাকদের নেতৃত্বে সাবলটার্ন স্টাডিজ’ প্রকল্পের আওতায় গবেষণালব্ধ সাধারণ মানুষের ভারতের ইতিহাস লেখা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে আরও অনেকে এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের ইতিহাস লেখা হয়। একটি সমৃদ্ধি উন্নত জাতির শুধুমাত্র বড় বড় অঞ্চলিকা নির্মাণের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় না। প্রকাশ পায় তার আপন সংস্কৃতি এবং স্বাজাত্যবোধের মধ্যে দিয়ে। স্বাজাত্যবোধের মাধ্যমেই আসে স্বজাতি প্রেম। সেই প্রেমের অন্তর্নিহিত শক্তি থেকে আসে স্বদেশকে ভালোবাসার প্রাণশক্তি। এশটি জাতিকে জানতে হলে সেই জাতির সাধারণ মানুষের ইতিহাস জানা জরুরি। পল্লীবাংলার ইতিহাস পাঠের ভিতর দিয়ে বাংলার আঠারো শতককে ভালোভাবে উপলদ্ধির পথ খুলবে পাশাপাশি একজন বাঙালি তাঁর শেকড়ের সন্ধান পাবে।

বিট্রিশ শাসন শুরু হওয়ার সময়কার অবস্থা। বাঙালি জাতির বর্তমান দ্বিধা বিভক্ত যে মন ও মানসিকতা সেটি যে প্রাচীনকাল থেকেই তার সাক্ষ্য মিলবে এই বইয়ে। উইলিয়াম উইলসন হান্টার মনে করেন বাঙালিরা আসলে কোনো জাতি নয়। জাতি হওয়ার জন্য লোকসমষ্টি ‘ভাবানুভূতির সাযুজ্য আছে? প্রয়োজন বলে ম্যাক্স ওয়েবার মনে করেন। বাঙালির কী সেই ভাবানুভূতির সাযুজ্য আছে? অতীতে ছিল না বর্তমান কী আছে? বীরভূম- বীরদের যে আবাসস্থল। ইংরেজ জাতির শাসন শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে বীরভূমে এবং সারাবাংলায় বোন-জঙ্গলে ভোরে যায়, মানুষের অভাবে। মানুষের অভাব কেন? তখনতো ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০ কোটি। বাংলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। তখন কয়েক বছর পর পরই দুর্ভিক্ষ হত। ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বলে সরকারিভাবে হিসেব করা হয়েছিলো; এবং জুন মাসে প্রতি ষোল জনের ভিতর ছয় জন মারা গিয়েছে বলে ধরা হয়েছিলো; বিট্রিশ শাসনে পাঁচ বছর পরপর বড় রকমের দুর্ভিক্ষ হত। দুর্ভিক্ষের কারণ কী? কারণ খুঁজলে দেখা যায় শাসন ব্যবস্থায় তীব্রমাত্রায় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। প্রশাসনের ভিতর সমন্বয়হীনতা এবং যুদ্ধবাজ চিন্তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ। পল্লি শিল্পের পতন সম্পর্কে হান্টার বলেন, বন্য হাতির আক্রমণের ভয়ে শিল্পীরা বীরভূম ছেড়ে অন্য জেলায় চলে যায়। কিন্তু কোথায় তারা চলে যায় তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই এই বইয়ে। যেমন উল্লেখ নেই তৎকালীন সময়ে পদ্ধতি।  ÔThe Annals of Rural Bengal’ এই বইয়ের প্রকৃত নাম। ল্যাটিন ভাষায় Annus ষোলশতকে Annals রূপলাভ করে। ল্যাটিন Annus দ্বারা তৎকালীন সময়ে ‘বছর’কে প্রকাশ করা হত। বর্তমানে Annals বলতে Historical records ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থে এই বই ভারতবর্ষের কিছুটা দিক বিশেষত প্রশাসনিক দিকে আলোকপাত করতে সমর্থ হয়েছে। যেহেতু William Wilson Hunter (১৮৪০-১৯০০) একই সঙ্গে একজন ইতিহাসবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, সংকলনকারী এবং ইন্ডিয়ান সিভিল এর সদস্য ছিলেন, তাতে তাঁর প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। একজন ভালো ইতিহাসবিদকে অবশ্যই নির্দিষ্টতার দিকে যাবে। এবং এটি প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণভাবেই পক্ষপাত থেকে দূরে থাকবেন। উইলিয়াম হান্টার ও তাই করার চেষ্টা করেছেন মাঝে মাঝে অবশ্য তাঁর লাইনচ্যুতি ঘটেছে। পল্লিবাংলার কথা বলতে গিয়ে প্রশাসনের কথায় বেশি বলেছেন।

