kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০২৫, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ : সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা


কালচিত্র | জাকিয়া রহমান প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২১, ১২:২৫ এএম ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ : সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

চন্দন আনোয়ারের ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ : সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার রূপায়ণ


জাকিয়া রহমান

 


চন্দন আনোয়ার (জন্ম: ১৯৭৮) একবিংশ শতকের প্রথম দশকের কথাসাহিত্যিক। ‘প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন’ প্রথম গল্পগ্রন্থ হলেও তুলনামূলক পরিণত গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘অসংখ্য চিৎকার’-এর মাধ্যমে। ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ (কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪) তাঁর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’, ‘ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার’, ‘আঁধার ও রাজগোখরা’ পরবর্তী গল্পগ্রন্থ। অর্ধ-শতাধিক গল্পের মধ্য থেকে বাছাই তিরিশটি গল্প নিয়ে কলকাতার একুশ শতক প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে ‘নির্বাচিত ৩০’ নামে গল্পের সংকলন এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২১ এ উল্লেখযোগ্য পঞ্চাশটি গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

সমসাময়িক যুগযন্ত্রণাকে শিল্পিতভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, সামাজিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, নারী পুরুষের মনঃসমীক্ষণ, পুঁজিবাদ, সকল বিষকে কেন্দ্রীভূত করে গল্প রচনায় তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যেন সমাজের সকল স্তরের মানুষের চাপা আর্তনাদ লেখক অনুভব করেছেন আত্মিকভাবে। এ অনুভূতি থেকেই মানবতার জয় পতাকা তুলে ধরেছেন গল্পে ও উপন্যাসে। চোর, হিজড়া সম্প্রদায়, কাঁচা সবজির পাইকারের মতো অবহেলিত চরিত্রসহ অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জীবনচিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় গল্পের বিষয়বিন্যাসে। এই পৃথিবীর সুধা সৌন্দর্য সংস্পর্শ লাভ ও যাপিতজীবনের দায় থেকে এরূপ শিল্পের সৃষ্টি হয়। সমসাময়িক কালে রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত হলেও নিয়ম ভঙ্গের যন্ত্রণা সর্বত্র বিরাজমান। অসতের মুখে সততার বাণী শোভা পায়। দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীরা হয় দেশ ও সমাজের নেতা। ফলশ্রুতি ভয়ংকর। স্বেচ্ছাচারিতা, খুন, জখম, ধর্ষণ, লুটতরাজ, রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরকে দোষারোপ করা এ সকলই সমসাময়িক বাস্তবতার চিত্র। সমসাময়িক এই সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নির্মোহ ও শৈল্পিক রূপায়ণ ঘটেছে  চন্দন আনোয়ারের গল্পে।

‘পোড়াবাড়ি ও মৃত্যু চিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ লেখকের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। এ গল্প গ্রন্থটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। গল্পগ্রন্থে মোট ১২টি গল্প স্থান পেয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে গল্পগুলোর বিষয়বৈচিত্র্যকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।

ক. পুঁজিবাদ, দারিদ্র্য ও জীবনবাস্তবতা: ১. কাফন চোর; ২. আমি কেউ নই; ৩. পাঁচ শ টাকার নোট; ৪. দুই বিধবার নিশুতি রাত।

খ. রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা : ১. আমাদের যুবক নেতা; ২. বারবনিতা এসোসিয়েশন; ৩. একজন দৈবজ্ঞ ও একটি মৃত্যু; ৪. একটি পুকুর মরে যাচ্ছে।

গ. তৃতীয় লিঙ্গের জীবনবাস্তবতা : অন্তর্গত শূন্যতা

ঘ. মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার : ১.পালিয়ে বেড়ায় বিজয়; ২. আপাতত এই বিচার; ৩. পোড়োবাড়ী ও মৃত্যু চিহ্নিত কণ্ঠস্বর

পুঁজিবাদ, দারিদ্র্য ও জীবনবাস্তবতা:
পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণি শোষণের ইতিহাস। একেশ্রেণির মানুষে হাতের বিপুল পরিমাণে বিত্তবৈভব, অন্য শ্রেণি ক্রমশ দরিদ্র ও সহায় সম্বলহারা হচ্ছে। সেফ বেঁচে থাকার জন্য কিছু দিয়ে গরিব-নিঃস্ব মানুষদের শ্রম-উপার্জন-জীবন-স্বপ্ন সবকিছু কৌশলে পুঁজিপতিরা নিজেরা দখল নিয়ে আরও ধনীতে পরিণত হচ্ছে। চন্দন আনোয়ারের নিজের ভাষ্যে:

আধুনিক বিশ্বে মানুষের শ্রেণিবিরোধের ইতিহাস সরল হয়ে এসেছে। এক শ্রেণির মানুষ নিরঙ্কুশ পাচ্ছে, নিচ্ছে আর ভোগানন্দে মত্ত আছে। অন্য একটি শ্রেণি প্রতি মুহূর্তে হারাচ্ছে, জমি-সম্পদ-শ্রম-শরীর সব হারাচ্ছে, যেখানে দাঁড়াচ্ছে সেখানেই তার কিছু না কিছু খোয়া যাচ্ছে।... কমিউনিস্ট বিপ্লবের মতো স্বর্গ-মর্ত্যব্যাপী একটি বিপ্লবকেও মোটামুটি ব্যর্থ বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়। এসব প্রশ্নের সরল কোন ব্যাখ্যা নেই। এই লড়াইয়ের শুরু বা শেষ বলে কিছু নেই। এক জীবন থেকে প্রবাহিত হয় আরেক জীবনে। তবে, এই অমোঘ লড়াইয়ে পক্ষ-প্রতিপক্ষ যেহেতু একটাই, তাই শত্রুকে চরম আঘাত ও বিজয় এই লড়াইয়ের একমাত্র লক্ষ্য। চরমতার চূড়ান্ত ধাপে না পৌঁছা পর্যন্ত প্রতিপক্ষের লড়াইয়ে শেষ নেই। (চন্দন আনোয়ার, ‘কথাসাহিত্যের সোজাকথা’, যুক্ত প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ৬২)

চন্দন আনোয়ারের ‘পোড়াবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ গ্রন্থের ‘কাফন চোর’, ‘আমি কেউ নই’, ‘পাঁচ শ টাকার নোট’, ‘দুই বিধবার নিশুতি রাত’ গল্পগুলোতে পুঁজিপতির উত্থান ও দৌরাত্ম্যের বিপরীতে দরিদ্র ক্ষুধার্ত  মানুষে দুঃখ-দুর্দশার চিত্র, ক্রোধ-ঘুণা ও প্রতিবাদ ফুটে উঠছে। চোরের ছেলে চোর হবে এমন কথা শাস্ত্রে নেই। তবুও পারিবারিক শিক্ষা, পিতৃঋণ ও শরীরে বয়ে বেড়ানো রক্তের বিষ এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। হয়তো সে কারণেই ‘কাফন চোর’ গল্পের সিঁধেল চোর বাবা রুস্তম আলির পুত্র কানু পেশায় কাফন চোর। পেঁচা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। পেঁচার বংশধরও সেভাবেই প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে উঠে। সিঁধেল চোরের পুত্র কাফন চোর কানুও তার বাবার ন্যায় সূর্যের আলোতে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। চিরলালিত অভ্যাস বসত কাজ খুঁজে ফেরে রাতের আঁধারে। এই নিস্তব্ধ রাত কানুকে কাফন চুরি করতে উৎসাহ দেয়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য জর্জরিত স্ত্রী ও মায়ের পেটের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সকল ভয়কে উপেক্ষা করে ছুটে চলে। যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতার ডাকবাহী রানার নিজ গন্তব্যে ছুটে চলেছে রাতের আঁধারে। একটু ভালো থাকা বা ভালো খাওয়ার লোভ নয়; বেঁচে থাকাই একমাত্র লক্ষ্য। লেখক এমনই এক চরিত্রকে করেছেন গল্পের কেন্দ্রবিন্দু।

কাফন চুরি পেশা বর্তমানে অবাস্তব মনে হলেও মাত্র পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও এই পেশার অস্তিত্ব ছিল।  দুর্ভিক্ষে তো বটেই, স্বাভাবিক সময়েও মানুষের বস্ত্রসংকট এতো ভয়াবহ ছিল যে, বেশিরভাগ মানুষ এক কাপড়ে কোনোপ্রকারে লজ্জা নিরাবরণ করেছে। কাফন চুরির পেশা না থাকলেও কাফন চোর কানুর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অস্তিত্বের লড়াই গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। বাস্তব পৃথিবীর অতি নগন্য চাহিদার, হীন মানসিকতার, অশিক্ষিত, আদিম মানসিকতা সম্পন্ন অন্ধকার এক মানব চরিত্র কানু। সে ক্ষুধা নিবৃত্তিকেই জীবনের একমাত্র কর্ম জ্ঞান করে। দুই একদিন বাদে কাফন চুরির একশত টাকাই তার একমাত্র উপার্জন।  বিকল্প উপার্জনের পথ বা কৌশলাদি তার জানা নেই।

গল্পটিতে নগরায়নের ইঙ্গিত রয়েছে। নগরায়নের স্রোতে গ্রামের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ঘরবাড়ি, রাস্তা ঘাট পাকা হওয়ার ও বৈদ্যুতিক বাতির প্রভাবে চোরের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। বাধ্য হয়েই কানু বাবার মতো সিঁধেল চোর হওয়ার সুযোগ পায় নি, হয়েছে কাফন চোর । যদি মৃত মানুষের শরীর থেকে রাতের আঁধারে কাফন খুলে নিয়ে আসা ভয়ঙ্কর কাজ। এ কাজের সময় কানুর অনুভুতিতে নিজেকে সে মৃতই ভাবে। ওই সময় কানু স্বাভাবিক  জ্ঞান সম্পন্ন অবস্থায় থাকে না, বাড়ী ফিরে স্ত্রী শিউলির সাথে কথোপকথন ও চাপকলের ঠাণ্ডা পানি মাথায় পড়ার পরেই জীবিত হয়ে উঠে।

শিল্পের সৌন্দর্য বাস্তব সৌন্দর্য থেকে পৃথক। বাস্তব পৃথিবীর নোংরা, নিকৃষ্ট, হীন, দুর্গন্ধ যুক্ত বিষয় শিল্পে উপস্থাপনার অকৃত্রিমতায় সুন্দর হয়ে ওঠে। ‘কাফন চোর’ গল্পে লেখক অভাব দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের জীবন ও তাদের কথা অনবদ্যভাবে শিল্পিত সুষমায় প্রকাশ করেছেন। সমসাময়িককালে যে সকল প্রগতিশীল সমাজসচেতন লেখক অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিম্নবিত্তের মানুষকে সাহিত্যে স্থান করে দিয়েছেন চন্দন আনোয়ার তাদের মধ্যে অন্যতম। নাগরিক সভ্যতার পরিপাটি জীবন নয় সাহসিকতার সাথে সমাজের নীচু শ্রেণির মানুষের তথা চোরের জীবন ও জীবিকাকে করেছেন গল্পের বিষয়বস্তু।

এই কাফন চুরির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা বড় ধরনের চোরের মুখোশ উন্মোচন করে পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরাই গল্পকারের প্রকৃত লক্ষ্য। তাই গোরস্থানে কানুর দেখা মেলে টিভিতে দেখানো ভিআইপি ব্যাক্তিত্ব, জেলার বড় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে। বড় ধরনের অপরাধ ও চুরির আলামত গোপন করার জন্য এই বড় নেতা গোরস্থানে আত্মগোপন করেছে। আমরা জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বহু দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতা নিজেকে বাঁচাতে দেশে-বিদেশে আত্মগোপন করেছিল। এরকম এক নেতা নিজেকে বাঁচাতে কবরস্থানে আত্মগোপন করে আছে তার কিছু অনুসারীসহ। প্রথমে কানু ভেবেছিল, নতুন প্রতিপক্ষ কিন্তু কাছবর্তী হতেই স্পষ্ট হয় সত্য।

আপনে! ছার আপনে? আপনে রে টিভিতে দেখছি। গোরস্থানে পালাইছেন কে রে? পুলিশে...
 মানুষটি সাপের মতো হিস্ শব্দ করে আঙুল দিয়ে টিপে ধরে কানুর ঠোঁট। পাঞ্জাবির পকেটে হাত চালিয়ে পাঁচ শ টাকার নোট যে কয়টা হাতে উঠল, সে কয়টা কানুর হাতে দিয়ে পেছনে সরে গেল। এবার এক যুবক সামনে আসল।
এই টাকা শেষ হলে আসবে। কাক-পঙ্খী জানলেও লিডার কিন্তু... বলে জিন্সের পকেট থেকে ছোট্ট পিস্তল বের করে কানুর থুতনিতে ঠেকাল।

গল্পটি অতিপ্রকৃত গল্পের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আবার আধুনিক ম্যাজিক রিয়ালিজমের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় "শিল্পের সুনিয়ন্ত্রণে ‘কাফন চোর’ গল্পে যে যাদুবাস্তবতাকে যেভাবে প্রয়োগ করেছে, মনে হবে বাংলার কোন রূপকথা পড়ছি। লাতিন আমেরিকার ধারকরা কিছু নয়।" [সাধন চট্টোাপাধ্যায়, “চন্দন আনোয়ারের গল্পের বার্তা”, এবং মানুষ (সম্পা : আনোয়ার কামাল), সংখ্যা ১৫, ডিসেম্বর ২০১৯, ঢাকা, পৃ. ১৭] বস্তুত, মুখে মুখে প্রচলিত গ্রাম্য ভূত-প্রেতের কার্যকলাপ স্থান পেয়েছে গল্পে। গল্পপাঠের সময় মনে হয় গ্রামের অতিপ্রকৃতগল্পের আসরে বসে আছি।  ক্ষণিক প্রবল ভীতি ও উৎকণ্ঠা নিয়ে কানু চোরের সাথে রাত কাটে পাঠকের। অবশেষে সকালের ঝলমলে রোদে মোহমুক্তি মেলে। ভূত প্রেত নয়, অস্তিত্ব মেলে পাঁচ শ টাকার নোটের। রাতের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ কানুর জ্বরাক্রান্ত অবচেতনে ঘটলেও পাঁচ’শ টাকার ঘটনাটি সত্য এবং প্রমাণিত। প্রকৃতপক্ষে গোরস্থান মৃত মানুষের আবাস। এই মৃত্যুপুরীতে বড় রাজনৈতিক নেতার অবস্থান দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মৃত্যু নিশ্চিত করে। মৃত্যুপুরীতে দেশের কর্ণধারের আশ্রয় খোঁজার মাধ্যমে পুরো দেশটার সকল কার্যক্রম মৃত অবস্থায় পৌঁছায়। যা একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য হুমকি স্বরূপ।

‘আমি কেউ নই’ গল্পটির মূল বিষয় পুঁজিবাদ ও ধনতান্ত্রিক সমাজের বিশৃঙ্খল অবস্থা। উনবিংশ শতকের রেনেসাঁসের সাথে সাথে প্রসার ঘটে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিকতার। পুঁজিবাদের প্রভাবে মহাজন আরো বড় মহাজন হয়। সাধারণ মানুষ শোষিত বঞ্চিত হয়। ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে সর্বশান্ত হয়। গল্পটির আখ্যানে চন্দন আনোয়ার পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্র অংকন করেছেন। এ মধ্যবিত্ত পরিবারটি অতি চতুর। পুঁজিপতির পায়ে সমর্পণ করেছে নৈতিকতা ও আদর্শ। পুঁজিপতির গচ্ছিত পুঁজির সুযোগ লাভ করে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার মানসে অল্পশিক্ষিত কিন্তু চতুর ও সুযোগ সন্ধানী শফিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে নিজের স্ত্রীকে। স্ত্রীর ভাষ্যে সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘আমার শরীরজুড়ে এখন শুধু টাকার খসখস শব্দ।’ (পৃ. ১) পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে আক্রমণ করাই যেন লেখকের উদ্দেশ্য। গল্পের প্রারম্ভে বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠে।

আমার নেশা আর শফিকের ব্যবসা ভালোই চলছে। আড়তদারের মন ভাঁজিয়ে লাখ লাখ টাকা পুঁজি পাচ্ছে শফিক। সে ব্যবসা করছে চার হাতে। আর আমিও বসে নেই। ঢাকায় যাবার নেশা পেয়ে বসেছে। আড়তদারের ময়ূরপঙ্খি খাটে হেলান দিয়ে বিচিত্র বিষয় নিয়ে তর্ক করার নেশা আফিমের নেশার মতো আমারে ধরেছে।’ (পৃ. ১)

শফিকের স্ত্রীর স্বকণ্ঠে উচ্চারিত এই নেশা কিসের নেশা? শফিকের ব্যবসা ভালো চলার পেছনে এই নেশার কার্যকারিতা রয়েছে। অশিক্ষিত শফিকের রুচিশীল শিক্ষিতা বধূ স্বামীর ব্যবসায় স্বচ্ছলতা নিয়ে আসার জন্য মহাজনের লোভের শিকার। শফিকের সম্মতিতে চলে মহাজনের কাছে দেহদান। পুঁজিপতি ধুরন্ধর মহাজন সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক বিষয়ে জ্ঞান রাখে, যা শফিকের স্ত্রীর পছন্দনীয়। জ্ঞান পিপাসা বা অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহ রয়েছে এ নারী চরিত্রে। অর্থ লোভী হলেও এ চরিত্রটি মহাজনের প্রেমে ব্যাকুল। রাধার যেমন কৃষ্ণের প্রতি তীব্র দৈহিক আকর্ষণ ছিল, তেমনি মহাজনের প্রতি রয়েছে শফিকের বউয়ের তীব্র আকর্ষণ, যা আফিমের নেশার মত। এ আকর্ষণ শুধু দৈহিক নয়, মানসিক। এ নারী চরিত্রটি মহাজনের প্রেমে পড়েছে। এ প্রেম নিছক অর্থের প্রেম নয়। সাদামাটা স্বামী শফিকের চেয়ে জ্ঞানী ও ধনাঢ্য মানুষের সান্নিধ্য পাবার প্রেম। ঢাকায় থাকা প্রসঙ্গে শফিকের বউয়ের স্বীকারোক্তিতেই তার প্রমাণ মেলে,-

