kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফরিদপুরের গীতা দত্ত


কালচিত্র | বিনোদন ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৩, ১২:২০ পিএম ফরিদপুরের গীতা দত্ত

ফরিদপুরের গীতা দত্ত

বিনোদন ডেস্ক 

 

ভারতের সংগীত জগতে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল, লতা কণ্ঠী আশা কণ্ঠী হওয়া যায়, কিন্তু গীতা কণ্ঠী হওয়া যায় না। শোনা যায়, 'হারানো সুর' ছবিতে "তুমি যে আমার" গানটি সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে গাওয়ার জন্য অনেকেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেছিলেন সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে, কিন্তু হেমন্ত একটাই কথা বলেছিলেন সে দিন - ‍‍`এই গান গীতা ছাড়া আর কেউ গাইতে পারবে না।‍‍` হেমন্ত-র কথা মেনেই বম্বে গিয়ে গানের রেকর্ডিং করা হয়। বাকিটা ইতিহাস। এ গানটি বাংলা সিনেমার জগতে এখনও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। এমন ছিলেন গীতা দত্ত, আর এমনই ছিল তাঁর গান।

১৯৩০ সালের ২৩ নভেম্বর ইংরেজ শাসিত অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলায় ধনী জমিদার পরিবারে গীতা ঘোষ রায়চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায়চৌধুরী। দশ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ফলে চল্লিশের দশকের শুরুতে জাপানি সেনার ভয়ে বাংলাদেশের ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতা এবং অসমে বসবাস করতে থাকেন ঘোষ রায়চৌধুরীরা। পরে ১৯৪২ সালে তৎকালীন বম্বেতে চলে যান। আরামে-বিলাসে, জলের ধারে বসে ভাটিয়ালি শুনে কেটেছিল গীতার ফরিদপুরের দিনগুলো, কিন্তু জমিদারি হারিয়ে পরিবার আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ার পর বছর বারো-তেরোর গীতাকে গানের টিউশন দিতে হত। যাতায়াতের খরচ বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হত। ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক গুরু দত্তের সঙ্গে বিবাহসূত্রে গীতা দত্ত রূপে পরিচিত হন। তরুণ, বরুণ এবং নীনা দত্ত তাঁদের তিন সন্তান।

কিশোরীবেলায় বারো বছর বয়সে বম্বে আসার পর স্থানীয় বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে গীতা তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। সেই সময়েই তাঁদের দাদারের বাড়ির একচিলতে বারান্দায় গুনগুন করতে করতে বম্বের সুরকার হনুমান প্রসাদের নজরে আসেন তিনি। এরপর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাঁরই নিজস্ব তত্ত্বাবধানে গীতার সঙ্গীতের তালিম শুরু হয়।

১৯৪৬ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে সঙ্গীতশিল্পী রূপে গীতা দত্তের কর্মজীবন শুরু হয় সঙ্গীত পরিচালক হনুমান প্রসাদের ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবির হাত ধরে। এই ছবিতে গীতা কোরাসে মাত্র দুই লাইন গান গাইবার সুযোগ পান এবং তাতেই বাজিমাত করেন। তাঁর রিনরিনে গলার সূক্ষ্ম বুননে মোহিত হয়ে শচীন দেব বর্মণ তাঁর পরের ছবি ‘দো ভাই’তে তাঁকে ন’টি গান গাইতে দেন। নেপথ্যগায়িকা হিসেবে সেই তাঁর প্রথম কাজ। স্বাধীনতার বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই ছবিই গীতাকে রাতারাতি জোহরাবাই অম্বালেওয়ালি ও নুরজাহানের পাশাপাশি সেরা তিন গায়িকার সরণিতে এনে দেয়। তখন যুগের চল ভক্তিগীতি। গীতার করুণ গলায় সমর্পণ, আকুতিতে সেই সব গান অমরত্ব লাভ করে।গরিব বলে গান শেখাতে গিয়ে তাঁকে যে সব বাড়িতে মাটিতে বসতে বলা হত নামডাক হতেই সেইবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এলে গীতা সেখানে গিয়ে জোর করে মাটিতেই বসতেন। এই অভিমান, হৃদয়বৃত্তি আর নারীর অহংই সুন্দরী নায়িকার নেপথ্য কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়ে শ্রোতাদের আকুল করে তুলত।