ভারত আসলে বহুজাতির একটা মহাদেশ। বিচিত্র সব জাতির উপস্থিতি এই মহাদেশকে দান করেছে পৃথিবীর উজ্জ্বলতম ইতিহাস। ইতিহাসের এই মহাদেশ, মহাদেশ হয়ে উঠতে পারেনি। কেন ভারত বিশ্বরাজনীতিতে পিছিয়ে রয়েছে? উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন হবে। হয়তো অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন, তারপরও বলতে হয়- এই সত্য আজও মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা মায়ানমারে যেমন কার্যকর রয়েছে তেমনি ঐতিহাসিকভাবে আমাদের রয়েছে ভেদাভেদের ইতিহাস। আর্য শব্দের অর্থ মহৎ। অন্যদিকে অনার্য মানে নিচুজাতের মানুষ। মানুষের এই যে ভেদ নীতি তাই সমাজকে অনেক সময় তিমিরে তলিয়ে যায়। তখন জীবনানন্দের মত বলতে হয়- ‘স্বাক্ষরের অক্ষের অমেয় স্তূপের নীচে বসে থেকে যুগ কোথাও সংগতি তবু পায় নাকো তার; ভারে কাটে- তথাপিও ধারে কাটে বলে সমস্ত সমস্যা কেটে দেয় তরবার।’ [উন্মেষ: জীবনানন্দ দাশ] বিভিন্ন ভারতীয় মানুষ শ্রেণি কাঠামো গড়ে তুলেছিল তারই প্রেক্ষিতে সমাজ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে বিভিন্ন শক্তি এসেও পেশি শক্তির আশ্রয়ে পুরো ভারতবর্ষকে শাসন করেছে বিভিন্ন সময়। ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজ সমাজের মাঝে ছড়িয়ে থাকা সংস্কারগুলিকে লিপিবদ্ধ করে এবং নানান জটিল ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে ধর্মকে আরও বেশিমাত্রায় জটিল করে তুলে। সমাজের মাঝে জাল বিস্তার করে মানব মুক্তিকে বাধাগ্রস্থ করে। একত্রিত হওয়ার আগে উভয় পক্ষকেই কিছু কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এক হওয়ার আগে সামাজিক দিক থেকে এক হতে হয়।* ডবিøউ হান্টার মনে করেন- বাঙালি জাতির জাতি হয়ে উঠতে না পারার পেছনে এই বিষয়গুলি ভূমিকা পালন করেছে। সামাজিক স্তরায়ন ভারতের সমাজের এই কঠিন বিন্যাস বাঙালি সমাজেও বিদ্যমান ছিল এবং রয়েছে। মানুষে মানুষে এমন দূরত্ব সৃষ্টির পেছনে ‘রক্তকে বিশুদ্ধি রাখার প্রবণতা কাজ করতো। আশ্চর্য হলেও সত্যি এই ধারণা একুশ শতাব্দীতেও অনেক গোষ্ঠীর ভিতর বিষবাষ্প হয়ে রয়ে গেছে। অজয় নদীর অপর তীরে বীরভূম রাজবংশ এবং তাদের অধীনে চাকরিরত কতিপয় ধনবান মুসলিম পরিবার নিজেদের আফগান বা পাঠান বংশগত বলে দাবি করতেন, এবং তারা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটাতে ঘৃণা বোধ করতেন।

 

ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় যে সকল ক্রটি ধরাপড়ে তার ভিতর সাঁওতাল জাতির বিদ্রোহ অন্যতম। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয় হিন্দু-বেনিয়াদের দ্বারা। হিন্দু-বেনিয়াদের কারণেই সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয় বলে হান্টার সাহেব ঐতিহাসিক যুক্তিপ্রদান করেন। সাঁওতাল জনগণের পিছিয়ে পড়ার যে শক্তিশালী কারণ রয়েছে তার ভিতর ভাষা থেকে যার উৎসভূমি। সাঁওতাল জনগণ গোষ্ঠীর ভাষা সাঁওতালি। একে বারেই প্রাকৃত ভাষা থেকে যার উৎসভূমি। সাঁওতাল জনগণের পিছিয়ে পড়ার যে শক্তিশালী কারণ রয়েছে তার ভিতর ভাষা প্রশ্ন অন্যতম। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বর্তমানকাল পর্যন্ত সাঁওতালদের নিজের মাতৃভাষার শিক্ষা প্রদান করা হয়নি। মাঝখানে একজন ইংরেজ পাদ্রির চেষ্টা করেন কিন্তু তা বেশিদিন এগিয়ে নিতে পারেননি। ইংরেজ আমলে একমাত্র উত্তরের খুঁটির বেড়ার মধ্যবর্তী আধা-হিন্দু এলাকাতেই তাদের (সাঁওতাল) লেখাপড়া শেখানোর জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চেষ্টা করা হয়; কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম ছিলো বাংলা ভাষা। সাঁওতালরা এই ভাষার আদৌ পছন্দ করতো না। (৫) তৎকালীন বীরভূম অঞ্চলের বিশাল পতিত জমি চাষ-বাস করে জীবন কাটাতো সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। বিট্রিশদের রেলপথ নির্মাণ, নীলচাষ এবং চা-বাগনের কর্মচারী হয়ে জীবন-জীবিকার সন্ধান পায়। সাঁওতালদের ধর্ম নেই এমন কথা বলা যায় না; বরং হিন্দুদের চেয়ে তাদের ধর্মীয় আচারের সংখ্যা অনেক বেশি। সাঁওতাল প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক ভিত্তিতে পরিকল্পিত কিংবদন্তি ছাড়া কিছুই নয়, তবে তার মূলে অতি প্রাচীনকালের প্রকৃতি পূজার ভাবধারা রয়েছে। এই অধ্যায়ে ডবিøই হান্টার সাঁওতাল জাতির ইতিহাস ব্যাখ্যা দেন। শেষে নতুন শাসকের জন্য করণীয় কী হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। যা একজন দক্ষ ইতিহাস বিশ্লেষকের পরিচায়ক। ‘সভ্যতার অগ্রগতির জন্য সংখ্যা ও তথ্য অপরিহার্য; কিন্তু বাংলাদেশের কোনো জেলার লোকসংখ্যা বা তাদের উৎপন্ন খাদ্যশস্যের পরিমাণ নির্ধারণের কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় তখন আমাদের নেই; অথচ খাদ্যশস্যের পরিমাণ নির্ধারণের কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় তখন আমাদের নেই; অথচ খাদ্যশস্যের মতো পণ্যের প্রাচুর্য একদিকে যেমন জনসাধারণকে সমৃদ্ধ ও রাজভক্ত করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি তার ঘাটতির ফলে তারা ক্ষুধার্ত ও রাজদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভারতের আগামী পঞ্চাশ বছরকালের শাসকদের এই সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাদের পূর্ববর্তী শাসকরা ভারতকে সভ্যতা যাতে ভারতবাসীর পক্ষে উপকারী হয়, আবার আমাদের নিজেদের জন্যও নিরাপদ হয় তার উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে তাদের প্রধান কর্তব্য।’

বিট্রিশ ইতিহাসবিদ ই. এইচ. কার (Edward Hallett carr) তাঁর What Is History?’ গ্রন্থে বলেন, It is a continuous process of interaction between the historian and his facts, an unending dialogue between the past and the present.’’অর্থাৎ ইতিহাস হলো বর্তমান অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ। তেমনিভাবে আটারো শতকের জীবন একুশ শতকের জীবন প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত। শাসন ব্যবস্থার নানা মাত্রিক ত্রæটির ফলে যে, বিপর্যয় নেমে আসে। তার ফলে শাসন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণের আস্থা হারিয়ে যায়। যুদ্ধবাজ ইংরেজ জাতি ভারত শাসনকালে কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল। হয়ত কখনো মাদ্রাজে, কখনো পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধে করেছে ফলে দেশের মানে পল্লি বাংলার সমস্ত অর্থকড়ি অন্য প্রদেশগুলিতে বলে যায় ফলে বাংলার শুরু হয় অর্থ শূন্যতা। বিচার-ব্যবস্থার চরম রকমের দুর্বলের ছিল সেই সময়। ‘থানাদার যেমনসরকারের পক্ষে কাজে করতো. তেমনি আবার ডাকাতদের পক্ষেও কাজ করতো।  ডবিøউ হান্টার এই বইয়ে মুসলিম শাসন ব্যবস্থাকে কুশাসন বলে অভিহিত করেন। তার পেছনে হান্টার যুক্তি দেন যে, মুসলিম শাসনের সময় জনগণের নিরাপত্তা বিধান ভালো ছিল না। চোর-ডাকাতের উৎপাত ছিল- তাই, শিল্প-বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য বিস্তার করেনি। বিচার-ব্যবস্থার দীর্ঘ সূত্রতা এখন যেমন আছে থেকে তিনশত বছর আগেও তার খুব যে ব্যতিক্রম ছিল তা বলা যাবে না। হান্টার বাঙালি কৃষক সমাজের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন বার বার এখানে। শাসন ব্যবস্থার ভুলের কারণে নি¤œবর্গের মানুষ যে কী নিদারুণ সমস্যা সংকুল জীবন-যাপনের ঘেরা টোপে আটকা পড়ে।... পাদটিকা: এডওয়ার্ড হ্যালেট কার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এ দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা করেন। এ সময় ইতিহাস বিষয়ক কিছু বক্তৃতা দেন বিভিন্ন সময় কেমব্রিজের সংকলন ইতিহাস কী বা What Is History? বইটির কারের মৃত্যুর একুশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে।