মানুষটা যে শক্তি দিয়ে টানছে, নিজেকে রক্ষা করার সেই শক্তি পাবো কোথায়? লোকে বলে, খুঁটির জোরে ভেড়া নাচে। আমার যা খুঁটি দেখছি, ভেড়া কেন ইঁদুর নাচলেই উপড়ে যাবে।’ (পৃ. ১৯)

টাকার লোভে মহাজনের বিছানাতে গেলেও এ নারী শুধুমাত্র টাকার বশ নয়। যদি তাই হতো তাহলে শফিককে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার করতে পারত। শরীর বিকিয়ে অর্থ উপার্জনে কিছুটা হলেও স্ববিরোধিতায়, অস্বস্তিতে নিজেকে উপহাস করেছে। এ চরিত্রটি একেবারে ন্যায়-অন্যায় বিবেক বোধ বর্জিত নয়। অর্থের বিনিময়ে শরীর বিকিয়ে দেওয়ার অপরাধ প্রবণতায়  ভোগে। সঙ্গত কারণেই বাবা মায়ের টাকার প্রতি নির্লোভ আচরণে সে ক্ষণিক আনন্দ পেয়েছে। মনের গোপন তন্ত্রীতে ধ্বনিত হয়েছে-

মা বলে-ছি মা! ছি! তওবা র্ক। এ কথা বলিস  না। জামাইয়ের টাকায় হাত দিস না।
আমি তখন আনন্দে লাফাই। বজ্জাত টাকা আমাকে কিনতে পারলেও আমার মা-বাবাকে কিনতে পারেনি। (পৃ. ১৫)

আড়তদাড়ের ময়ূরপঙ্খী খাটে শুয়ে সমসাময়িক আর্থসামাজিক বিষবাষ্পের গল্পসম তর্কের নেশা শফিকের বউকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে। তোতাপাখির মত আড়তদারের কথাগুলোই হৃদয়ঙ্গম করে, সবাইকে বলে বেড়ায়।আড়তদার দেহলোভী পুঁজিপতি হয়েও এখানে নারীর হৃদয় বেদীতে ঈশ্বরের স্থান দখল করেছে। সমগ্র সত্তাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যেন আড়তদারের কথাই শেষকথা।

কথাকার চন্দন আনোয়ার এ গল্পে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ, বুশের আগ্রাসন নীতি, বুশ-সাদ্দাম যুদ্ধ, তেল ও পানি যুদ্ধ, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, টুইন টাওয়ার ধ্বংস, সকল ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ বিশৃঙ্খলার প্রভাব ভোগ করে এই সকল অনুন্নত দেশের মানুষ। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশের মানুষগুলোর শেকড় ছড়ানো রয়েছে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে। সমৃদ্ধ দেশের রসাস্বাদন করে দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশের জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরিত হয় ।

টুইন টাওয়ার কোথায় আর কোথায় বা বাংলাদেশ-এই জন্যে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে লালবাতি জ্বলে। সর্বস্বান্ত মানুষরা বুকে থাপ্পড় মেরে গলায় ফাঁস নেয়। গার্মেন্টেসে শ্রমিক ছাটাই হয়। কেন? (পৃ. ১৮)

আড়তদার শফিককে কোটি টাকা দিতে চাইলেও শফিক মাত্র পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। কারণ অত টাকার সুব্যবস্থা সে করতে পারবে না। কৌশলী লেখক শফিককে আশ্রয় করে সরকারকে ইঙ্গিত করেন। দেশ পরিচালনায় বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থকে যথাযথ কল্যাণে কাজে লাগাতে না পারায় অতিরিক্ত অর্থ ফেরত চলে যায়। শফিক আর সরকার যেন এক হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে লেখক চন্দন আনোয়ার বাঙালি জাতির অদক্ষতা, কর্মবিমুখতা ও আরামপ্রিয়তাতে কুঠারাঘাত করেছেন। বিশ্বের যে সকল দেশ উন্নত তারা নারী পুরুষ নির্বিশেষে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পদ ও সময়কে যথাপযোগী কাজে লাগিয়েই উন্নত হয়েছে। সারাবিশ্বে নিজের কর্তৃত্বকে বজায় রেখেছে:

ভিয়েতনাম, জাপান, চীন, মার্কিনে গিয়া দেখেন, আপনাদের মতো মেয়েমানুষরাই ক্ষেত-খামোরে কাজ করে। টিভিতে দেখেন না-কাগজের মতো ধবধবে ফর্সা, নাক-মুখ চ্যাপটা মেয়েমানুষ প্যান্ট-গেঞ্জি পরে চড়া রোদের মধ্যে পুরুষের সাথে মাঠে কাজ করে। সেই দেশের গম-চাল-টাকা দিয়েই তো এই দেশ চলে। (পৃ. ২১)

দেশের ১৬ কোটি জনগণের অধিকাংশই নারী। জাতির সামগ্রিক কল্যাণে, নারী পুরুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজে লাগানোর পক্ষাপাতী লেখক। কর্ম ছাড়া মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও দেশের অর্থনীতির সাথে তেমন কোনো সম্পৃক্তি নেই। লেখক শফিকের বউয়ের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন নারীর অর্থনৈতিক জাগরণের কথা। চার দেয়ালের বাইরে বেড়িয়ে এসে স্বাবলম্বী স্বাধীন জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন লেখক। অর্থের বিনিময়ে দেহ বিলিয়ে দেয়া পরাস্ত নারীর মুখে নারী জাগোরণের বাণী আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা বেমানান মনে হলেও সার্বিক সামঞ্জস্য লেখকই রক্ষা করেছেন। এ বিশ্বাস ও বাণী শফিকের বউয়ের নিজের নয়। তা আড়তদারের মুখের কথা। সমাজসচেতন লেখক চন্দন আনোয়ার নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসকে আড়তদাড়ের মাধ্যমে শফিকের বউয়ের মুখদিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলিয়েছেন মাত্র। বারো হাত শাড়ি শরীরে জড়িয়ে দাসী বৃত্তিতে লেখকের প্রবল আপত্তি। আড়তদারের মাধ্যমে শফিকের বউয়ের মুখ দিয়ে যেন সে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন।

প্রয়োজনে ক্ষেত-খামারের কাজই করবেন। লাঙল-গরু-কাস্তে নিয়ে মাঠে যাবেন। জমিতে লাঙল দিবেন। ধান বুনবেন, ধান কাটবেন, বিল থেকে মাথায় করে ধান বাড়ি আনবেন। দুনিয়ার সবখানেই মেয়েমানুষরা ক্ষেত-খামারে কাজ করে। আপনারাই খালি পারেন না। বারো হাত শাড়ি পরে সারাজীবনের জন্য দাসি হয়ে যান। গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা দিয়ে দেশের জনসংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কোন কাজটাই আপনারা করেন? (পৃ. ২০)

ঢাকায় আড়তদারের বাড়িতে যাওয়ার প্রশ্নে গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের কটূক্তি ও বাঁকা হাসিতে শফিকের বউ তোতাপাখির মত আড়তদারের শিখানো বুলি উগরে দেয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিজেকে ডিফেন্স করে এই বলে ‘আমি কেউ না’। এই আমি কেউ না উক্তিতেই গল্পের সমাপ্তি। আবার ভাবার্থে এই সমাপ্তির মাঝেই চিন্তার সূচনা। রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা ভোগী, বসবাসকারী জনগণ ও তাদের জন্ম, মৃত্যু কোনো কিছুই বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে না। রাষ্ট্র নায়কের দেশ পরিচালনায় জনগণের ব্যক্তি মতামত মূল্যহীন। প্রকৃতপক্ষে লেখক গণতন্ত্রের অন্তঃসার শূন্যতা ও ধীরে ধীরে তা নিস্ক্রিয় হয়ে বিকলাবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। কেননা সমৃদ্ধ অর্থনীতি, উন্নত জাতি ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তির অস্তিত্বই প্রধান শক্তি।

পুঁজিবাদ ও দারিদ্র্যের ভয়াল কষাঘাত ও জীবনবাস্তবতা নিয়ে রচিত গল্পগুলোর মাঝে অন্যতম গল্প ‘পাঁচ শ টাকার নোট’। নিম্নবিত্তের মানুষের চলমান জীবন জটিলতাকে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ গল্পের বিষয়বস্তু করেছেন। গল্প কাহিনি বর্ণনায় মনে হয় যেন সিনেমার দৃশ্যপট হচ্ছে। চলমান সমাজবাস্তবতা ও জীবনবাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক।

সমাজের নিচুশ্রেণির অশিক্ষিত সুবিধা বঞ্চিত নিরীহ নোয়াব আলির জীবন যুদ্ধের গল্প  ‘পাঁচ শ টাকার নোট’। ফ্লাশব্যক পদ্ধতিতে গল্পের সুচনা। এ গল্পের সূচনাতেই পাই পেটের দায়ে নোয়াব আলীর স্ত্রী তমিজা খাতুনের দেহ বিক্রির চিত্র। হাতের মুঠোয় কড়কড়ে পাঁচ শ টাকার নোট নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে কি বিধাতার কাছে মাপ চেয়ে নিল? তা নাও হতে পারে। হতে পারে পাঁচশ টাকা রোজগারের জন্য বিধাতাকে ধন্যবাদ দিল। আজ থেকে ছেলে দুটার মুখে গরম ভাত তুলে দিতে পারবে ভেবে। নিষ্ঠুর জীবন ও জীবিকার তাগিদে ইচ্ছের বিরুদ্ধে এমনতর কাজও করতে হয় তমিজা খাতুনকে। ৪০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি চাল কিনে বাড়ি ফেরত রিক্সাচালক নোয়াব আলির শরীর রোদে ঘামে পুড়ে পোড়া ইটের মত শক্ত আর লাল বর্ণ ধারণ করত। বুড়ি শাশুড়ির মুখে সে গরম ভাত তুলে দিতে পারেনি। ভাতের অভাবে বুড়ি মারাই গেল শেষপর্যন্ত। অথচ আজ এক রাতে তমিজা খাতুনের হাতে পাঁচ শ টাকার কড়কড়ে নোট। তবুও কি একথা বলা যাবে যে, আজ তমিজা খাতুন সুখি? আধ পেটে খেয়ে থাকা দারিদ্র্যক্লিষ্ট তমিজা খাতুনের হৃদয়ের ঐশ্বর্য ভেঙে যায়। নড়ার শক্তি নেই, মুখে আওয়াজ নেই। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা, তাই এই শরীরে এই অবস্থায় স্বামী নোয়াব আলিকে স্মরণ করতে চায় না। আজ নির্মম বাস্তবতার কাছে তমিজা খাতুন হার মানতে বাধ্য হয়েছে ।

গল্পটিতে মূল চরিত্র তিনটি নোয়াব আলী, তমিজা খাতুন ও তার বৃদ্ধা শাশুড়ি। প্রত্যেকটি চরিত্র নিজ নিজ অবস্থান থেকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। তমিজা খাতুন চরিত্রটি প্রবল জীবনবাদী ও বুদ্ধিমতি। তার শাশুড়ি গরম ভাত পেলে এই বয়সেও শুধুমাত্র লবন মরিচ দিয়েই দুই থালা খেতে পারে। অভাবী তমিজা বিনা বাক্য ব্যয়ে এর সমাধান করেছে। শাশুড়িকে মায়ের মত ভালবাসলেও তাকে সবসময় ঠাণ্ডা সিঁটকে ভাত খেতে দিয়েছে। শাশুড়িকে দুই থালা গরম ভাত খেতে দিতে না পারার কষ্ট তাড়া করে তমিজাকে। সে নিরুপায় কারণ স্বামী নোয়াব আলীর সে পরিমাণ চাল কেনার সাম্যর্থ নাই।

কালোবাজারি, মজুতদার ও পুঁজিবাদ গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে। সে প্রভাব গ্রাস করেছে নিম্নবিত্ত মানুষের খেয়েপড়ে বাঁচার নিশ্চয়তাকে। বস্তির ঘরে ঘরে প্রায় একই দৃশ্য। দিনশেষে তমিজার স্বামী কম চাল কিনে বাড়ি ফিরলেও স্বামী কষ্ট পাবে ভাবনায় কখনোই মুখে কিছু বলে না। বিপরীতে, অতৃপ্তিতে প্রচণ্ড ক্ষোভে তমিজা খাতুন পঁচা পটলের উপরে পা চাপিয়ে পিসে ভর্তা বানায়। যেন রাষ্ট্রের হর্তা কর্তা যারা, তাদের পায়ের নিচে ফেলে পিষে নিজের অক্ষম ক্রোধ দমন করছে। নির্বাক নোয়াব আলী শুধু চেয়ে দেখে।

দুর্ভিক্ষের প্রক্ষাপটে রচিত বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটক অথবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘নয়নচারা’ গল্পের পটভূমি স্মরণ হয়। দুর্ভিক্ষের সময় সব চাইতে বেশি কষ্টে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সমাজের সভ্যতার ভারসাম্য রক্ষাকারী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি, পারে না আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সহজে হাত পাততে। আত্মসম্মানই তাদের একমাত্র সম্বল। আর এই আত্মসম্মান রক্ষা করতে যেয়ে দুর্ভিক্ষের প্রকোপে দলে দলে ঘরের ভেতর না খেয়ে শুকিয়ে মরে পড়েছিল অসংখ্য মধ্যবিত্ত মানুষের লাশ। পাঁচ শ টাকার নোট গল্পে ন্যায্যমুল্যের দোকানে তেমনি দেখা মেলে এক মধ্যবিত্ত স্কুল শিক্ষকের যুবতি সুন্দরী মেয়ের। মাত্র তিন টাকা কমে চাল কেনার জন্য ক্ষুধা পেটে ও লজ্জা মুখে নিয়ে নিম্নশ্রেণির মানুষের সাথে লাইনে দাঁড়িয়েছে। তমিজা খাতুনের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মকথন:

তোর আসার কি দরকার এখানে? এত ভদ্রলোকের বেটি তুই! তোদের জন্যে তো হাজার হাজার মন চাল থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে আড়তে। দোকানে। কি চাল নিবি? বাসমতি, নাজিরশাহ, মিনিকেট কি কি সব বাহারি নামের, গন্ধের চাল ভদ্রলোকদের জন্যে। চালের আকাল তো মোটা চালের।  হাড়হাভাতের দেশ কি না! (পৃ . ২৬)

নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্ষুধার্ত ক্লান্ত শরীরকে লেখক বলেছেন পেটের অসুখ। সত্যিই পেটের অসুখে ভুগছে সারাদেশ। এ গল্পে পেটের অসুখের ওষুধ নিতে অর্থাৎ মাত্র তিন টাকা কম দামে চাল কিনতে স্কুল টিচার তার কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে লাইনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু নিজে দাঁড়ায়নি। মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি হয়ে সরকারের সম্মান রক্ষার্থে ক্ষুধার্ত শুকনো মুখে দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। তমিজা খাতুনের মন জুড়ে প্রশ্নের আনাগোনা।

কেন কলেজ পড়–য়া মেয়ে ন্যায্যমূল্যের দোকানের লাইনে? কতটা জঠরের জ্বালা হলে তিন টাকা বাঁচাতে একজন স্কুল টিচার তার যুবতী মেয়েকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন? সে নিজে কেন দাঁড়ায়নি? দাঁড়ালে কার লজ্জা? তার? নাকি তাদের? কার সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাইছে সে? তমিজা খাতুনের খুব ইচ্ছে হয় বুড়ো মানুষটাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে একেবারে সব কিছু ন্যাংটো করে দিতে! (পৃ. ২৭)

এভাবে দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে মধ্যবিত্ত মানুষগুলোও যদি রাস্তায় নেমে আসতো, যদি মিথ্যা লজ্জা আর অহমিকাকে পায়ে মাড়িয়ে ন্যায্যমুল্যের দোকানে নিম্নবিত্তের সারিতে দাঁড়াতো, তাহলে নড়ে উঠতো জনবিচ্ছিন্ন সরকারের ভিত্। ভূমিকম্প শুরু হত রাষ্ট্র নায়কদের একনায়কতন্ত্রের ভূমিতে। মধ্যবিত্তের লজ্জা আর আত্মসম্মানকে পুঁজি করে পুঁজিপতিরা টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে যার প্রভাব পড়েছে এ সাধারণ মানুষগুলোর উপরে। এ গল্পে তমিজা খাতুন বুদ্ধিমতি এবং বিদ্রোহী। চালের বস্তার উপরে বসে থেকে দোকানদার ছেলে যখন বলে চাল নাই তখন দুর্নীতি মেনে নিতে না পেরে তমিজা খাতুন চেয়েছিলো বিক্ষোভ ঘটাতে। ‘তমিজা খাতুন ভিতরে ভিতরে ফন্দি আঁটে। মানুষগুলোকে ক্ষেপিয়ে দিতে হবে। চাল নেই! চাল শেষ! ডাহা মিথ্য কথা বলে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর সাথে চাতুরি করছে। চাতুরি ছুটাবো দাঁড়া!’ (পৃ. ২৮)

অভাবের তাড়নায় তমিজা খাতুনের মতো মানুষের চিন্তাচেতনায় সর্বদা হানা দেয় খাবারের চিন্তা। পেটের ক্ষুধা সকল চিন্তাকে গ্রাস করে। গরম ভাত চুলাতে বসিয়েও গ্লানি ঘুচে না। কারণ আর একটু সকালে লাইনে দাঁড়ালে সে এক কেজির জায়গায় সোয়া কেজি চাল পেত। শাশুড়িকে গরম ভাত খাওয়ানোর মানসে চুলাতে ভাত বসায় কিন্তু বুড়ি মুখ হা করে অসীম ক্ষুধা নিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। মড়ার পরেও মুখের হা বন্ধ হয় না। বুড়ির পেটে আজন্ম ক্ষুধা যেন গোটা বিশ্বকে মুখে পুরে দিলেও তার ক্ষুধা মিটবে না।

কবি সুকান্তের কবিতার কথা স্মরণে আসে। ‘ক্ষুধের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ এমনি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক বাস্তবতা ফুটে উঠেছে তমিজার শাশুড়ির মৃত্যুতে। বুড়ির মৃত্যুর পরে তমিজা খাতুনের মুখ চেপে ধরে চাঁন বানু, ‘চিল্লানি বন্ধ কর ছেঁড়ি। বুড়ি মরলেই তো লাভ। দুইডা ভাত বাঁচবো!’ (পৃ. ৩০)