এরপর থেকে আধুনিক রোম্যান্টিক গানে তাঁর এই অদ্বিতীয় কণ্ঠ এবং গায়কী ব্যবহার করতে চাইলেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। এইসময় শচীন দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় ১৯৫১ সালের ‘বাজি’ চলচ্চিত্র তাঁর সঙ্গীতজীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। কণ্ঠস্বরের আবেদন এবং পাশ্চাত্য সুরে সহজে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার জন্য ১৯৫০ এর দশকে লাস্যময়ী এবং ডান্স ক্লাবের গানে তিনি প্রথম পছন্দরূপে গণ্য হতে শুরু করেন। গীতার তীক্ষ্ণ বাঙালি টানকে কাজে লাগিয়ে ‘দেবদাস’ (১৯৫৫) এবং ‘পেয়াসা‍‍` (১৯৫৭) ছবিতে তাঁর লোকসঙ্গীতের ধার বাড়িয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন। ‘পেয়াসা’ ছবিতে ‘আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগা লে’ বাংলা কীর্তন গানকে গীতা সফলভাবে হিন্দীতে গেয়েছিলেন। এরপর ও পি নাইয়ারের সুরে সব ধরনের গানেই তিনি সাবলীলতার ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর স্বামী গুরু দত্তের ছবিতে গানই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এক চরিত্র। তাই বিয়ের কিছু দিন পরেই নিজের হোম প্রোডাকশন ছাড়া স্ত্রীর অন্যত্র গাওয়া নিষিদ্ধ করার পরে জন্ম নিয়েছিল অবিস্মরণীয় কিছু গান ‘আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগালো’ (পেয়াসা – ১৯৫৭), ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল জিনা ইহাঁ‍‍`(সি.আই.ডি.-১৯৫৬), ‘বাবুজি ধীরে চলনা’ (আর পার – ১৯৫৪), ‘থান্ডি হাওয়া কালি ঘটা’ (মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ – ১৯৫৫), ‘না যাও সাঁইয়া ছুড়াকে বাঁইয়া’ (সাহেব বিবি গুলাম - ১৯৬২)। এইভাবে তিনি এবং লতা মঙ্গেশকর পঞ্চাশের দশকে দুই প্রধান নেপথ্যসঙ্গীত গায়িকা হয়ে ওঠেন।

হিন্দী গান ছাড়াও গীতা দত্ত গুজরাটি ছবিতেও প্রধান নেপথ্য গায়িকা ছিলেন। তিনি গুজরাটি ভাষায় বিখ্যাত সুরকার অবিনাশ ব্যাসের সুরে বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন। ১৯৫০ দশকের শেষ থেকে ১৯৬০এর দশকের শুরু পর্যন্ত সময়কে বাংলা ছবি এবং সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এই সময়ে গীতা বেশ কিছু বিখ্যাত বাংলা গান গেয়েছেন। তাঁর বেশিরভাগ বাংলা গানেরই সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে তিনি নচিকেতা ঘোষ এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরেও কিছু গান গেয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে গুরু দত্তের শর্ত শিরোধার্য করেও সুরকাররা ঠিক একটি করে গান গীতার জন্য তুলে রাখছিলেন। কিন্তু সংসার ও সন্তানের অগ্রাধিকার, স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝির ফাটলে জমা সন্দেহ, আবেগপ্রবণ, হুল্লোড়প্রিয় গীতার শিকড়ে মানসিক অবসাদ গেঁথে দিয়েছিল। অপরদিকে স্বামীও অবসাদের চরমে। এই অবস্থায় দুজনেই প্রবল সুরাসক্ত হয়ে পড়লে ধীরে ধীরে লতা আর আশার কাছে স্থানান্তরিত হয়ে যায় গীতার আসন।