 

ডবিøউ হান্টার তাঁর এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে সত্য কথাটি বলেছেন। তা হলো ইংরেজ সরকারের তৎকালীন ভূমি-স্বত্ব নীতি। একথা শুনতে হাস্যকর মনে হলেও বর্তমান বাংলাদেশ এই অভিশাপ মাথায় নিয়ে এখনো চলছে। হান্টার সাহেব ১৮৫৯ সালের ভূমি সংস্কার আইন একপ্রকার গোলক ধাঁধা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর ভূমি-ব্যবস্থা আগের মতই থেকে গেছে। অথচ বাংলাদেশের আদালতগুলোতে যেধরনের মামলা হয়ে থাকে, তাঁর ভিতর জমি-জমা সংক্রান্ত মামলাই বেশি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা লক্ষ করি যে, এই গোলক ধাঁধায় কেউই পড়তে চায় না। তাই এখন পর্যন্ত এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা এখনো করা হয়ে উঠেনি। হান্টার সাহেব অবশ্য একটা পথ বলে দিয়ে গেছেন যে, ‘আমাদের শাসনের (বিট্রিশ শাসন) প্রথম পঞ্চাশ বছরে পল্লী অঞ্চলের অফিসাররা যে সকল তত্ত¡ ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তার মধ্যেই দেশের প্রকৃত ভূমি আইনের সন্ধান পাওয়া যায়।  বাঙালি জাতির এই বিট্রিশদের দ্বারা শাসিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে- নানা আইন এবং সংস্কৃতি চর্চার ভিতর দিয়ে। মানসিকভাবে আমাদের এই যে, দৈন্যতা তা আমাদের একটি জাতি মানে স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকার লড়াইয়ে কোনো সুখের বার্তাবহন করে না। অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক মুক্তির বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এক তরফা অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশা দীর্ঘদৃষ্টির সমস্যা।

ইতিহাস চর্চার ভিতর দিয়ে জাতিগঠনের কঠির পথ পাড়ি দেওয়া সহজ হয়। ইতিহাসের চর্চার ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করি বাংলাদেশি ইতিহাসবেত্তা কিংবা ঐতিহাসিকগণের আলোচনায় ইংরেজদের ব্যবসায়িক দিকগুলো সঙ্গে ‘সাধারণ সম্পর্ক না উঠে আসা। এই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ বই আমরা দৃষ্টিগোচর হয়নি। পল্লীবাংলার ইতিহাস বইটির একটি মাত্র অধ্যায় ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন ইংরেজদের বাণিজ্য বিস্তার এবং সাধারণ জনগণের জীবন চর্চা নিয়ে। তাতেও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে তেমন বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব হয়নি। তারপরও তিনি আলোচনার চেষ্টা করেছেন। তার জন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার। যেমন তিনি ‘পল্লী অঞ্চলে পণ্য প্রস্তুতকারী হিসেবে কোম্পানির ভূমিকা’ নামক অধ্যায়ে বলছেন, পল্লী শিল্পের এই কেন্দ্রগুলো জনসাধারণের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিলো, ইতিহাসবিদগণ তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেননি এবং আমি আশা করি বর্তমান অধ্যায়ে আমি কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি নতুন ও ইঙ্গিতপূর্ণ আলোকে পরিবেশন করতে সক্ষম। তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে ইংরেজ ব্যবসা-বাণিজ্যকে দেখছেন তাতে ইংরেজদের বাণিজ্য বিস্তার ছিলো এই দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের পক্ষে। যেমন তিনি বলেছেন- ‘কোম্পানির বাণিজ্যের আরেকটি উপকারিতা ছিলো এই যে, রাজস্বের খুব কম অংশই তখন জেলার বাইরে যেতে যেতে পারতো মুসলমান আমলে সমস্ত রাজস্বই মুর্শিদাবাদে চলে যেতো; কিন্তু কোম্পানির আমলে জেলার প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য কেনার জন্য রাজস্বের তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগই সরাসরি স্থানীয় বাজারে ফিরে যেতো। এমন ছোট ছোট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছেন ডবিøউ হান্টার; অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য- উপাত্ত দিয়ে।

লেখক: জাফর জয়নাল # jafourjkkniu@gmail.com

Side banner