বুড়ি বোঝে না পুত্রবধূর ভালোবাসা। ছেলের রোজগারে সে পেট ভরে খেতে পায় না। বিলাপ করে নিজের স্বামীর জন্য যিনি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। বাঙালি নারী তমিজা সব সহ্য করে কিন্তু নিজের স্বামীকে অবজ্ঞা ও তুলনায় অন্য নারীর স্বামীর সুনাম সহ্য করতে পারে না। তাই দাঁত খিচিয়ে শাশুড়ির সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। নোয়াব আলির পিতা মুক্তিযোদ্ধা। গল্পটিতে এই একটি শব্দ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ যোগ হওয়ায় সমাজের অন্য আরেকটি দিকও উন্মোচিত হয়। যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের পরিবারের বর্তমান হীনাবস্থার বাস্তব চিত্র প্রকাশিত হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, রিকশাচালক নোয়াবের মা বুড়ি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে বস্তির ঘরে ঘরে পুত্রবধূ তমিজা খাতুনের নামে বদনাম রটায়। সেই বদনামই কাল হয়। মাতৃঘাতী অপরাধে থানা থেকে পুলিশ আসে এবং নোয়াব আলিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পেটের ক্ষুধার দায় যার, সে স্বামী পাশে নাই, তমিজা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামে। প্রথম রোজগার পাঁচ শ টাকার নোট। ক্ষুধা, দারিদ্র ক্লিষ্ট জীবনবাস্তবতার স্রোতে হায়িয়ে গেল তমিজা খাতুনের সংসার, সম্ভ্রম ও আপনজন।

লেখকের ‘দুই বিধবার নিশুতি রাত’ গল্পটিকে জীবনবাস্তবতার চরমপত্র বললে শেষ হবে না। যে কষ্ট মেনে নেয়া যায় না, এমনই এক জটিল কঠিন সত্যের সম্মুখীন হয় পাঠক। নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ রাত মানুষের দুঃখকে বাড়িয়ে দেয় শতগুণে। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে নব পরিণীতা বধূ এখন স্বামী হারা। আটচল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে ঘটে যাওয়া বাসর রাতের মধুময় স্মৃতি, কথোপকথোনের রেশ থেকে যায় যুবতীর বধূর শরীরে, অন্তরে। সারাজীবন এই সুখস্মৃতিটুকুই হবে নববধূর বেঁচে থাকার অবলম্বন। লজ্জার নিগূঢ় না ভাঙতেই ভয়ংকর এক সড়ক দুর্ঘটনায় ট্রাকের সাথে অটোরিক্সার সংঘর্ষে স্বামীর মৃত্যু হয়। ঘরের পাশে কলতলায় বাঁশঝাড় হয়েছে যুবকের চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার স্থান। এ অবস্থায় যুবতী বধূর চৈতন্য লোপ পেয়েছে। স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও স্বামী সঙ্গ তথা আলিঙ্গনের আকর্ষণে নিশুতি রাতে ছুটে যায় স্বামীর কবরের পাশে, প্রচ- আবেগে স্বামীকে ডাকে-

যুবতী কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ডাকে_হেই! হেই!! ঘুমাইয়া পড়লেন নাকি? কি গো! হেই! হেই!! ঘুমাইলেন নাকি? শুনতে পারছেন না? হেই! কয়েক হাত দূর থেকে শুনতে পারছে না। যুবতী গাল ফুলায়। কপালের ঘাম মুছে আঁচলে। ঘন ঘন মুছে। মরার ঘুম!... কাঁপা কণ্ঠ। কাঁপা ঠোঁট। ফিসফিস করে ডাকে, হেই! ঘুমাইছো নাকি? ঘুমাইছো? রাত যে পড়ে এলো। ঘরে চলো। ধূর ছাই! ভাল্লাগে না। মাফ চাই। ঘরে চলো। (পৃ. ৮৭)

বাস্তব সত্যকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় যুবতীর মন। স্বামীকে মৃত ভাবতে পারে না যুবতী। দ্রুত এবং আকষ্মিক ঘটে যাওয়া জীবনের প্লট পরিবর্তনের ঘটনা মেনে নেয়া এতো সহজ হয়ে উঠে না। মানব চরিত্রের এ কঠিন দিকটিকে দুঃখময় পরিবেশ, কাহিনি ও চরিত্রের মাধ্যমে অতি বাস্তবতার আলোকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন কথাকার চন্দন আনোয়ার। দুই বিধবার একজন যুবক রহিমের মা অন্যজন স্ত্রী। বিধবা নারীর একমাত্র অবলম্বন পুত্র রহিমের মৃত্যুতে মাতৃমনে যে দাগ কেটে যায় তা অনুভবে পাষাণ হৃদয়ও কেঁপে উঠবে। বিধবা নারী, বিধবা পুত্রবধূর বুকের হাহাকার অনুভব করে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা যুবতীর পিছু নিতে তাই শাশুড়ির সমস্যা হয় না। কারণ তিনি জানেন এ অবস্থায় ঘরে থাকা যায় না। কোন এক সময় এমন পরিস্থিতির মুখে তাকেও পরতে হয়েছে। প্রিয়তম যে স্থানে সে স্থান যুবতীকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করবে এমনটাই স্বাভাবিক। নব পরিণীতা বধূ তাই শুনতে পায় স্বামীর ডাক। ‘সে ওখানে ডাকছে কেন? কেন ডাকছে? ডাকবে কেন? রাত যে পড়ে এলো। ঘরে যেতে হবে না।’ (পৃ. ৮৬)
স্বামী সঙ্গের তৃষ্ণায় যুবতীর বুকের ছাতি ফেটে যায়। তাই রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকার তাকে ভয় দেখাতে পারে না। বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। প্রবল আকর্ষণে চৈতন্যহারা স্ত্রী ছুটে যায় স্বামীকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। গল্পটিতে জীবনের করুন বাস্তবতার সুর ধ্বনিত। প্রিয়-বিয়োগের ব্যাথায় ব্যথাতুর পাঠক হৃদয়। গল্পের প্রয়োজনে গল্প নয়। গল্প যে জীবনের চরম সত্য ভাষণ তা উপস্থাপনার ভঙ্গি ও ভাষার যাদুতে প্রমাণ করেছেন কথাকার।

রাজনৈতিক ও  সামাজিক বাস্তবতা:
মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজিক জীবনযাপনের সাথে রাজনীতির সহাবস্থান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতির আচ্ছাদনে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন। সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন ও জীবিকায় এই রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার ছায়াপাত ঘটা স্বাভাবিক। কথাসাহিত্যিক চন্দন আনোয়ার ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ গল্পগ্রন্থের কিছু গল্পে তিনি চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সামাজিক বাস্তবতার চিত্র উন্মোচন করেছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের ছায়া পড়েছে ‘আমাদের যুবক নেতা’ গল্পটিতে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে নোয়াখালীর আধিবাসী মজিদ যেভাবে শুধুমাত্র উপস্থিত বুদ্ধিকে পুঁজি করে মহব্বত নগর গ্রামে প্রভাব বিস্তার করে এবং নিজের ব্যক্তিস্বার্থে গ্রামের মাতব্বর থেকে শুরু করে সকল মানুষকে হাতিয়ার করে ব্যবহার করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে তেমনি  আমাদের যুবক নেতাও শুধুমাত্র বুদ্ধিকে পুঁজি করেই বড় বড় নেতাদের টেক্কা দিয়ে চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করেছে। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির খেলায় খেলুড়ে চরিত্র যুবক নেতা। কথাকার চন্দন আনোয়ারের ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পগ্রন্থের ‘মা ও ককটেল বালকেরা’ গল্পের বালক আইনা ও কিশোর মকু চরিত্রের পরিণত রূপ অবলোকন করি যুবক নেতার চরিত্রে। কৌশলী লেখক তার কৌশলচক্রে ক্রমানুসারে এক একটি গল্পের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে একজন অযোগ্য রক্তচোষা নেতার জন্ম ও বিকাশ ঘটে। ব্যাঙের জীবনচক্রের মতো একজন রাজনৈতিক নেতার জীবনচক্রের বর্ণনা দিয়েছেন। বর্তমান রাজনীতিতে এমন নেতার সংখ্যাই বেশি। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে দেশ আজ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ছে। পার্লামেন্টে যথার্থ দেশসেবীর দেখা পাওয়া দুষ্কর। পুঁজিবিহীন এই ব্যবসায় কোটিপতি হওয়া খুব সহজ। লেখকের ‘মা ও ককটেল বালকেরা’ গল্পে নোটের বিনিময়ে ককটেল ছোঁড়ার প্রস্তাবে বালক আইনার দাবী করে, কইডা দিবেন? একটা দইুডা দিলে কিন্তু আমি কামে যাইতাম না। কমপক্ষে দশটা দিতে অইবো।’ (‘অসংখ্য চিৎকার’ : পৃ. ৩১) আবার একই গ্রন্থের ‘করেটির ছাদে গুলি’ গল্পে কিশোর মকুর উক্তি ‘সব ইস্তেফা দিয়ে এখন ইনকামে শটকাট লাইন। পলিটিক্স। এই লাইনে এক টাকাও পুঁজি লাগে না। লাভ আছে লোকসান নাই।” (‘করোটির ছাদে গুলি’, পৃ. ৩৫)। এরই ধারাবাহিকতার যুবক নেতার পরিণত ও কৌশলি উক্তি,-

লেখাপড়াই কি সব গ্রাম বাঁচাতে হবে না? গ্রামের উন্নয়ন কে করে?... গ্রামে ফিরে আর অপেক্ষা করে নি। বাবার টাকার ক্লাব চালিয়ে পার্টির নাম জুড়ে দিল। গ্রাম উন্নয়নের একটা সহজ উপায় বটে। তবে শহরে একেবারে ছাড়া যাবে না, পলিটিক্সের আখড়াই ...’ [পৃ. ৫৯]

আইনা, মকু চরিত্রের পরবর্তী ধাপে ‘আমাদের যুবক নেতা’ গল্পে পরিণত বুদ্ধির যুবক নেতা পাই। হয়ত চন্দনের পরবর্তী গল্পগ্রন্থে এই যুবক নেতাই দক্ষ বর্ষীয়ান নেতায় পরিণত হবে। প্রচলিত জনমত বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি হত্যা ও রক্তের রাজনীতি। জোর আর অস্ত্র যার ক্ষমতা ও মুলুক তার। গণতান্ত্রিক দেশে সুস্থ রাজনীতি চর্চা  হয় না। এই সকল যুবক নেতাই দেশ ও ক্ষমতার কর্ণধার যারা শুধু নিজেদের ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। গ্রাম উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সর্বসম্মুখে ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটায়।

শিক্ষা মানুষকে আলো দেখায়, শিক্ষালব্ধ জ্ঞান মনকে বিকশিত করে ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ শিখায়। শিক্ষাযুদ্ধে পরাজিত সভ্যতার আলোহীন যুবক কেমন করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত পৌঁছায়? এ গল্প তারই আখ্যান। আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও। আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব।’ একজন শিক্ষিত মা যদি শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে পারে তাহলে একজন শিক্ষিত নেতাই পারে দেশের উন্নয়ন সাধন করতে। অশিক্ষিত, জ্ঞানের আলোবর্জিত বর্বর নেতার দ্বারা খুন, ধর্ষণ, চোরাকারবারী, কালোবাজারী, মজুদদারী, মাদক ব্যবসা এমন কোন অন্যায় নেই যা করা সম্ভব নয়।

যুবক নেতার গ্রাম উন্নয়নের শর্তে চাঁদাবাজি দিয়ে রাজনৈতিক প্লটে পদার্পণ। শহুরে বন্ধুদের সাথে আকণ্ঠ মদ গিলে, স্বপ্ন দেখে হাটের ইজারা নেবে। প্রতিপক্ষ পিতৃতুল্য অছির আলিকে প্রথম ভয় দেখায় ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে রবিউলকে দিয়ে ইজারাদারের ক্যাশিয়ার নিরাপরাধ মানিক মিয়াকে খুন করায়। পুলিশ কর্তৃক রবিউলের গ্রেফতার হওয়া এবং পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করে পুলিশি পাহারায় গলায় ফুলের মালা দিয়ে হাট প্রদক্ষিণ করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে যুবক নেতা। বস্তুত, কৌশলী যুবক নেতা হাটের ইজারাদারী অছির আলী থেকে নিজে করায়ত্ত করতে চায়। তাই এসব কঠিন ও নৃশংস নাটকীয়তার সৃষ্টি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে।

এক রাত পুলিশের হেফাজতে থাকতে হয় রবিউলকে। পরের দিন বিকেলে-ই দেখা গেল, ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে বাজারের এ মাথা ও মাথা চক্কর মারছে। পেছনে যুবক নেতা ও যোদ্ধাসাজে তার কর্মীরা। ওদের আগে-পিছনে দু-জন করে পুলিশ। রবিউলের পরনে জিন্সের প্যান্ট, পায়ে বাটার দামি কালো সু, লালরঙের টি-শার্টের মধ্যিখানে বাংলাদেশের পতাকার সবুজ বৃত্ত। (পৃ. ৬২)

রবিউলের গায়ে জড়ানো লাল রঙের টি-শার্ট। তার মাঝে বাংলাদেশের পতাকার সবুজ বৃত্তের বর্ণনায় রয়েছে অভিনবত্ব। বাংলাদেশের পতাকায় সবুজ রঙের ভিতরে আছে একটি লাল বৃত্ত যা বাংলার স্বাধীন সূর্যের প্রতীক। লেখক অত্যন্ত কৌশলে বাংলার স্বাধীন ভূমির প্রতীক পতাকার সবুজ অবয়বকে রাজনীতিবিদের বুকে লাল রঙের মাঝে সংস্থাপন করেছেন। যেন সবুজ বৃত্ত সমগ্র বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রতীক হয়ে এহেন খুনি রাজনীতিবিদদের নষ্ট বুকের খাঁচায় অবদ্ধ। তথাকথিত কতিপয় রাজনৈতিক নেতা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া জনসম্মুখে উন্মোচন করে দেশ ও জনগণের দায়িত্ব নেওয়া নেতার যোগ্যতা, অন্তঃসার শূন্যতা, নৃশংসতা, হৃদয়হীনতা, ঘৃণ্য জঘন্য মুখোশ পড়া আচরণ ও মিথ্যাচারিতাকে খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন গল্পকার।

পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্র কৌশলে জনসমক্ষে চাঁদাবাজি দিয়ে শুরু করে পথ চলা। পরবর্তী ধাপে খুন করে হাটের ইজারাদার হয়। এরপরে লক্ষ্য থাকে চেয়ারম্যান ইলেকশনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। হয়ত তৎপরবর্তীতে আরো বড় পদে নির্বাচিত হবে এবং পার্লমেন্টের আসন অলংকৃত করবে। এমনি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলে যুবক নেতার বর্ষীয়ান নেতা হওয়ার পাঠ পরিকল্পনা। কাহিনি নির্মাণ বিষয়বস্তু, ভাষা, সংলাপে এবং উপস্থাপনার ভঙ্গিতে গল্পটি সুখপাঠ্য ও অসাধারণ।

‘এক রাতে নরমেধের বর্বরতার আনন্দ আমাকেও নিতে হয়।’ -এমনি বক্তব্যে চন্দন আনোয়ারের ‘বারবনিতা এসোয়িয়েশন’ গল্পের সূচনা। ‘নরমেধ’ শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যার পরবর্তীতে গল্পালোচনা করা প্রাসঙ্গিক। মৌলিক বৈদিকগ্রন্থ বেদসংহিতা, উপনিষদ ও বাহ্মণ গ্রন্থে নরমেধ বলতে মানুষের মৃত্যুর পরে তার আত্মার সদগতি কামনায় অগ্নিদাহ ভিত্তিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে যে যজ্ঞ করা হয় তাকে বোঝায়। পরবর্তীতে পৌরাণিক যুগে অল্পশিক্ষিত ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতগণ বেদের যথার্থ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে না পারায় ‘নরমেধ’ শব্দটিকে নরবলি দেওয়ার যজ্ঞানুষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ ‘নরমেধ’ শব্দটি বিশেষ্য রূপে নরবলি দেওয়ার  অনুষ্ঠান পালনের নাম।

নরবলির মতো হিংস্র প্রথা কার্যকর করার পূর্বে বর্বর আদিম আচার পালনের যে উৎসব পালন করা হয় তাকেই নরমেধ বলে। সূচনা বক্তব্যই প্রমাণ করে বিংশশতকের আধুনিক রাষ্ট্রে কথক তেমনই এবং সীমাহীন বর্বর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। যে বর্বরতা নরমেধের বর্বরতার সমতুল্য। গল্পটি আত্মকথন ষ্টাইলে লেখা। গল্পকথক নবীন সরকারি কর্মকর্তা। চাকুরী নিয়ে ছোটশহরে পদার্পণ করেই জানতে পারে বারবনিতা এসোসিয়েশন সম্পর্কে। এই এসোসিয়েশন রাজনীতির মঞ্চে প্রকাশ্যভাবে মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী দেবে। এই সম্পর্কিত বিষয় মিটিংয়ে উঠলে, সকলের অধিকার সমান এমন বোধ থেকেই অবিবাহিত যুবক হঠাৎই সহজ সরল ভাষ্যে চাকরিজীবনের প্রথম মিটিংয়ে বারবনিতাদের পক্ষ নিয়েই কথা বলে। সভার সকল সদস্য অবাক বিষ্ময়ে তাকায় যুবকের দিকে। সকলের দৃষ্টি যুবককে বাস্তবতার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ভুল বুঝে লাজ্জিত যুবক। পরবর্তী মিটিং থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে ভিড়ে যায়।

বারবনিতারা নিষিদ্ধ পেশার অধিকারী। নিষিদ্ধশ্রেণির সভ্যসমাজ থেকে মুখ লুকিয়ে বাঁচবে এটাই স্বাভাবিক। এ শহরের বারবনিতাদের এসোসিয়েশন গঠন ও মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবেই কথকের মনে জিজ্ঞাসা ও রহস্যের সৃষ্টি করেছে। কোথায় পেল বারবনিতারা এই শক্তি ও সাহস?