প্রথমে বিবাহবিচ্ছেদ এবং এরপর ১৯৬৪ সালে মহাপঞ্চমীর দিন গুরু দত্তের জ্বলন্ত চিতায় যেন গীতার মানসিক শক্তি ও স্নায়বিক চেতনার অনেকখানি ছাই হয়ে গেল। দীর্ঘ এক বছর নিজের তিন সন্তানকে চিনতে পারতেন না। তবে সুস্থ হয়ে উঠে সন্তানদের জন্যই আবার সঙ্গীত জগতে ফিরতে চাইলেন তিনি। কিন্তু বম্বের ফিল্মি দুনিয়ার স্বার্থপর সমীকরণ গীতাকে আর সেই সুযোগ দেয়নি। এরপর চরম অর্থকষ্টে আবার সুরার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন গীতা। অর্থের অনটন দূর করতে সেই সময়ে কলকাতার মঞ্চে গীতা প্রচুর অনুষ্ঠান করেছেন । বাংলা ছবি ‘বধূবরণ’-এ অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছেন। শেষের দিকে হাসপাতালে প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসার ফাঁকেই দুষ্টু নায়িকার নেপথ্যকণ্ঠে আবেগ ফুটিয়ে তুলেছেন অক্লেশে। শেষ কাজ ‘মুঝে জান না কহো মেরি জান’ আকুতিতে পঙ্‌ক্তিটির শেষে নিজেকেও নিঃশেষ করে দিয়েছেন বাসু ভট্টাচার্যের ‘অনুভব’-এ (১৯৭১) !

মাত্র ১৫ বছরের শিল্পী জীবনে কেবলমাত্র হিন্দী ভাষাতেই প্রায় ১২০০ গান গেয়েছেন গীতা দত্ত। ‘মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া’ (দো ভাই – ১৯৪৭), ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির’ (বাজি – ১৯৫১), ‘আ মিলো’ (দেবদাস – ১৯৫৫), ‘আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগালো’ (পেয়াসা – ১৯৫৭), ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল জিনা ইহাঁ‍‍` (সি. আই. ডি. - ১৯৫৬), ‘ওয়াক্ত নে কিয়া কেয়া হাসিন সিতম’ (কাগজ কা ফুল- ১৯৫৯), ‘বাবুজি ধীরে চলনা’ (আর পার – ১৯৫৪), ‘মেরা নাম চিন চিন চু’ (হাওড়া ব্রিজ – ১৯৫৮), ইত্যাদি গানগুলিকে তারই মধ্যে কালজয়ী সৃষ্টি রূপে গণ্য করা যায়। এছাড়াও বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, পঞ্জাবী, ভোজপুরি, মৈথিলী ইত্যাদি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। ‘তুমি যে আমার’ (নাহারানো সুর - ১৯৫৮), ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’ (হসপিটাল - ১৯৬০), ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’ (পৃথিবী আমারে চায় - ১৯৫৭), ‘এই মায়াবী তিথি’ (সোনার হরিণ - ১৯৫৯) প্রভৃতি গানকে আজও বাংলা গানের জগতের অমূল্য সম্পদ রূপে বিবেচনা করা যায়।

দীর্ঘদিন ধরে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের ফল শরীরের গহনে জানান দিচ্ছিল আগাম মৃত্যুর সংকেত। প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়েও রেকর্ডিংয়ে তিনি কী ভাবে একের পর এক অবিস্মরণীয় গান গেয়ে গিয়েছেন তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই, তাঁর মুখ থেকে সে দিন সুরের বদলে বেরিয়ে এসেছিল ভলকে ভলকে রক্ত। কোনও চিকিৎসাই গীতাকে আর সুরের জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।

Side banner