প্রকৃতপক্ষে বারবনিতাদের এই শক্তি ও সাহসের যোগানদাতা সমাজের সুশীল ও ভদ্র বলে পরিচিত উচ্চশ্রেণির সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাসহ সর্বস্তরের পুরুষ। যাদের অহরহ আনাগোনা লীলাবালার আস্তানায়। শরীরের বিষমুক্ত হয়ে অমৃতপানে লীলাবালার গৃহে কৃষ্ণলীলার জুড়ি নাই। কথক নতুন শহরে আশ্রয় পায় দুই সহকর্মীর মেস সদৃশ্য একটি রুমে। দশটা এগারোটা পর্যন্ত আলাপ চললেও পরবর্তীতে চলে দুই সহকর্মীর ফিসফিস কথা। কথকের কৌশলে সহকর্মীদের ফিসফিস আলোচনার গ্রন্থিমোচন ঘটে। এই ঘটনা লীলাবালার দেখা পাবার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয়। অফিসের বেয়ারার মুখে উচ্চারিত হয় প্রকৃত সত্য:

এই শহরের নেতা বা মেয়র হতে হলে লিলাবালাকে আগে খুশি করে নিতে হয়।  নেতা বা মেয়রকে খুশি করতেও লিলাবালাকে খুশি করতে হয়। বীজগণিতের অঙ্কের সূত্রের মতো আর কি! এই শহরের বড় বড় পদের সবাইকে লিলিবালার খুশি নিয়ে ভাবতে হয়। (পৃ. ৮৯)

শহরের মেয়র ও তার চাইতেও বড় ক্ষমতার রাজনৈতিক নেতা লীলাবালার লীলার সাথী। লীলাবালা খুশি থাকলে এই সকল বড় বড় পদের সম্মানী মানুষ ক্ষণিক আনন্দের সন্ধান পায় নারী সঙ্গমে। তাই লীলাবালার খুশি থাকা অতীব জরুরী। একথা বুঝতে কথক সহ পাঠকের অসুবিধা হয় না। সত্য উন্মোচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক শ্রেণি পর্যন্ত লীলাবালার লীলায় জিম্মি। ‘সব সরকার-ই লীলাবালার সরকার। কাগজে কে লিখবে, ওরাও তো লীলাবালার...’ (পৃ. ৮৯)

সকল শ্রেণির পুরুষের আনাগোনায় সমৃদ্ধ বারবনিতার আবাসস্থল। সেই শক্তিতেই এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করে লীলাবালা। মিটিংয়ের খবর নিতে লীলাবালা অফিসারের রুমে প্রবেশ করে। কথকের বর্ণনার ভঙ্গি ও ঘটনার বাস্তবতা হাস্য রসিকতার জন্ম দেয়। এই দেহ সঞ্চারী বারবনিতা পোশাকে আশাকে অধুনিকা হলেও মুখ নিঃসৃত ভাষার কারুকার্যে প্রমাণ মেলে তারা সমাজের কোন স্তরের অধিবাসী।

পোশাক, শরীর, ভাবভঙিমায় মেয়েমানুষ তিনজন-ই আধুনিকা। কিন্তু মুখ খুলতেই ওদের ভেতরের খবরাখবর সব বেরিয়ে পড়ে।
ডানপাশেরটা প্রথমে মুখ খুলে_ লীলা বু, টাইম নাই।
বামপাশেরটা তারপর মুখ খুলে_ লীলা বু, টাইম নাইক্ক্যা।
এবার লীলা বু মুখ খুলে_ মিটিঙে কি করলেন?
কোন কারণ ছাড়াই স্যার ক্ষেপে ওঠেন, কিসের মিটিং? কে বলেছে?
ডান ও বাম পাশের ওরা এক পা করে সরে দাঁড়াল। লিলা বু স্যারের সমস্ত শরীর নিজের দুই চোখে বেঁধে ফেলে বলে, বাবুর যে তেজ! যদি...(পৃ.  ৯০)

বারবনিতার ঘরে প্রকাশ্যে গেলে সম্মানের হানি ঘটে। আবার রাতের আঁধারে সে সম্মান ক্ষুণ্ন হয় না। রারবনিতার শরীর হয় অমৃত সমান। এই প্রেক্ষাপটে সম্মান নামক কল্পনীয় বিষয়টির অবয়ব নির্মাণে ব্যস্ত লেখকের কলম। অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের “বারাঙ্গনা” কবিতা স্মরণে আসে। বুঝিবা নজরুলের মতো মহৎ হৃদয় লেখক চন্দন ধারণ করেছেন। তাই বারবনিতাকে করেছেন গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। বারবনিতা এসোসিয়েশন ‘নামক প্রকাশ্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রকৃত পক্ষে বারবনিতারা বারবনিতা হতো না, যদি না অতি ভদ্র চরিত্রবান পুরুষরা তাদের সংস্পর্শে যেত। বারবনিতা তৈরি করেছ পুরুষ জাতি। কিন্তু নিজের কাঁধে সে কলঙ্কের দায় রাখে নি, সকল দায় চাপিয়ে দিয়েছে সৃষ্ট শিল্প কর্মের উপরে। বারবনিতারা ঘৃণ্য। কিন্তু খতিয়ে দেখলে প্রমাণ মেলে এই ঘৃণ্য নারীর সুধা পানে সমাজের সকল স্তরের পুরুষের অবাধ যাতায়াত বারবনিতাদের ঘরে। সে দিকটি অনুধাবন করেই হয়ত মানবতার ধ্বজাধারী লেখক চন্দনের এই গল্প রচনা।

রুমে আশ্রয়প্রদানকারী ভদ্রজনদের অভিসারে সমস্যা সৃষ্টি করে কথকের উপস্থিতি। ঘুমের সমস্যা হয়,  এ অজুহাত দেখিয়ে কথককে মেস ছাড়তে অনুরোধ করলে তাঁর সাময়িক অবস্থান ঘটে শহরের একটি হোটেলে। ছোট্ট শহর কিন্তু হোটেলের অন্ত নেই। হোটেল ব্যবসাও রমরমা।  প্রকৃত সত্য হচ্ছে, হোটেল মালিকরা এই বারবনিতাদের হাত করে ব্যবসা করে। তাই দেখা যায়, হোটেল বয় কথকের সামনে হাজির করে বারবনিতাদের ক্যাটালগ। বারবনিতাদের ক্যাটালগ থাকতে পারে তা পাঠককে বিষ্মিত করে। রেস্টুরেন্ট এর খাবারের মেনুর মতই ক্যাটালগে নারীদের নিজের প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করা আছে। কী অভিনব কৌশলে লেখক একজন নারীকে পণ্য করে তোলার প্রক্রিয়াটি দেখিয়েছেন! কার্ল মার্কস যেমন দাস প্রথার সূচনায় দেখিয়েছেন পুঁজিবাদী সমাজে কিভাবে ক্রমানুসারে শোষণের শিকার একজন মানুষ নিজেকে দাস হিসেবে মেনে নেয়। তেমনি একজন বারবনিতাও অর্থের প্রয়োজনে নিজেকে পণ্যে পরিণত করেছে।

সেফ কৌতূহলের বশে কথক লীলাবতীর রাজ্যে প্রবেশ করে বোধোদয় ঘটে যে, এ বিষয়ে অধিক কৌতুলহল দেখিয়ে ভালো করে নি। ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কথককে পালাতে দিয়ে লেখক পাঠককে পরিভ্রমণ করায় লিলাবালার বাড়ির অন্য ঘরগুলোতে। পাঠক স্পষ্ট দেখতে পায় কী ঘটছে সেখানে? কথকের দেখা মেলে মিটিং এ উপস্থিত প্রথম সারির অফিসার পদের দুজনের সাথে, যারা নারী সঙ্গমে লিপ্ত। পরবর্তী রুমের দরজায় পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে খর্বাকৃতির যুবক জানায়, ভিতরে লিডার আছে। কথকের বুঝতে বাঁকি থাকে না লিডার ভেতরে কোন কাজে ব্যস্ত। দ্রুত স্থান ত্যাগ করে পূর্বাবস্থানে এসে ফ্রয়েডীয় চেতনার জাগরণ ঘটে কথকের মানব হৃদয়ে। আদিম দৃশ্যাবলী পুনর্বার দেখার ইচ্ছা জাগে, ‘এবার মনে হচ্ছে নরমেধের বর্বরতা আনন্দ-লোভ আমাকেও পেয়ে বসছে! দৃশ্যগুলি পুনর্বার দেখার লোভ হচ্ছে! (পৃ. ৯৪)

লীলাবালার ঘরের দেয়ালে চাবুক ও সঙ্গমরত অফিসারের হাতে চাবুকের উপস্থিতি নপুংসকতার বর্বরতাকে নির্দেশ করে। নবাগত কথককে উদ্দেশ্য করে বলা লীলাবালার উক্তিতে তার প্রমান মেলে।

এই শহরে একটাও মরদ নেই! সব নপুংসকের দল! এই শহরের আলো-বাতাস পর্যন্ত শালারা পেটে ঢুকিয়ে নপুংসক হয়ে গেছে। তুই নতুন আইছিস, দেখি তুই মরদ কি না? নে, তুই চাবুক হাতে নে! (পৃ. ৯৪)

শহরে অবস্থানরত বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতা সকলেই দুর্নীতির সাথে জড়িত। উন্নয়নের সকল অর্থ নিজে গ্রাস করে ভুঁড়ি মোটা করেছে। লেখক পর্দস্থ কর্মকর্তাদের সর্বগ্রাসী ভূমিকা তুলে ধরেছেন বারবনিতার মুখে। অযোগ্য এই সকল পুরুষকে অর্থের বিনিময়ে বারবনিতারা ঘরে স্থান দিলেও দেহের লালসা মেটায় চাবুকের আঘাতের নৃশংসতায়। তাই কাস্টমারের হাতে তুলে দেয় চাবুক এবং ধিক্কার দিয়ে গালি দেয় নপুংসক বলে। বারবনিতার এহেন আচরণ ও উক্তিতে মনে হয় লেখক বারবনিতার শরীরে চাবুকের চাপকানির আঘাতের মধ্য দিয়ে এই পুরুতান্ত্রিক সমাজের নপুংসকতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। নপুংসক পুরুষ ও এই নপুংসক সমাজের শিক্ষা-সংস্কার, পৌরুষত্বের অহমিকা, অন্তঃসারশূন্যতায় ক্রোধে কাঁপে লীলাবালার শরীর। প্রতিশোধে প্রতিহিংসায় ও ক্ষোভে দাঁত খিঁচিয়ে কামড়ে ধরে হাতের চাবুক। যেন পুরো সমাজটাকেই কামড়ে ধরেছে লীলবালা।

আগেকার দিনের রাজা-বাদশাহরা বারবনিতাদের গোলাম হয়ে থাকত। বারবনিতারা ছিলো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সংসার থেকে রাষ্ট্র শাসন ভার সকল ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ছিলো এই বারবনিতাদের। যুগের বিবর্তনে, কাল স্রোতে স্বাধীন দেশেও সে প্রথা প্রচলিত। এদেশের এক রাষ্ট্রনায়কের বারবনিতা নিয়ে মাতামাতিও লেখকের নজর এগিয়ে যায় না। বিজ্ঞ-বিচক্ষণ লেখক মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সীমা অতিক্রম করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে গল্প রচনা করেছেন। তবে সামাজিক বিশৃঙ্খলায় এই বারবানিতার দাপট চিত্র সেই রাজা-বাদশাদের সময় যেমনটি ছিল, বর্তমানেও তেমনটিই আছে। শুধুমাত্র আধুনিক পোশাকের মোড়কে এই রীতি একটু আধুনিক ও সভ্য হয়েছে। পূর্বে রাজাগণ প্রকাশ্যে বারবনিতার কেনা গোলাম হয়ে থাকতেন। বর্তমানের পুরুষসমাজ লোক চক্ষুর অন্তরালে এই সব দেহজীবী নারীর সান্নিধ্যে থাকে। অযোগ্য এই সকল নারী পরোক্ষভাবে দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে অফিস পরিচালনায় পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে রসাতলে যায় ব্যক্তি ও সমাজজীবন। বর্তমান সমাজে ঘটে যাওয়া এ এক জটিলতর সামাজিক ব্যাধি, যা সমাজ সচেতন লেখকের নজর এড়িয়ে যায় না।

‘একজন দৈবজ্ঞ ও একটি মৃত্যু’ গল্পটির সরল নামকরণে মূল বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নামকরণ বিশ্লেষণে মনে হয় গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি মৃত্যু ও দৈববাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে গল্পপাঠে স্পষ্ট হয় বিষয়টি মোটেই এতোটা সরল নয়। গল্পটিতে লেখক সমসাময়িক সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে একই থালায় পরিবেশন করেছেন সচেতনতার জ্ঞান। দুপুর রাতে হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছে। অপর প্রাপ্ত থেকে ভরাট কণ্ঠে একটি মেসেজ জানায়,

              নামাজ পড়েন! নামাজ! আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার আয়ু! (পৃ. ৮৩)

মাঝরাতে এমন অনাকাক্সিক্ষত ফোনে ঘুম ভাঙে সুমন রহমানের। উচ্চ রক্তচাপের রুগী, হার্টে দুইটা ব্লক সুমন রহমানের। আকষ্মিক মৃত্যুদূতের আগমন সংবাদে সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের অপেক্ষা করে না সুমন রহমান। দুর্বল চিত্তের মানুষের আত্মভাবনায়, পৃথিবী থেকে হঠাৎ চিরবিদায়ের সংবাদ বাড়ায় অস্থিরতা। এই অস্থিরতা স্ট্রোকের পর্যায়ে চলে যায়। স্ত্রী ফাহমিদাকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। নামাজ পড়ার নির্দেশনায় জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায় নামাজ আদায়ের জন্য। দু:চিন্তায় গভীর রাতে মিনি স্ট্রোকের শিকার হন সুমন রহমান। হঠাৎ অসুস্থ শরীরে নামাজ পড়ার তাড়া দেওয়ায় স্ত্রী বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। অন্যদিকে  ফোনকারীরর ভবিষ্যৎবাণী অলঙ্ঘনীয় দৈববাণীর মতো বিশ্বাস করে প্রতিটা মুহূর্তে অপেক্ষায় থাকে সুমন রহমান, কখন মৃত্যুদূত হাজির হবে। প্রকৃতপক্ষে মনের চেতন-অবচেতন স্তরে স্থান পাওয়া ঘটনা অলৌকিকভাবে সত্য হিসেবে মিলে যায়। মেডিটেশনের তথ্য মতে মনের ভয় সত্যে পরিণত হয়। মেডিটেশন স্তরে মনকে নিয়ন্ত্রণ করে জীবন পরিচালনা করা হয়। সেই তথ্য অনুসারে এবং একটি বিশ্বাসে পরদিন সকালে সুমন রহমান স্ট্রোক করে এবং তাঁর আত্মা দেহখাঁচা ত্যাগ করে।

কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা সুমন রহমানের আকষ্মিক মৃত্যু কালপ্রবাহে মানবাত্মার অন্তর্ধানের বাস্তবতার প্রকাশ। নির্দিষ্ট সময় শেষে সকল প্রাণিকে পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। চিরন্তন এ সত্য পাঠক মনে মৃত্যুচিন্তা ও পরলৌকিক চিন্তার আবহ সৃষ্টি করে। মুহূর্তেই আকষ্মিক ও অবিশ্বাস্যভাবে প্রিয় বিয়োগের ব্যাথায় ব্যথিত হয় পাঠক হৃদয়। মৃত্যু মানবজীবনের চিরন্তন সত্য ঘটনা। আলোচ্য গল্পে এ চিরসত্য কথনের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে ধর্মান্ধ সমাজের অসুস্থ মানসিক কার্যকলাপ ও মানুষকে ভীতি প্রদর্শেনের চিত্র।

সুযোগ সন্ধানী, মানসিকভাবে অসুস্থ ধর্মান্ধ কিছু মানুষ মনের খেয়ালে মাঝরাতে অচেনা নম্বরে ফোন দেয়। নিজের বিকারগ্রস্ত মনের চাহিদা অনুযায়ী ফোনের অপর প্রান্তের মানুষের সাথে কথা বলে। এই কথা বলার পরিণাম কত ভয়ংকর হতে পারে বিকারগ্রস্ত  কলদাতার তা বিবেচনায় থাকে না। থাকার কথাও নয়। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে এমন ঘটনা বিরল নয়। সে ঘটনার প্রেক্ষিতেই সুমন রহমানের মৃতে্যুর আলেখ্য রচনা করেছেন লেখক। পাশাপাশি দেখিয়েছেন ধর্মান্ধ মানুষেরা ধর্মকে পুঁজি করে সমাজে অহেতুক অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টায় লিপ্ত। বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদ ও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সারাবিশ্ব সংকটের সম্মুখীন। রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। জঙ্গীগোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংস করতে সচেষ্ট সারাবিশ্ব। সমসাময়িক ভয়ংকর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা গল্পটিতে উঠে এসেছে।

আধুনিক নগরকেন্দ্রিক জীবনে অনু পরিবারের সন্তানগুলো কিভাবে নিজ সংস্কৃতি ও রীতি-আচার থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে তার সুন্দর প্রকাশ সুমন রহমানের মেয়ের চরিত্রে ফুঁটে উঠেছে। আধুনিকতার বিষবাষ্পে বিষাক্ত তার চেতনা। ‘কৃষি’ শব্দটির প্রতি ঘৃণা। গল্পটির এ অংশটিতে লেখকের বিদ্রুপ প্রকাশ পেয়েছে এহেন শেকড়বিহীন মিথ্যা আধুনিকতার বিরুদ্ধে। পরিবারে সন্তানকে অধিক প্রশ্রয় না দিয়ে, ন্যায় অন্যায় বোধ ও ভালোমন্দ বিবেচনার শিক্ষা ছোট থেকেই শিখাতে হয়। ছোটবেলার ছোট ছোট ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে, সঠিক শাসনে শিশু সুস্থ্যভাবে বেড়ে ওঠে। এমন শাসন থাকলে সুমন রহমানের একমাত্র কন্যা এতটা অমানবিক হত না, বাবা মাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য জ্ঞান করত না।

মেয়েটার বিহেভ এখন আর ফাহমিদার কাছে ভাল ঠেকে না। যখন ছোট ছিল, বাবাকে নানা বিষয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতো, তখন বরং ফাহমিদার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। এতে সে হাতেনাতে রেজাল্টও পেয়েছে। সুমন রহমানের ক্ষেত মেন্টালিটি পাল্টে মোটামুটি জাতে ফিরেছে। কিন্তু এখন তো মেয়ে বড়ো হয়েছে, একইরকম চালাবে কেন? (পৃ. ৭৯)

‘একজন দৈবজ্ঞ ও একটি মৃত্যু’ গল্পটির সরল কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে সমাজসচেতন লেখক যাপিতজীবনে ধর্মান্ধতা কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন।

‘একটি পুকুর মরে যাচ্ছে’ গল্পের নামকরণ শাব্দিক অর্থে পুকুরের আত্মজীবনী বলে মনে হলেও গল্পপাঠে স্পষ্ট হয় যে, এ গল্পে এমন নামকরণ লেখক রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন। বাংলা শব্দের বাগধারা ‘পুকুর চুরি’ শব্দের অর্থ বড় ধরনের চুরি। সাধারণ চোর যে কিনা এই পুকুর চুরিতে অংশ গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখে না। বিজ্ঞ পাঠক তা জানে। বড় ধরনের চুরি যারা করে তারা দেশনেতা, রাজনীতির কর্ণধার । দেশ পরিচালনার কন্ট্রোলবারটি তাদের হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ রাখেন। ‘পুকুর’ শব্দটির ভাবার্থ  তাই অবশ্যই অতি সাধারণ নয়। কথাসাহিত্যিক চন্দন আনোয়ার মুক্তিযুদ্ধে এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রধান দুই দল কর্তৃক দেশশাসন শোষণের বাস্তব চিত্র অতি সুন্দরভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন গল্পটিতে। পাশাপাশি প্রধান দুই দলের শাসন শোষণ ও ক্ষমতার লড়াইয়ে বাংলাদেশের মুমূর্ষু অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন রূপকের অন্তরালে।

গল্পে সত্তদাগর আলি ধ্যানযোগের মাধ্যমে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলতে পারে। পেশায় জ্যোতিষী না হলেও তাঁর ভবিষৎ বাণীর প্রায় সকল কথাতেই দেরিতে হলেও কিছু না কিছু সত্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই নিজের অলৌকিক ক্ষমতা জাহির করার জন্য মাঝে মাঝে দুই চার লাইন বলে। এভাবেই অশিক্ষিত গ্রাম্য সরল বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে সত্তদাগর আলি বিশেষ ব্যক্তি হয়ে ওঠে।  

লেখক মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং রাজাকার কর্তৃক সাধারণ মানুষ হত্যার চিত্র দেখিয়েছেন ছোট বউ জামিলার রাজাকার ভাইয়ের চরিত্রে। জীবন বাঁচানোর শর্তে রাজাকারের বোনকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় সওদাগর আলি। অন্যদিকে প্রথম স্ত্রী রাহেলা মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে। লেখক অত্যন্ত কৌশলে সওদাগর আলির দুই স্ত্রীকে দুই মেরুতে স্থাপন করেছেন। অর্থাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের এবং অন্যজন রাজাকার পরিবারের মেয়ে। এদের পরিচয় একজন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি অন্যজন বিপক্ষ শক্তি। কালক্রমে এই দুই নারীর  পারিবারিক পরিচয় ও তাদের শরীরে বয়ে চলা রক্তের ধর্মানুযায়ী তারা সংসারেও তাদের আচরণ প্রকাশ করেছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশীয় ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নৃসংভাবে হত্যার শিকার হলে প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগসহ বাংলাদেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি আদর্শে অনুপ্রাণিত ওৎপাতা শক্তি ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করে স্বাধীনতা শক্তির বিপরীত ও বিকল্প শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি দীর্ঘদিন মাথা নত করে বিপক্ষ শক্তির কাছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পরে ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে এবং নিজ অধিকার তথা গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্বাভাবিক নিয়মেই সরকারি দল ও বিরোধী দলের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত এই দুই দল কর্তৃক দেশ ও দেশের ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী রাজনীতির সূচনা ঘটে। এ বাস্তবতাকে মূল বিষয় করে রাহেলা জামিলা ও সওদাগর আলি চরিত্রের মধ্য দিয়ে এক সংসারিক জাটিলতার জাল বুনেছেন লেখক। যুদ্ধপরবর্তী এ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারা ও রাজাকার আল বদর আল শামস কর্তৃক আবারও দেশের ক্ষমতা ও রাজনীতিতে ফেরার প্রক্রিয়া দেখিয়েছেন।
সুগঠিত কাহিনির অন্তরালে পাঠককে লেখক নিয়ে গেছেন ইতিহাসের সত্যে। অতি সাধারণ গল্প ভাষায় লেখা গল্প পাঠ করে পাঠক প্রবেশ করে সেই গহিনে যে গহিনে স্বাধীন বাংলার রাজনীতির ইতিহাসের শেকড় রয়েছে। ব্যঞ্জনাধর্মী প্রতিটি লাইন ব্যখ্যায় উঠে আসে বাঙালি জীবনের কালো অধ্যায়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায়। মহৎ হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের রাজাকারদের বিশ্বাস করেছিলেন। মানবতাবাদী নেতা মানবিক দৃষ্টিতেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। স্বার্থপর, সুবিধাবাদী, লোভী, বর্বর, মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ রাজাকারদের রক্তের ধমনীতে মিশে আছে ঐ সকল উপাদান। তাই সাধারণ ক্ষমা তাদের মানবিক করতে পারে নি। দেশ ও জাতির মুুক্তি তাদের হৃদয়ের মুক্তি ঘটায়নি। সর্বদা বঙ্গবন্ধু ও দেশের ক্ষতি করার চেষ্টায় লিপ্ত থেকেছে। এর পরিণাম ১৯৭৫-এর ট্রাজেডি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজাকাররা আবারো শক্তি সঞ্চয় করে সংঘবদ্ধভাবে আবারো স্বরূপে ফিরে আসে এবং দেশে ফিরতে থাকে। ছোট বউয়ের ভাইয়ের উক্তিতে তার প্রমাণ মেলে-

কি দামান! মাথায় ঠাডা পড়লনি? আমি মরি নাকি? বাঁইচা আছি। আমরাই বাঁইচা আছি। খবর জানো, শেখের গনাগুষ্টি সব ছাপ কইর‌্যা ফ্যালাইছে। আমি তো পাকিস্তান থাইকা-ই হেই খবর পাইছি, তুমি পাও নাই? (পৃ. ৬৬)

ছোট বোন জামিলার সাথে দেখা করেই দ্রুত বেরিয়ে যায় তার ভাই। জামিলার রাজাকার ভাই চেষ্টা করে অন্যান্য রাজাকারদের সংঘবদ্ধ করতে। গোড়া ধর্মান্ধ এই চরিত্র পাকিস্তানের পোষা কুকুর। তাই বাংলাদেশ নামেও তার আপত্তি। বাঙালি জাতি নাম স্মরণ করে ঘৃণা বোধ করে। মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র পাকিস্তান তাই অশিক্ষিত বিবেকের আলো বিবর্জিত জামিলার ভাই, বাংলাদেশকে পাকিস্তান নামকরণেই আগ্রহী এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরাধীন হয়ে থাকাকেও সে সম্মানের মনে করে।

‘সাড়ে তিন বছরে দেশের সবকিছু ল-ভ- করে দিয়েছে। কে কোথায় আছে খোঁজখবরের ব্যাপার আছে। দেশটার নাম পাল্টে গেছে। পুরানা বোতলে নতুন মদের কি স্বাদ কমে নাকি? এখন আর বাঁধা নাই। সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। শালার বাঙালি! এই বিধর্মী শব্দটি মুখে উচ্চারিত হওয়া জিহবা ঠোঁটকে ওজু করিয়ে তওবা পড়ে।’ পৃ. ৬৬)

রাজাকার ভাইয়ের শরীরের পাকিস্তানি রক্তের ঝর্ণধারা বইছে জামিলার শরীরে। রাজাকার ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী ও শ্রদ্ধাশীল বোন বাসর রাতেই স্বামীর কাছে বলে।

আমার ভাই ফেরেস্তার মতো মানুষ। দেশের দুশমন খতম করে। আপনে নামাজ পড়েন?
সওদাগর আলির গলায় ছুরির দাগ, মেয়েটির সব কথাতেই বোবার মতো মাথা নাড়ে। (পৃ. ৬৫)

লেখকের অপূর্ব বাণীভঙিমায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠক সম্মুখে। ভিন্ন ধর্মের মানুষ মানেই দুশমন। এমনি সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী মানুষের শরীর নামক কাঠামোর ভেতোরে মনুষত্বের বাস হয় না। সেই কাঠামোর ভেতরে অতি যত্নে লালন করে পশুবৃত্তিকে। জামিলা ও জামিলার রাজাকার ভাই দুইজনেরই আত্মা অন্ধকারে নিমজ্জিত, পশুসদৃশ্য। দীর্ঘদিন ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে জামিলা সতীনের সংসারে ফোঁস করে ওঠেনি। স্বামীসহ সব কিছুর সমান ভাগ মুখবুঁজে মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভাইয়ের আগমনের সাথে সাথে গর্জে উঠেছে জামিলার স্বৈরাচারী অমানবিক মনোভাব। যেন রক্তের স্পর্শে পিশাচিনীর পুনর্জাগরণ ঘটলো।

পাল্লা করে স্বামীর ঘরে যাওয়া, সব কিছু সমান ভাগাভাগি, এসব গণতন্ত্র আর এ সংসারে চলছে না।
এতদিন রাহেলাকে বুবু বলে ডাকলেও এই প্রথম রাহেলাকে নাম ধরে কথা বলল জমিলা, রাহেলা, তুমি নামাজ পইড়ো ছে। বে-নামাজির লগে এক হাঁড়ির ভাত খাইলে দোজখে যাইতে হবো। (পৃ. ৬৭)

স্বামী সওদাগর আলি রাহেলাকে মনে মনে সাপোর্ট করলেও উচ্চবাচ্য করে না। কারণ, যুদ্ধের সময়ের গলার কাটা দাগ শুকিয়ে গেলেও ধারালো ছুরিটা আজো যেন গলার সামনেই ধরা আছে। প্রকৃতপক্ষে জামিলাই সেই ধারালো ছুরি, যে কিনা সওদাগর আলির জীবনসংকটের কারণ। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে বিপক্ষশক্তির নতুন দলের লিডার জামিলার রাজাকার ভাই। জামিলার পূর্বের সকল আচার আচরণ ছিলো লোক দেখানো। মুখোশের আড়ালে ভণ্ডের বাস। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে রাহেলা সতীনকে মেনে নিয়েই সংসারে এসেছে। তার আচরণে কোন মুখোশ নেই। এর অর্থে হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় লাভের পরে এদশের মুক্তিকামী মানুষ দেশ  গড়ার স্বার্থে দেশদ্রোহী রাজাকারদের মেনে নিলেও রাজাকাররা এদেশকে ও স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। মিরজাফরের অনুরূপ বাইরে আনগত্য দেখালেও ভেতরে ভেতরে তারা পাকিস্তানিই রয়ে গিয়েছে।

এমনি প্রক্রিয়ায় শাসন ক্ষমতা চলে যায় রাজাকারদের হাতে। জামিলা তার ভাইয়ের আগমনে, সংসারে গণতন্ত্রের পাঠ ঢুকিয়ে স্বৈরতন্ত্রের চর্চা শুধু করে। সন্তানসহ রাহেলাকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজের সন্তানদের মুখে চকচক শব্দে ভাত তুলে দেয়। এ যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাজাকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সকল সম্পদ ভোগে পরিপুষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করে। এমন পরিস্থিতিতে সওদাগর আলির মনোদ্বন্দ্বে ভোগে, রাহেলা না জামিলা কার উপরে ক্রোধ প্রকাশ করবে। বঞ্চিত রাহেলার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করে। তাকে পুরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। এমন বক্তব্যে মনে হয় যেন সওদাগর আলির মুখ দিয়ে লেখক নিজে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।

নুয়ে পড়া হাত জোর করে উপরে তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচাচ্ছে কিন্তু হাঁসের মতো গক গক শব্দ বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে। ঐ গাই মাগি! র্ত শইল্লে কি শক্তি নাই? তুই কি চুলা ধইরা দুইটা ভাত রাইন্ধ্যা দিতে পারলি না পোলাপাইন দুইডারে? তর বাপ না মুক্তিযোদ্ধা আছিন, তুই কারে ডরাস? (পৃ. ৬৭)

রাহেলার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এই কথাটি রাজাকারের বোন জামিলার বুকে ছুঁড়ির মত বিদ্ধ হয়। বোনের কথায় রাজাকার ভাই বিষবৃক্ষ করবী গাছের চারা উঠানের মাঝ বরাবর রোপন করে। মনে হয় যেন রাজাকার যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে পুনরায় পাকিস্তানি বিষের চাষ করছে। উত্তর ও দক্ষিণ  ভাগে বসতভিটা ও আবাদী জমির সীমানা নির্ধারণ করে। রাহেলাকে দেয় জামির ডান দিকের তথা দক্ষিণ ভাগের মালিকানা। অন্য দিকে জামিলাকে দেয় বাম দিকের অর্থাৎ উত্তরাংশের মালিকানা। বাম হাতের তুলনায় ডান হাত সর্বদা উৎকৃষ্ট বিবেচনায় হয়ত লেখকের এমনতর বিভাজন। বাড়ি ও জমি বণ্টনের পরে অবশিষ্ট থেকে দুই সংসারের কেন্দ্রবিন্দু সওদাগরের আলি নিজে ও উত্তর-দক্ষিণ সীমানা জুড়ে বিস্তৃত তার পুকুর। গল্পকারের রূপকের আশ্রয়ে সৃষ্টি করেছেন এই পুকুর ও তার মালিক সওদাগর আলি চরিত্র। পুকুর দখলের সংঘর্ষে সওদাগর আলীর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া প্রকৃতপক্ষে দেশের ক্ষমতা দখলের সংঘর্ষে এদেশের সুখ, শন্তি, সমৃদ্ধি সহ দেশের সার্বিক উন্নয়ের সম্ভাবনার নিরুদ্দেশ যাত্রাই নির্দেশ করে।

জামিলার রাজাকার ভাইয়ের নির্দেশে ষোল বছর পুকুর তথা দেশটাকে ভোগ করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। ষোল বছর ধরে রাহেলা ও জামিলার সংসার তথা দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের চর্চা। স্বৈরতন্ত্রের জয় জয়কার ধ্বনিত দেশজুড়ে। সওদাগর আলির সংসার জটিলতা বাংলাদেশের বিরজমান ঐ সমসাময়িক রাজনৈতিক জটিলতার সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্য পূর্ণ। করবি গাছের চারা পোতায় সংসারে বিষের প্রাবল্য বাড়লে সওদাগর আলির সংসার জাটিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সওদাগর আলি এহেন নিষ্পৃহতায় মনে হয় লেখক রূপকের আশ্রয়ে একটি স্বাধীন দেশের সুখ সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন কোণটাসা হয়ে পড়ার চিত্র দেখিয়েছেন। ষোল বছর ব্যবধানে রাহেলার মেয়ের বিয়ে হয় এক পুলিশ অফিসারের সাথে। একটু ক্ষমতার জোড়ে এরার নিরীহ রাহেলা গর্জে ওঠে অধিকার আদায়ের দাবীতে। ‘পুকুর ষোল্ল বছর হেই খাইছে, আমি ষোল্ল বছর-ই খাইয়াম, দেহি কেডায় ঠেহা।’ (পৃ. ৭০) রাহেলার এহেন আচরণে সওদাগর আলির মাধ্যমে লেখকের মন্তব্য। ‘প্রত্যেকের জীবনে একবার করে ঘুরে দাঁড়াবার সময় আসে। এখন রাহেলার সময়।’ (পৃ. ৬৯)

মানুষের যাপিত জীবনে জীবনিশক্তি ফুরিয়ে যাবার আগে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো একবার জ্বলে উঠে। একবার সুযোগ সবার জীবনেই আসে। একথা পরিষ্কার গল্পের পুকুরটি প্রতীকার্থে বাংলাদেশ। এর মালিক সওদাগর আলী বাংলাদেশের সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক। রাহেলার ও তার সংসার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি। জমিলা ও তার সংসার বিপক্ষ শক্তি বা রাজাকারদের দৌরাত্ম্যের প্রতীক। এই দুই শক্তির দেশ দখল ও ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সুবিধাভোগী রাজাকার কর্তৃক দেশের সহায় সম্পদ লুণ্ঠনে শোষণে দেশ মৃত প্রায় অবস্থায় পৌঁছেছে। এই শূন্যতা ও ধ্বংসযজ্ঞ অনুন্নত দেশের দায়ভার একে অন্যের উপরে চাপিয়ে দেয়া সমকালীন রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। যা নব্বই-এর দশকে এবং অদ্যাবধি বর্তমান। দুই বছর অন্তর পুকুরের মালিকানা অর্জনের মধ্য দিয়ে অনবদ্যভাবে এই গূঢ় কথাই ফুটিয়ে তুলেছেন চন্দন আনোয়ার।

লেখক যেহেতু সর্বজ্ঞ, তাই লেখক নিজেই কথক ঠাকুরের মতো গল্পে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে পারেন। এই গল্পের শেষে লেখকের সরাসরি উপস্থিতি ঘটে। বিশ বছর পরে সওদাগর আলির খোঁজ কেউ বলতে পারে না। লেখক পুকুর পরিদর্শন করে বেহাল অবস্থায় দেখতে পায়। বড় বউ রাহেলার পুত্রের মুখে শুনতে পায় বিগত দুই বছরে অপর পক্ষ পুকুরের কি হাল করেছে সে বর্ণনা। আবার পরবর্তীতে জামিলার পুত্রের সাথে দেখা হলে সে জানায় তার পুকুর প্রীতির কথা। বলে বিগত ছয়মাসে পুকুরের কী হাল করেছে রাহেলার ছেলে  অপরপক্ষ। এমনিভাবে একে অন্যকে দোষারোপ করে।

আপনি ছ-মাস আগে আসলে দেখতেন, গেছে দুই বছরে মা-ছেলেরা মিলে পুকুরের গাছপালা সব কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। জানেন, পুকুরের পাড় কেটে মাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। গোটা পুকুরটাই বিক্রির ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু পারেনি। আমি পুলিশ এনে ঠেকাই। (পৃ. ৭১)

পাল্টাপাল্টি অভিযোগে লেখকের আফসোস:

কী আর দেখব, পুকুরটা মরে যাচ্ছে দেখলাম! এই পুকুরটা করতে গিয়ে নাকি মাটির চাপে তিনজন শ্রমিক মরে গেছিল। ওদের বংশের কেউ বেঁচে আছে? (পৃ. ৭১)

পুকুর খনন করতে যেয়ে তিনজন শ্রমিক প্রাণ হারায়, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের প্রতীক গল্প প্লটের তিন জন শ্রমিকের প্রাণ। লেখকের দাবি, সওদাগর আলীর দুই বউয়ের দুই ছেলের পুকুর প্রীতির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে পাঠকের কাছে পরিমাণ পরিমাপ করার বাটখারা রয়েছে। যে বাটখাড়ায় পাঠক লেখকের অভিমতকেও প্রমাণ করতে সক্ষম।

রাহেলার ছেলের সম্পর্কে পুকুরের বর্তমান অবস্থার এমন আবেগী বর্ণনায় এবং লেখকের যৌক্তিক মনোবীক্ষণে এমনটিই প্রমাণিত হয় বড় বউ অর্থাৎ রাহেলা ও তার ছেলে পুকুরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। ঢেউ খেলানো নির্মল ঝলমলে পানির প্রবাহ দেখতে চায়। পুকুর জুড়ে মাছেদের অবাধ বিচরণ দেখতে চায়। কিন্তু সম্ভব হয়ে ওঠে না কারণ নির্দিষ্ট সময় পরে, দুই বছর পরেই পুকুরের মালিকানা হাত ছাড়া হয়ে জামিলার দখলে চলে যায়। জামিলার ছেলে দেশের শত্রু রাজাকারদের প্রতীক। রক্তের বিষে সেও পূর্বসূরীদের মতো ভোগ, শোষণ, লুণ্ঠন, অরাজকতা ও নাশকতা চালায়। পরিণামে পুকুরটি মৃতপ্রায় অবস্থার সম্মুখীন হয়। উপযুপরি শোষণ করে সময় শেষ হলে প্রতিপক্ষের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দেয়। লেখকের বর্ণনায় বাস্তব চিত্র:

সেই পুকুরটি এখনও আছে। তবে মুমূর্ষু অবস্থা। সেই ঢেউ খেলানো টলমলে পানি নেই। কালো-পঁচা কিছু পানি তলানিতে মরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চারিদিকে সারিবদ্ধ গাছগাছালি ছিল, এখন দু-একটা এলোমেলো আছে। পাড়গুলো ভেঙে মজে অর্ধেক হয়ে গেছে। (পৃ.৭০)

গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে বর্তমান অবধি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটে পাঁচ বছর পর পর। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জনগনের ভোট আদায়ের লক্ষে একে অপরকে দোষারোপ করে। নিজেকে সাধুপুরুষ প্রমাণ করে। আর ক্ষমতা হাতে পেলে দেশটাকে ক্রমারাত শোষণ ও লুণ্ঠনে নিঃশেষ করে দেয়। মেরুদ- ভেঙে দেয় দেশের স্বাধীনতার। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সমাজবাস্তবতার দালিলিক প্রমাণ।

তৃতীয় লিঙ্গের জীবনবাস্তবতা:
চন্দন আনোয়ারের গল্পের মূল বিষয় সমাজসচেতনতা। সমাজসচেতনতার সাথে গলাগলি ধরে সহেদারের মতো স্বাভাবিক ভাবেই গল্পে ফুটে উঠে সমকালীন রাজনীতির ছবি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। উদার প্রগতিশীল মানসিকতার অধিকারী লেখক তাই গল্প প্লটে নেতা আমলাদের সাথে শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষ, শ্রমিক শ্রেণি, বারবনিতা, এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পর্যন্ত স্থান করে দিয়েছেন। নিম্নশ্রেণির মানুষদের জীবনালেখ্য রচনা করতে গিয়ে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছেন সেই শ্রেণিতে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির আকর মিশিয়ে গল্প রচনা করেছেন। সঙ্গত কারণেই কাহিনি গল্পভাষা ও চরিত্র সৃজনে প্রতিটি গল্পই জীবন্ত ও শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘অন্তর্গত শূন্যতা’ গল্পটিতে তৃতীয় লিঙ্গের জীবনবাস্তবতার চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। রাজশাহী থেকে ইশ্বরদি গামী ট্রেনে পথ ভ্রমণে দেখা মেলে এসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের। যদিও কাহিনির শেষপ্রশ্ন বোধক লাইনটির উত্তর এই যে, সমাজ তাদের মানুষ বলে স্বীকার করে না। দৈহিক আকৃতিতে তারা মানুষ কিন্তু অন্তর্গত শূন্যতা বা গোপনাঙ্গের বিকলাঙ্গতা বিকল করেছে তাদের মানব পরিচয়। সৃষ্টিজগতে তারা নষ্ট হয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশের মতো। তাই তারা পরিবার ও সমাজবহির্ভূত যন্ত্রণাময় এক জীবনের অধিকারী। দশ মাস গর্ভে ধারণ করা মা-ও  সমাজের চাপে শেষ পর্যন্ত তার হিজড়া সন্তানকে অস্বীকার করে। তবে কি তাই সত্যি? যা লেখক অবলীলায় তুলে ধরেছেন। যৌনতার ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে সমাজের স্তম্ভ। যৌনতাই মূখ্য, জীবন গৌন। নিকৃষ্ট হিংস্র প্রাণির যৌনতাকেও স্বীকৃতি দেয় সমাজ। কিন্তু যৌন ক্ষমতায় অক্ষম এই মানুষগুলোর প্রাণের স্বীকৃতি নেই। হয়ত স্রষ্টা সৃষ্টিলীলার খেয়ালে তৈরি করেছেন হিজড়া মানব। এরা জন্মগত শূন্যতার দায় বয়ে বেড়ায় সারা জীবন। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে লেখকের জিজ্ঞাসা যেন পাঠকের মনের জিজ্ঞসা হয়ে ধ্বনিত হয়।

ঠিক বুঝে পাই না, ওদের জন্মাবার কী দরকার ছিল? কী ব্যালেন্স তৈরি করলেন ঈশ্বর? কী করবে ওরা এখানে অর্থাৎ মানুষের চালু সমাজে। যে সমাজ দাঁড়িয়ে আছে জৈবিকতার উপরে, দেহের লেনদেনের উপরে। (পৃ. ৭৩)

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরূপী জীবগুলো নিজেরা সংগঠন তৈরি করে নিজেরা নিজেদের আপন করেছে বাঁচার তাগিদে। একসাথে সংঘবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে নাচগান করে আবার কখনো জোর জবরদস্তি মাধ্যমে টাকা রোজগার করে। নাচগান বলতে যা বোঝায় তা হলো গলা ছেড়ে চিৎকার চেচামেচি। এহেন ক্ষণিক বিনোদন স্বীকৃতিহীন নিঃসঙ্গ জীবনের দুঃখকে ভুলে থাকার উপায়। এ হেন লাজলজ্জাহীন সাজ পোষাক ও আচার আচরণের প্রেক্ষিতে লেখকের মন্তব্য-

‘লাজ-লজ্জা করবে কার জন্যে? কেউ কি স্বীকৃতি দিয়েছে? নাকি দিবে কোনদিন? যাবে টা কোথায়! তাই পুরো সোসাইটিকে কলা দেখিয়ে নিজেদের মতো করেই বাঁচে ওরা।’ (পৃ. ৭৩)

স্বাভাবিক মানুষের বেঁচে থাকাটাই একটা সংগ্রাম, একটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো। এ সম্প্রদায়ের জন্ম ও জীবন কোনটাই স্বাভাবিক তুলাদ-ে বিচার করা হয় না। এ জীবন বিচার করার যোগ্য নয়। অযোগ্য শরীর থাকলেও এ শরীরের পেটের ক্ষুধা আর দশটা মানুষের মতোই। নিরুপায় এ হিজড়া জনগোষ্ঠিকে নির্লজ্জ হয়েই বাঁচতে হয়। গল্পে দুজন হিজড়া এলিট পরিবারের সন্তান। একজনের বাবা সরকারি ডাক্তার, অন্য জনের পিতার শতেক বিঘা জমি আছে। জন্ম পরিচয় ভুলে বেঁচে থাকা কত কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক তা অনুভব করা দুঃসাধ্য। দেশ ও সমাজ যদি পরিবারের হিজড়া সন্তানকে পর করে না দিয়ে সহমর্মিতায় আর একটু আপন করে নিত, তাহলে হয়ত তারাও স্বাভাবিক মানুষের মত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারত। সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে হয়ত পরিবার এ কঠিন সিদ্ধান্ত চাইলেও নিতে পারে না। একথা সত্য সমাজ কোন ঈশ্বর প্রদত্ত ব্যবস্থা নয়, যে তাকে বদলানো যাবে না। সমাজ মানুষের তৈরি, এ সমাজের অমানবিক দিকগুলোকে চিহ্নিত করে মানবিক পথে সমস্যার সমাধানে মঙ্গল বৈ অমঙ্গল নেই। তাই দীর্ঘ প্রচলিত প্রথার পরিবর্তন আবশ্যক।

‘যাও পাখি বলো তারে সে যেনো ভোলে না মোরে/সুখে থাকো ভালো থাকো মনে রেখো এই আমারে’ (পৃ. ৭২) গানটি দিয়ে গল্পের সূচনা। এ শুধু নিছক গান নয়। এ গানের প্রতিটা শব্দে চিৎকার করে বেরিয়ে আসে পরিবার হারা এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কষ্ট ও হাহাকার। হয়ত পাগলের মত চিৎকার চেচামেচি করে তারা মনের কথাই বলে চলে। হয়ত পরিবারের ফেলে আসা সুখস্মৃতি স্মরণ করে। বাবা, মা, ভাই, বোন সকলের উদ্দেশ্যে মাতালের মত একটি গানের এ দুটি লাইনই তারা গেয়ে চলে। সকল কষ্ট ও জন্মত্রুটি মেনে নিয়ে পরিবারের সবার ভালো থাকার প্রত্যাশাই করে। বিনিময়ে শুধু মনে রাখার দাবিটুকু জিইয়ে রাখে। লেখকের কাছে হিজড়াদের এই বেসুরা গলার চিৎকার চেচামেচির গানকে অধুনিক ব্যান্ড গানের সমতুল্য মনে হয়। লেখক সুরের অবেশী ভাব ব্যাতিরেকে ছন্দোকাটা গানের এ পাশ্চাত্য ধারাটিকে ব্যাঙ্গ করেছেন। সম্প্রতি পাশ্চাত্য এ বেসুরো ঢঙয়ের গান বাংলার সুর ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে বসেছে। শেকড়ের টানে, সংস্কৃতির প্রতি মমতায় লেখকের এ হেন ব্যাঙ্গোক্তি, ‘সে কী ভয়ানক গান আর নৃত্য! ব্যান্ডের গানের মতোই সমস্বরে হট্টগোল, তোলপাড় আর সমতালে হাততালি।’ (পৃ. ৭৩)

হিজড়ারা টাকা উপার্জনের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ট্রেনের ভিতরে। এরই মাঝে কোন এক মায়ের সন্তানকে নিয়ে খেলতে থাকলে পুলিশ এসে বাচ্চাকে উদ্ধার করে। বাচ্চাকে উদ্ধার করার গৌরবে পুলিশের বাচ্চার মায়ের সাথে ভাব জমানো কথোপকথোনে স্বাভাবিক মানুষের বিকৃত রুচি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখক এরকম দু’একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে হিজড়াদের অসহায় জীবনের পাশাপাশি সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের বিকৃতি, হীন কার্যকলাপ ও মানসিকতাকে কটাক্ষ করেছেন। তারা এতটাই কদর্য যে হিজড়াদের শরীরও তাদেরকে আকৃষ্ট করে। লেখকের ভাষায়- ‘দু চোখে লোভের চটচটে আঠালো দৃষ্টি ল্যাপটানো ভাষা পড়া খুব সহজ। ভিন্ন প্রজাতির এই প্রাণরি স্বাদ নেবার দিলবাঞ্চা!’ (পৃ. ৭২)

তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলো সহজে মেনে নেয় না এমনতর নির্লজ্জ জীবন। প্রথমাবস্থায় সবাই চেষ্টা করে কর্ম করে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার। কিন্তু তাদের কর্ম দেবে কে? তারা তো ঘৃণ্য! তাই প্রথমাবস্থায় চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে বাধ্য হয় পূর্বসূরীদের পথ অবলম্বনে। পদে পদে বাধার সম্মুখীন হিজড়া পেটের ক্ষুধায় বাধ্য হয়ে নির্লজ্জতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কথকের সাথে ট্রেনে দেখা হওয়া নতুন হিজড়া তার প্রমাণ। চেহারা ও আচরণ বেশ শিক্ষিত মানুষের মতো তার হিজড়া পরিচয় কথকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। লজ্জায় গামছায় মুখ পেঁচিয়ে কথকের লাগেজ বয়ে নিয়ে যায় কুলির মত। পরিশ্রমের মূল্য স্বরূপ একশত টাকা হাতে পাওয়ার কৃতজ্ঞতার  লেখকের পা চেপে ধরে। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে দৌড়ে পালায়। লেখক জানেন সবাই তার মতো উদার মানসিকতার নয়। তাই হিজড়ার পরিশ্রমের মূল্য সবাই দেবেই না, এমন কি পরিশ্রমের করার সুযোগটাও দেবে না। বাধ্য হয়েই তাকে মিশে যেতে হবে অন্যান্য হিজড়াদের সাথে। নিয়তির অমোষ বিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লেখক:

যার ছেলে, বা ভাই, ওরা কেনো এভাবে লাওয়ারিশ করে দিল! কী ক্ষতি হত সংসারে রাখলে? শিয়াল-কুকুরের মতো এখন ফুটপাতে-স্টেশনে থাকবে। নষ্টকাজের সাথে জড়িয়ে শেষে একদিন বেমালুম ভুলে যাবে সংসার। পরিবার। (পৃ. ৭৭)

হিজড়াদের পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্যুত না করে, সহমর্মিতায় কর্মক্ষম করে তোলায় পক্ষপাতী লেখক। সমাজ সচেতন লেখক চন্দন আনোয়ার সমাজের সকল ক্ষত চিহ্নিত করো সারিয়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে কলম ধরেছেন। বুঝিবা সমাজে বিদ্যমানৎ সকল রোগে মালম লাগিয়ে তিনি সুস্থ্য করে তুলবেন এই সমাজ ও জাতিকে।

মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধী বিচার:
পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির হাত থেকে নিজ ভূখণ্ডকে মুক্ত করতে মুক্তিফৌজরা যুদ্ধ করেছিল। মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন মূলত বাঙলি জাতির মুক্তির সনদ অর্জনে। ব্যক্তি স্বার্থ তুচ্ছ করে সকলের কল্যাণ হবে এমন সমষ্টিক উদার চিন্তাই ছিল মূল বিষয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির উত্থান ঘটে। ১৯৭৫ সালের পূর্বে রাজাকাররা আত্মগোপন করে আত্মরক্ষা করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধপরবর্তী দেশে সুস্থ পরিবেশ রক্ষার্থে রাজাকারদের তথা যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই বিশ্বনেতা বিষাক্ত সাপকে পোষ মানানোর বৃথা চেষ্টা করেছিলেন নিজের উদার মানবিকতা ও বিশ্বাস দিয়ে। বিষাক্ত সাপ তুল্য রাজাকারদেরও আপন করে নিয়েছিলেন। এই সরলতার শাস্তি তিনি অতি কঠোরভাবে পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ খ্রি. ১৫ আগস্ট এই বিপক্ষ শক্তির হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিষ্ঠুরভবে হত্যার শিকার হন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে দীর্ঘদিন মুখ লুকিয়ে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। কারণ দেশ পরিচালনার ক্ষমতা চলে যায় পাকিস্তানি ঐতিহ্যের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির হাতে। ধীরে ধীরে এই বিষাক্ত সাপের বিষময় নিশ্বাস বাংলার মুক্ত বায়ুকেও বিষাক্ত করেছে। বুকভরে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। নীরবে নিভৃতে জীবিকা নির্বাহ করলেও হঠাৎই সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করে। হয়তবা লোক দেখানো এই আয়োজন। মাছের মায়ের পুত্র শোকের মত এই সকল ক্ষমতাধারী রাজাকাররা দীর্ঘদিন অবহেলিত, শোষিত, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মুমূর্ষু প্রায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার আয়োজন করে। এরই আলোকে ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পটির কাহিনি নির্মাণ করেন কথাসাহিত্যিক চন্দন আনোয়ার।

গল্পের নামকরণেই মূলভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘বিজয়’ শব্দটিকে নামকরণে ব্যবহার করায় পাঠক কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে। ‘বিজয়’ মনে হয় কোনো  চরিত্রের নাম কিন্তু এই গল্পে ‘বিজয়’ কোনো চরিত্রের নাম নয়। বিজয় এক অনুভূতির নাম। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাস্ত করে বাঙালির যে বিজয় লাভ করেছিল সেই বিজয়কে গ্রাস করে এক ভয়ঙ্কর রাহু। দেশ স্বাধীন হবার পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।

‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পের পটভূমি ঠাঁই পেয়েছে শহরের অদূরে হবিতপুর গ্রাম ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি। যুদ্ধে একটা পা  হায়িয়ে আজ পঙ্গু রহম আলির জীবনবাস্তবতা। অভাব দারিদ্র্য আর পঙ্গু জীবন রহম আলিকে পরিণত করেছে ল্যাংড়া রইম্মায়। তাই রহম আলির ছেলেরা পর্যন্ত মুক্তযোদ্ধা বাবার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর কাছে কিছু চাওয়ার প্রত্যাশায় স্বপ্নের জাল বুনে স্ত্রী জরিনা। জরিনার চাওয়ার পরিধি ও পরিমাণ থেকে অনুমান করা যায় রহম আলির দরিদ্রতার তীব্রতা।

জীর্ণ ছনের ছাউনি। বৃষ্টি ভিতরে ঢুকে। বড় করে শ্বাস টেনে তারপরে বলে-পইল্যা একটা দু-চালা টিনের ঘর চাইবা। কবরে যাওনের আগে আগে কিছুদিন টিনের ঘরে থাকার লাইগ্যা বুকটা আনচান করে। দশ গণ্ডা ক্ষেত। একটা দুধের গরু। নগদ দশ হাজার টেহা। একে একে চাইবা। (পৃ. ৪১)

কাঁচা বাজারে ডিম বিক্রি করা রইম্মা নীরিহ জীবনযাপন করে। জীবনে স্ত্রীর কোন সখই পূরণ করতে পারে নি। ছেলেদুটোকে পড়ালেখা শিখিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে পারে নি। ছেলে দুইটার বড়টা ঢাকা গামের্ন্টসে কাজ করে আর ছোটটা ভ্যান চালায়। রহম আলির চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সুখ সমৃদ্ধি ঝাপসা ছবির মতো। তার কল্পনার সাথে বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটে না। হয়ত যদি দেশের মুক্তিযুদ্ধেনা অংশ নিয়ে পলিয়ে বাঁচত, তাহলে পরিশ্রম করার সহায়ক অঙ্গ পা হারাতে হত না অর্থাৎ সে পঙ্গু হত না।

ক্ষমতার খেলায় রাজাকার ছানা মিয়ারা চতুর সুযোগ সন্ধানী।গিরগিটির মতো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। রাজাকার ছানা মিয়া কালক্রমে দেশ প্রেমিক নেতা সেজেছে। যুদ্ধের সময় লুট করা অর্থে হয়ে উঠেছে বিত্তশালী। তাই নিঃস্ব মুক্তিযোদ্ধা ডিম বিক্রেতা রহম আলিকে দেখলেই ডিম ভর্তি ডালার পাশে পানের পিক ছিটায়। থু থু করে ছিটানো পানের পিকের ছিটে লাগে রহম আলীর চোখে মুখে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে রহম আলির হৃদয়। লাখো শহীদের রক্তের দামে, রহম আলির পায়ের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ভোগদার রাজাকার ছানা মিয়া। রহম আলিরা পালিয়ে বেড়ায় রাজাকারের ক্ষমতার দাপটে।

কোনোদিন যাবার সময় ডিমের ডালার কাছ ঘেঁষে পানের পিক ফেলে যায়। পিকের ছিটেফোঁটা এসে পড়ে রহম আলির চোখে-মুখে। তখন রহম আলির ইচ্ছে হয় থুতু ছিটাতে। সে পারে না। কেননা রাষ্ট্রের ক্ষমতার হিস্যা আছে। (পৃ. ৩৫)

এভাবে কেটে যাওয়া তেত্রিশ বছর কেউ খোঁজ রাখে নি। রহম আলির গুলি খাওয়া পায়ের সুচিকিৎসা হয় নি। নিবৃত হয় না পেটের ক্ষুধা। জোটে না একটা হুইল চেয়ার, একটা পোশাক। জনমজুরি খাটা রহম আলীর ক্ষুধায় পেটের নাড়ি পেটেই শুকায়। স্ত্রী জরিনা হয় আলসারের রোগী। হতবিহবল রহম আলি দুই পুত্রের জিজ্ঞাসার উত্তর দেবার ভাষা খুঁজে পায় না। কেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন? প্রশ্নটি প্রশ্নই থেকে যায়!

তেত্রিশ বছর ধরে পেটে গামছা বেঁধে সপরিবারসহ মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে রহম আলি। মুক্তিযুদ্ধের শেষে স্বাধীন দেশে পেট ভরে খাওয়া আর একটু সম্মান, যা রহম আলির ন্যায্য পাওনা, সেই ন্যায্য পাওনা জুটেনি। অথচ রহম আলিকে সংবর্ধনার আয়োজন করে সরকারি দল এবং মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী শক্তির মন্ত্রী সেই সংবর্ধনার প্রধান অতিথি। গ্রামের লোকেরা একেক জন একেক রকম দাবি নিয়ে পালা করে দেখা করে রহম আলি সাথে। মন্ত্রীকে অনুরোধ করে রাস্তা সংস্কারের গম বরাদ্দের ব্যবস্থা করার জন্য ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পর্যন্ত  রহম আলির কাছে অনুরোধ নিয়ে আসে।

এত বড় সংবর্ধনার মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার যোগ্য পোশাক রহম আলির নাই। তাই থানার ওসি সরকার ও জাতির কলঙ্ক ঢাকতে নিজ উদ্যোগে রহম আলির জন্য বিদেশি পোশাক কিনে পাঠায়। ক্রোধে হুংকার দেয় রহম আলি। হুংকার শুনে কাপড়ের প্যাকেট ফেলে কনস্টেবল ভয়ে পালিয়ে যায়। মনে মনে রহম আলিকে লোভী জ্ঞান করে অনেক কথার জন্ম দেয়। প্রকৃতপক্ষে লেখক চন্দন সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে আরো বেশি পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজনে কনস্টেবলের মনে জন্ম দিয়েছেন নানান কথার। রহম আলিরা নীরবে নিভৃতে অসহায় মানবেতর জীবনযাপন করলেও আত্মমর্যাদা বোধকে কখনো বিসর্জন দেয় না। নিচু মানসিকতার কনস্টেবলের পক্ষে রহম আলির হৃদয়ের বিশালতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এটাই স্বাভাবিক। তাই রিপোর্ট করেছে, প্যাকেট পেয়ে রহম আলী খুশিতে আত্মহারা।

‘এ দেশের গরিব কাঙালদের এই একটা দোষ, কিছু পাওয়ার লোভে মাথা ঠিক থাকে না। একটা খয়রাতের একশো টাকা দামের কাপড়ের জন্য জানখালাস করে ফেলে। আগে দেখ, মন্ত্রী কত দেয়। (পৃ. ৩৭)

রহম আলির চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা তাড়া করে ফেরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধীদের তৎপরতাকে বিষয়বস্তু করে গল্প রচনা লেখকের উদ্দেশ্য। তাই গল্পের প্রেক্ষাপট যুদ্ধপরবর্তী সামাজিক বাস্তবতা হলেও সেখানে রহম আলির স্মৃতিতে স্থান পায় মুক্তিযুদ্ধের খ- বীভৎস ঘটনার। যা মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা ও রাজাকার কর্তৃক ঘটানো নৃশংসতার প্রমাণ। রহম আলির স্মৃতিতে বাঁশের ডগায় বিদ্ধ এক উলঙ্গ যুবতির ছবি আর সহযোদ্ধা রণজিতের শুভ্র সুন্দর মুখ ও তার স্বপ্ন এবং মালতির কাঁপা কাঁপা হাঁতের ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লেখা চিঠি অক্ষয় হয়ে আছে।

এই যুুবতি রহম আলির গুলিবিদ্ধ পায়ে ছেঁক দিয়েছিল রাতভর ভোগে। এ খবর ফাঁস হলে সেখানকার এক রাজাকার যুবতিকে তুলে দিয়েছিলো খান সেনাদের হাতে। ওরা রাতভর ব্যবহার করে যুবতীর নিথর দেহ ফিরিয়ে দেয় ঐ রাজাকারের কাছে। তখনো প্রাণ ছিলো অর্ধমৃত যুবতীর যোনিপথে বাঁশ ঢুকিয়ে রাস্তার তে মাথায় তিনদিন তিনরাত রেখেছিল। রহম আলীর আরো দুই সহযোদ্ধা গিয়ে গভীর রাতে দাফন করেছিলো যুবতীকে। (পৃ. ৩৮)

অন্য দিকে আরেকটি বিভীষিকাময় রাতের স্বাক্ষী রণজিতের স্বপ্ন ও মায়াভরা মুখ।

পাল্টা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছিল ওরা। হঠাৎ রণজিৎ লুটিয়ে পড়ে রহমদা রহমদা বলতে বলতে। রহম আলি অন্ধকারের মধ্যেই কণ্ঠের আওয়াজ ধরে ধরে খুঁজে পেয়ে জড়িয়ে ধরে গুলিবিদ্ধ রণজিৎকে। অস্ফুষ্ট স্বরে বার কয়েক মা, মা এবং দু থেকে তিনবার মালতি মালতি বলে নিশ্চুপ হয়ে যায় রণজিৎ। (পৃ. ৩৯)

প্রচণ্ড অসহায় রহম আলির মনে পড়ে রণজিতের বুক ভরা আশার কথা, স্বপ্নের কথা। দেশ স্বাধীন হলে সে দেশে রাজাকার থাকবে না। সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন আলো বাতাসে কতই না শান্তি। সীমাহীন ক্ষোভে দুঃখে রহম আলির মনে হয় গুলিটা পায়ে না লেগে চোখে লাগলে খুব ভালো হতো। রণজিত মরে বেঁচে গেছে। স্বপ্নভাঙার যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয় না। রহম আলি বেঁচে আছে কিন্তু পঙ্গু না হয়ে যদি অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকত, তাহলে লখো শহিদের রক্তে কেনা বাংলাদেশে ছানা মিয়ার মত রাজাকারদের দৌরাত্ম্য চোখে দেখতে হতো না। আক্রোশে নিজের চোখ উপড়ে ফেলতে চায় রহম আলি। অন্ধ হলে রাজাকারদের আস্ফালন দেখতে হবে না।

মুক্তিযোদ্ধা পালিয়ে বেড়ায় রাজাকারের ক্ষমতার দাপটে। রহম আলির গুলি খাওয়া পায়ের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসে ছানা মিয়া। পানের পিক ছিটায় রহম আলির চোখে মুখে। রহম আলি তাই ছানামিয়াকে দেখলেই পালিয়ে বাঁচে। তেত্রিশ বছর পরে সংবর্ধনার আয়োজন সম্মানের নয়, এ রহম আলির পোড় খাওয়া জীবনের চরমতম অপমান। গভীর রাতে ঘর বাহির করে স্থির সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে সে বিক্রি হতে দেবে না ছানা মিয়াদের কাছে। তাই গ্রাম ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। রাজাকার সরকার মুক্তিযোদ্ধাকে কেনার পাঁয়তারা শুরু করেছে কিন্তু রহম আলিরা বিক্রি হয় না। কারণ কোনো কিছুর লোভে তারা যুদ্ধে যায়নি। নতুন শিশুর স্বাধীন আবাস গড়ে দেওয়া তথা আগামী প্রজন্মকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত আলোয় নিয়ে আসার প্রত্যয় থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিল রহম আলি।

ভয় পাইলি কেরে? তর শরীর কাঁপলো কেরে? আমি অনেক ভাইবা দেখছি, এইডা সংবর্ধনা না রে বউ! হেরা আমারে কিনত চাইতাছে! মুক্তিযোদ্ধা রহমালিরে কিনতে চাইতাছে! ...-কিছু পাওয়ার লোভে যুদ্ধ করি নাই রে বউ। শুধু এক টুকরা স্বপ্ন। পোলাপাইনরা, ওর পোলাপাইনরা, হের পোলাইনরা স্বাধীন দেশে জন্মাবো। মনের মতো কাঁদবো! হাসবো! খেলবো! চলবো! (পৃ. ৪০)

পঞ্চাশোর্ধ জরিনার চোখে নতুন স্বপ্নের হাতছানি। লোভের শিখা আলো ছড়ায় চোখে। একটু ভালো থাকার বাসনায়, সংর্বধনায় অর্থ সাহায্য কামনা করার বিষয়ে রহম আলির আক্রোশ চরমে উঠে। স্ত্রীকে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,

আমারে হাত পেতে ভিক্ষা লইবার কইলি? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? অ্যা! কথা কইস না কেরে? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? তুই না মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির বউ। তুই এতো নীচ! এতো লোভ ভিত্রে তোর! ছি জরিনা! ছি! রহম আলি এলোপাতাড়িভাবে থুথু ছিটাতে লাগল জরিনার স্বপ্নকাতর চোখে-মুখে। (পৃ. ৪১)

স্বামীর প্রচণ্ড ধিক্কারে জরিনা মুখে আঁচল চেপে ঘর থেকে বাহিরে চলে যায়। কিছুক্ষণ কেঁদে মনটা হালকা করে। রহম আলি ভাবে কোথায় পেল এত অহংকার, যে অহংকারে এত কষ্টের মধ্যেও মাথা নোয়াতে তার মন সায় দেয় না। সে মুক্তিযোদ্ধা এই তার অহংকারের কারণ। সমাধান হিসেবে বুক ফেঁড়ে মুক্তিযোদ্ধা এই গৌরবটাকে উপড়ে ফেলতে হবে। তাই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় হাতে দাও নিয়ে বুক চিরতে গেলে বাধা দেয় জরিনা। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে। পরাজিত-অপমানিত রহম আলীর তখন ভয়ানক আর্তনাদ করে ওঠে:

-দাউ দে! বুক ফাঁড়–ম! দাউ দে! আমি মুক্তিযুদ্ধ করছি, এই মিথ্যা অহংকার বুক ফাঁইড়া বাইর করুম। আর কত পালাইয়া বেড়াইয়াম। পঁচাত্তর সালের পরে হেই যে পালাইয়া বেড়াইতাছি, আর কত...। (পৃ. ৪১)

কৃষ্ণাত্রয়োদশীর রাতে স্ত্রী জরিনার হাত ধরে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি। মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির সাথে তেত্রিশ বছর ধরে পালিয়ে বেড়ায় বিজয়ের গৌরব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে বাঙালির বিজয় বিপক্ষ শক্তির দাপটে এভাবেই পালিয়ে বেড়ায়। ছানা মিয়ারা টাকার বিনিময়ে এ গৌরবকে কিনতে চাইলেও পারবে না কোনোদিন। এ বিজয়ের শক্তির মূলে আছে লাখো মালতি ও রণজিতের জীবন ও রক্ত। ছানা মিয়ার মত রাজাকারদের হাতে ফুলের মালা  গলায় পড়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ভাগ কোনোদিন দেবে না রহম আলিরা। সংর্বধানার আগের রাতে রহম আলির নিরুদ্দেশ যাত্রাই তার প্রমাণ।

আমি কি বুঝি নারে জরিনা। তোর ভিতরে অনেক কষ্ট। কি দিছি তোরে! আমি হাত পাইতা যদি একটা টেহাও লই কাল। লাখ লাখ রণজিৎ-রা ক্ষমা করবো না। মালতিরা থুতু ছিটাবো। (পৃ. ৪২)

ক্ষোভে দুঃখে দম বন্ধ করা পরিবেশে রাতের আঁধারে সাদা বিড়ালটাকে চেলা কাঠ দিয়ে থেতলে দেয় রহম আলি। বিড়ালটাকে মেরে কিছুটা হালকা হয়। বুকে চেপে বসায় বিড়ালের এই শাস্তি। ছানা মিয়ার বিড়াল বলেই এই নিষ্ঠুর শাস্তি। প্রকৃতপক্ষে রাজাকার ছানা মিয়াকে এমনি করে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করে মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির। রহম আলির খেদ, যদি বঙ্গবন্ধু মতো কেউ আবার যুদ্ধের ডাক দিত তাহলে  প্রথমেই ছানা মিয়ার মত রাজাকারকে শেষ করত।

ছোটগল্পের নামকরণের মধ্যেও তার প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে থাকে। গল্পের নামকরণ গল্পপাঠের শুরুতেই পাঠককে সচেতন করে এবং ক্রমশ পাঠে গল্পের বিষয়বস্তু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ‘আপাতত এই বিচার’ গল্পের নামকরণেই স্পষ্ট হয়ে উঠে লেখক বিচারকের আসনে বসে অপরাধীর শাস্তি বিধান করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইনব্যবস্থায় এই অপরাধীর শাস্তি হবে কি না? বা হইলেও তা বিলম্বিত প্রক্রিয়া। তাই লেখক এই গল্পে অপরাধীর আপাতত বিচার করে স্বস্তি পেয়েছেন। গল্প প্লটে পাঠকের উপস্থিতি গল্পালোচনায় একান্ত প্রয়োজন। নামকরণের গুঢ়ার্থ অনুধাবনের পরেই পাঠক মন ছুটে চলে সেই প্রশ্নের সমাধানে। এই গল্পে কে শাস্তির বিধানকারী আর কেই বা শাস্তি ভোগকারী?

জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলনের ইতিহাসে ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে শহরময় ইঁদুরের উৎপাত ও  তা নিধনের প্রয়োজনীয়তার ছায়াপাত ঘটেছে ‘আপাতত এই বিচার’ গল্পে। হ্যামিলন শহরের এই ইঁদুরের উৎপাতের ইতিহাসকেন্দ্রিক পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্য রচিত হয়েছে। কালক্রমে সাহিত্যাসরে ইঁদুরের স্বরূপ পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলা ছোটগল্পের প্লট জুড়ে প্রতীকি ভার্সনে জায়গা করে নিয়েছে ছোট্ট ইঁদুর। মার্কসবাদী চেতনাবিশ্বাসী লেখক সোমেন চন্দও ইঁদুরকে (১৯২০-১৯৪২) প্রতীক করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে “ইঁদুর” নামে গল্প রচনা করেছেন। যা মার্কসীর সাহিত্য ধারায় বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর’ গল্পগ্রন্থের প্রথম প্রকাশিত খণ্ডে আলোচ্য গল্পটির নামকরণ ছিল ‘আপাতত এই বিচার’। লেখক পরবর্তী সংস্করণে নামকরণ পরিববর্তন করে রেখেছেন। এছাড়া কলকাতার একুশ শতক থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘নির্বাচিত ৩০’ (২০১৮) সংকলনে ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ নামে গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আব্দুর রহিম বালক বয়সী।  সেই সময়ের বিভীষিকা ছায়ার মতো তার চোখে ভাসে। আব্দুর রহিমের বাবা কাঁচা তরকারি নিয়ে শহরে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। যুবতি মা স্বামীর সন্ধান করতে জমির মৃধার সাথে শহরে গিয়ে আর ফিরে নি। আব্দুর রহিম এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ। বাবাকে কল্পনায় শেয়াল-কুকুরে খাওয়া লাশের আবছা ভয়ঙ্কর ছবি হিসেবে দেখে এবং এতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটে উঠে। মাকে কল্পনায় শুধু জিহ্বা দিয়ে মুখ চাটা এক শিকারী বিড়ালের মত জমির মৃধার মুখ ভেসে ওঠে। মায়ের সম্ভ্রম হানির চিন্তা ঘুরে ফিরে মনে আসে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে আব্দুর রহিম স্থির সীদ্ধান্তে আসতে পারে না।

মায়ের মুখচ্ছবি আবছা আবছা মনে আনতে পারে আব্দুর রহিম। কিন্তু সে মুখে যেন চাঁদের বুড়ির মতো কলঙ্কের দাগ দেখতে পায় সে। কারা যেন  দ্রোপদীর শাড়ির মতো আব্দুর রহিমের মা-র শাড়ি ধরে টানছে আটত্রিশ বছরে। সে প্রায় মায়ের সেই লাল পেড়ে শাড়ির আঁচল দেখতে পায়! মা কে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। (পৃ. ৪৫)

ইঁদুর প্রতীকের অন্তরালে দেশের সুবিধাভোগী যুদ্ধাপরাধী রাজাকার সম্প্রদায়কে বুঝিয়েছেন। যারা সুযোগ পেলেই দেশটাকে দখল ও লুট করতে চায়। আব্দুর রহিম মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি। দেশের কল্যাণে নিয়োজিত। দেশ প্রতীকে আছে আব্দুর রহিমের ঘর ও বসতভিটা। এই ঘর তথা দেশ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে কোদাল দিয়ে কুঁচি কুঁচি করে ইঁদুর নিধন করেছিল আব্দুর রহিম। নিজের দয়াবশত দুই একটা ইঁদুরকে হত্যা না করে ছেড়ে দিয়েছিল। এই মুক্তিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইঁদুরেরা বংশ বিস্তার করে ঐক্যজোট গঠন করে। সম্মিলিত শক্তি নিয়ে তাই দখল করতে চায় আব্দুর রহিমের ঘর। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় রাজাকাররা সাময়িকভাবে বিছিন্ন জীবন কাটানোর ভান করে। প্রকৃতপক্ষে গোপনে নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়। দেশাটাকে পুনরায় তাদের দখলে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। সুযোগ বুঝে আশ্রয় দাতা জীবন দাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে বাংলার মাটিতেই। প্রতীকি ব্যঞ্জনায় রূপকের আশ্রয়ে এ বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন লেখক।

“ইঁদুর নিধন প্রকল্প” গল্পে লেখক শিল্পিত সুষমায় ইঁদুরের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির অবস্থান দেখিয়েছেন। সপক্ষ শক্তির উদারতা ও ভয়ংকর পরিণাম সকলই ব্যাখ্যা করেছেন। কাহিনির গাঁঢ় গাঁথুনি, উপমার ব্যবহার, ভাষার মুন্সিয়ানায় এবং চরিত্র সৃজনের দক্ষতায় গল্পটি সার্থকতা পায়। গল্পে ইঁদুর প্রসঙ্গ নিয়ে এসে গল্পের তাৎপর্যে ভিন্নতা প্রদান করেছেন। বিষয়বস্তু অনুসারে ভাষার তীক্ষ্ণতা পাঠক মনে নবতর ভাবনার জন্ম দেয়।

শুধুমাত্র অনুমানের কাঁধে ভর করে আব্দুর রহিম জমির মৃধাকে আক্রমণ করেনি। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর হিসাব তখনো কিছুটা বাকি। সেই মুহূর্তে তার কন্যা সাবিনা খাতুনের কান্না। চেয়ারম্যান জমির মৃধা তাকে যেতে বলেছে। দাদির মতো সর্বাঙ্গ সুন্দরী সাবিনার বুক শিনার সৌন্দর্য টানে জামির মৃধাকে। লোভাতুর দৃষ্টিতে সাবিনাকে মিলায় দাদির সাথে। এক কথাতেই সমাধান, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায়। কেননা, এতোকাল ধরে রহিমের স্মৃতিতে মায়ের মুখচ্ছবিতে জমির মৃধার ছবি ভেসে ওঠে এবং সে ছবিতে, জমির মৃধা শিকারী বিড়ালের মতো জিভ চাটে।

গল্পের শেষে দেখি, আব্দুর রহিম তার বাবা-মা’র নিরুদ্দেশ হওয়া বা খুন হওয়ার নায়ক জমির মৃধার মুখোমুখি দাঁড়ায় বিচারের দাবি নিয়ে। এতকাল আব্দুর রহিম জমির মৃধার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল, এখন জমির মৃধাই বরং ভয়-ত্রাসে-আতঙ্কে দিক্ভ্রান্ত দিশেহারা। লেখক হত্যার চিত্র সরাসরি উল্লেখ করেননি। বিজ্ঞ পাঠক জানেন আত্রিশ বছরের প্রতিশোধ স্বরূপ শত্রুর ঘরে প্রবেশ করা হত্যা ছাড়া অন্যকিছুর ইঙ্গিত বহন করে না। মায়ের সম্ভ্রম হানি, হত্যা ও কন্যার প্রতি কুদৃষ্টি প্রদানের শাস্তি হিসেবে পাঠক মনে জমির মৃধার হত্যা চিন্তাই আসে। এত বড় প্রমাণের সাপেক্ষে লেখক শাস্তি প্রদান না করলে পাঠক মনে তা তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিত। লেখক কর্তৃক আপাতত এই বিচার প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিকে জোড়ালো করে।

‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে গ্রন্থের নামগল্প ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যু চিহ্নিত কণ্ঠস্বর’-এর বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য রয়েছে। দুটি গল্পেই লেখক যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছেন। লেখকের চন্দন আনোয়ার এর পূর্ববর্তী ‘অসংখ্য চিৎকার’ (২০১২) গল্পগ্রন্থের  ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জোড়ালো দাবি উপস্থাপন করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি অনেকটা দৃঢ়চেতা এবং সাহসী ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছেন। এ গল্পগ্রন্থে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি নয়, তিনি স্বয়ং বিচার কার্য সম্পাদন করেছেন। ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ গল্পের আব্দুর রহিম কর্তৃক যুদ্ধাপরাধী জমির মৃধার শাস্তি বিধানে তাকে আক্রমণ করিয়েছেন। তেমনি পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর গল্পেও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জোড়ালো দাবি উত্থাপন করে বিচার কার্য সম্পাদন করেছেন।

বস্তুতপক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সময়ের দাবি। সে দাবিকে দাবিয়ে রাখা বা কোণঠাসা করে রাখা কখনোই সম্ভব নয়। এই বিচার প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে। এটিকে দ্রুত বিচারের আওতাভুক্ত করা হয়। জুলমত বয়াতির বয়স ছিয়াত্তর বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখের গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছে। বয়সের ভারে গলার সুর বেসুরো হলেও জুলমত বয়াতি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে শেখের গান গায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। শরীরে বহমান রক্তধারার উত্তাপ বয়সের ভারে তাই ন্যুজ্জ্ব হয়ে পড়ে না। বয়াতির রয়েছে বিদ্রোহী সত্তা, সে কাউকে ভয় করে না। রাজাকার সাদুল্যাহ্ মৃধাকে দেখলেই বয়াতির নাকে মড়া মানুষের গন্ধ লাগে। রাজাকাররা যুদ্ধের সময় অকাতরে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে গণ কবর দেয়। পথে প্রান্তরে পড়ে থাকে অসংখ্য পচা গলিত লাশ। দুর্গন্ধ ছড়ায় মুক্ত বাতাসে। সেই পঁচা লাশের গন্ধ আজও রাজাকারের শরীরে। পারফিউমের উৎকণ্ঠ গন্ধও দূর করতে পারে না তাদের শরীরে লেপ্টে থাকা লাশের পচা গন্ধ। বয়াতি নাক চেপে চায়ের স্টলের কোণায় নীরবে বসার চেষ্টা করলেও পারে না। ভিতরে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা বিস্ফোরিত হয়। নিজের মনের আদালতে বিচার করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে জুলমত বয়াতি। প্রতিনিয়ত বিচারের আশায় থাকা ভুক্তভোগী মানুষের মানসপট সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।

নরখাদক! নরপিশাচ! কুত্তার বাচ্চা! বিচার হইবো তোর! আদালত বানাইতাছি আমি! দাঁড়া! আদালত! হেই আদালতে জজ আমি। আমি ইম জুলমত বয়াতি! (পৃ. ৫৪) 

গ্রামে দুজন রাজাকারের উপস্থিতি। একজন সরাসরি রাজাকার, অন্যজন তার সহকারী। তাদের নৃসংশতার বলি নৃপেন বিশ্বাসের পরিবার। হিংস্রতা কত ভয়ানক হতে পারে, কিভাবে একটি পরিবার রাজাকারের অপশক্তির কাছে জিম্মি অবস্থায় বিলীন হয়ে গেছে তার প্রমাণ নৃপেন বিশ্বাসের পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ রকম অসংখ্য নৃপেন বিশ্বাসের অস্তিত্ব সমূলে বিনাশ করেছে রাজাকাররা। জৈনুদ্দিনের প্রশ্নের মাঝে ফুটে উঠে ভয়াবহতার চিত্র:

ও ছেলেরা, বিশ্বাস কি আমার কথা কিছু কইছে না? আমি হের ন্যাংটাকালের বন্ধু। হেইদিন নিশুতি রাইতে কেডা পাক আর্মি নিয়াছিন  হের বাড়ি, এইসব কিছু-ই কইলো না? হের স্কুলে পড়া মাইয়াডারে কেডা তুইল্যা নিল? কলেজ পড়া বড় মাইডারে কেডা ব্যবহার কইরা ফালাইয়া গেছিন? হের আগুনের লাহান বউডার কী অইলো? কেডা ঘরে আগুন দিল! কামের মাইয়া হরিদাসীর যোনিতে কেডায় দাউ ঢুকাইছিন! সেইসব কিচ্ছুই কইলো না? হের ঘর-বাড়ি লুটপাট করলো কেডায়? কিচ্ছুই কইলো না বিশ্বেস! কইলো না! বৃত্তের ভিতরে লাটিমের মতো পাক খেতে খেতে অমানুষিক চিৎকার করতে করতে এইসব প্রশ্ন করে প্রবীণ জৈনুদ্দিন। (পৃ. ৫৬-৫৭) 

যুবকের দল পাঁঠাকাটা বিলের জমির আইল ধরে সারিবদ্ধ ভাবে গ্রামে ঢোকে। সারিবদ্ধ ভাবে গ্রামে ঢোকার দৃশ্যে মনে হয় যেন সত্যি মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে প্রবেশ করছে। মুক্তিফৌজরা এমনই মহড়ায় প্রবেশ করতো। একথা শোনা মাত্র সাদুল্যাহ মৃধা নিরাপদ আশ্রয়ে পালানোর পথ খুঁজে। ছুটে যায় সহযোগী বারেক মুন্সির বাড়ি। ঘুমন্ত বারেক মুিন্সর পায়ের কাটা দাগ ও গভীর ক্ষত চিহ্ন দেখে স্মরণ করে সেই ভয়াবহ রাতের কথা, যে রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নৃপেন বিশ্বাসের স্ত্রী ও মেয়েকে ধর্ষণে উন্মত্ত ছিল এবং সেই ফাঁকে বিশ্বাসের কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করতে গিয়ে দাউয়ের কোপ খেয়েছিল বারেক মুন্সি। নৃপেন বিশ্বাসের বাড়িতে গভীর রাতে দুজনে মিলে যে নাশকতা চালিয়েছিল তার চিত্র জ্যান্ত ছবি হয়ে পাঠকের চোখে ধরা দেয়। পরিষ্কার হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনা।

যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি গণমানুষের দাবি। এই দাবিতে সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। দেশ যখন এই দাবিতে উত্তাল তখন পাগল বয়াতির ‘বয়ান’, ‘আদালত’, ‘বিচার’ সাদুল্যাহ মৃধার এত বিরক্তির কারণ খুঁজে ফিরে বর্তমান প্রজন্ম। গল্পে জৈনুদিন বয়াতি, সাদুল্যাহ মৃধা ও বারেক মুন্সী ও মাতব্বর প্রবীণ চরিত্র। এরাই মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবদর্শী। সাদুল্যাহ মৃধার নষ্ট কর্মের দোসর বারেক মুন্সী। সাদুল্যাহ মৃধা নতুন প্রজন্মের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার পক্ষপাতি।

ছদোরের ছেলে ছামাদ সরকারী কলেজে আনার্স পড়ে। নিজগ্রামে যুদ্ধাপরাধী সনাক্তকরণে ও শাস্তি প্রদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ছামাদ চরিত্রটি প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় নয়, তবে কাহিনি বিশ্লেষণে প্রমাণ হয় এক ঝলক দেখা দিলেও ছামাদই সবচেয়ে সক্রিয় চরিত্র। নীরবতাকে এখানে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ছামাদ। কৌশলে চুপ করে থাকাই কথা বলার সুযোগ তৈরি হয় সাধারণ মানুষের। আলোচনায় আসে যুদ্ধাপরাধীর বিচার।

গ্রামের যুদ্ধাপরাধীর সাদুল্যা মৃধার শাস্তি প্রদানের যে নাটকীয়তা তার অবতারণা করেছে ছামাদ। সহযোগী হিসাবে ডেকে নিয়েছে কতিপয় বন্ধু ও তার কলেজের শিক্ষককে। নৃপেন বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত দৌড়ায় এবং বলে যে, নৃপেন বিশ্বাস ফিরে এসেছে। এরপরে বাকশূন্য হয়ে যাওয়া সবই ছামাদের পূর্ব পরিকল্পিত ঘটনা। গল্পে এ বিষয়টি উল্লেখ নাই। গভীর বিশ্লেষণে সমালোচক মনে স্থান পায় এমনি আরো কিছু সত্য কথন। যা লেখক প্রত্যক্ষভাবে দেখাননি কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে এমনটিই মনে হয়। ছামাদ নতুন প্রজন্মের ছেলে। নৃপেন বিশ্বাসকে সে জীবিত অবস্থায় দেখেনি, তবুও পোড়োবাড়ি থেকে বের হয়ে সে চিৎকার করে বলেছে সে নৃপেন বিশ্বাসকে দেখেছে। এই বক্তব্যকে আরো জোড়ালো করতে সহয়তা করেছে বয়াতি। বয়াতির ভাষ্য মতে সে রোজ রাতে জিনে পরিণত হওয়া নৃপেন বিশ্বাসকে অর্থাৎ নৃপেন বিশ্বাসের আত্মাকে দেখতে পায়। বয়াতির কথায় অলৌকিক ঘটনার আবহ সৃষ্টি হলেও প্রকৃত পক্ষে এ ভৌতিকতা সত্য নয়।

ছামাদের সহযোগী বন্ধু ও তার শিক্ষক গ্রামে এসে উপস্থিত হলে ঘটে আরো জটিল ও রহস্যময় হয়। গভীর রাতে জুলমত বয়াতি শেখ মুজিবের গান ধরে। বৃদ্ধ জৈনুদ্দিন ঘর ছেড়ে বাহিরে আসে। ফাঁস লাগা একটি কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায়। প্রকৃতপক্ষে এই ফাঁস যুদ্ধপরাধীর গলায় লাগানো ফাঁস। যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সে শাস্তির বিধান দেয় বয়াতির আদালত। এরপরেই নাটকীয় ভঙ্গিতে গ্রামের সকল মানুষকে শেখ মুজিবুর রহমান এর গান শোনার ডাক দিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পশ্চিম, পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণ দিক হতে অসংখ্য মানুষের হাঁক একে একে সংগঠিত হয়। এক সময় সকল হাঁক একটি হাঁকে পরিণত হয়। নারী পুরুষ সকলের অভিন্ন কণ্ঠ আওয়াজ তোলে। সকলের দাবি এক দাবিতে পরিণত হয়। এমনই পরিবেশে পোড়ো বাড়ি থেকে পরপর দুই বার মৃত্যু চিহ্নিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। প্রকৃতপক্ষে বয়াতি কর্তৃক ফাঁসির আদেশ প্রদান, মুহূর্তে ফাঁসির আসামির বাঁচার আকৃতি। সংঘবদ্ধভাবে গণমানুষের ঢল এবং পরিশেষে মৃত্যু চিহ্নিত দুটি কণ্ঠস্বর দুই রাজাকারের মৃত্যদণ্ড কার্যকর করার প্রমাণ। পোড়োবাড়ি থেকে শোনা যায় চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর এক মরণ চিৎকার।

লেখক এই গল্পে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত করেছেন এবং সে ফাঁসিকে কার্যকর করেছেন। গল্পে এহেন প্রস্তাবনার মাধ্যমে জনমত গঠন, প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধপরাধীর বিচারের দাবীকে জোরদার করে।

বাস্তববাদী কথাকার চন্দন আনোয়ারের প্রতিটি গল্প যেন তিনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে রচনা করেছেন। অবশ্য উদ্দেশ্যহীন পথচলা লেখকের কাজ নয়। কথার পিঠে কথা, গল্পের প্রয়োজনে গল্প এমন অশিক্ষিত গ্রাম্য প্রবাদকে প্রশ্রয় না দিয়ে সমকালীন বাস্তবতাকে শতভাগ মূল্যায়ন করে কলম ধরেছেন এ কথার যাদুকর। সঙ্গতকারণেই গল্পগুলো হয়েছে প্রাণবন্ত ও শিল্পোতীর্ণ। বাস্তবের বাস্তবতা এতে এমনভাবে প্রকটিত হয়েছে যে, পাঠক গল্পপাঠ করতে যেয়ে গল্পকাহিনীর নাটকীয়তার মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। সকল বিষয় আত্মিকভাবে পর্যবেক্ষণের দিকে টেনে নিয়ে যায় পাঠককে। কাহিনির গতিশীলতা, চরিত্র ও পরিবেশ অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার গল্পগ্রন্থটির অন্তর্গত গল্পগুলোকে শ্লীল-অশ্লীল বোধ ও তৎসম্পর্কিত প্রশ্নের উর্ধ্বে স্থান দেয়। চরিত্র সৃজনের মুন্সয়ানা,বহুমুখী ঘাত-প্রতিঘাতে মনোবৈচিত্র সৃষ্টিতে প্রতিটি গল্পই শিল্পসার্থক ছোট গল্পের পর্যায়ে উন্নীত। গল্পগুলোতে উঠে আসা সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা পাঠক সত্তায় মিশে যেন অস্তিত্বের অংশ হয়ে ধরা দেয়।

Side banner