kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা দিয়ে লিখি ভাষা নিয়ে লিখি


কালচিত্র | শ্যামল কান্তি দত্ত প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২১, ০৮:২৬ পিএম ভাষা দিয়ে লিখি ভাষা নিয়ে লিখি

শ্যামল কান্তি দত্ত
 

ভাষা দিয়ে লিখি ভাষা নিয়ে লিখি

স্কুল শিক্ষক বাবার সাথে স্কুলে গেলেও পড়তে শিখেছি মায়ের কাছে। পানের বরজ-আখের ক্ষেত আর রান্নবান্না-ঘরকান্না সামলানোর ফাঁকে মা আমার পড়া শুনতেন। তারপর বই বন্ধ করে মাকে বলতে হতো। কী পড়েছি? কী বুঝেছি? বলতে না পারলে, অথবা মায়ের মতের সাথে না মিললে, আবার পড়ে শোনাতে হতো। এভাবে মায়ের কাছেই নিজের ভাষায় কিছু বলার দক্ষতা অল্প আয়াসে আয়ত্তে আসে। প্রাথমিকে পড়ার সময়েই পূজন মামার কাছে চিঠি লিখতাম। মামার (নিখিল রায় পূজন) পকেটে চিঠি নিয়ে ভরদুপুরে আমগাছের তলায় বসে বার বার পড়তাম, আর ভাবতাম কীভাবে চিঠির জবাব লিখে মামাকে চমকে দেওয়া যায়। এভাবে গদ্যভাষাটা আমার অজান্তেই আয়ত্তে আসে। নয়াবাজার কৃষ্ণচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। সেদিন সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আতাউর রহমান স্যারের প্রশংসা আমায় প্রাণিত করেছিল নিঃসন্দেহে। স্কুল লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা মি. ফণীন্দ্র কিশোর নাগ স্যার ধর্মশিক্ষা ও বাংলা এ দুটো বিষয় চমৎকারভাবে পড়াতেন। ছুটির পর চুপি চুপি যেতে হত স্যারের কাছে লাইব্রেরির বই ধার নেওয়ার জন্য, প্রথম দিকে স্যার বই বাছাই করে দিতেন। তবে রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার পর স্যারের ¯েœহ বেশ বেড়ে গেলো; ইচ্ছামত বই নিতে দিতেন। ‘সঞ্চয়িতা’, ‘সঞ্চিতা’ পড়ার সুযোগ পাই তখনই। তখন থেকেই কখন যে মনে ও মননে সাহিত্যের সুধা সঞ্চিত হয়েছিল বলতে পারিনে। 


স্কুলজীবনে দেয়াল পত্রিকা তৈরি করলেও ছড়া-কবিতা কতোটা নিজেদের লেখা ছিল তা আজ আর মনে নেই, সংগ্রহেও নেই। সম্ভবত এসএসি পরীক্ষার পর কেনো এক পল্লী বালিকাকে উদ্দেশ্য করে ‘অনন্যা’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখে গোপন খামে পুরে পাঠিয়ে ছিলাম। সে চিঠির খামে পাঠানো কবিতা অনন্যার মনজয় করলেও কবিতাটি ছিল রবীন্দ্রনাথের মানসী কাব্যের অনুকরণে লেখা। ওই আমার প্রথম কবিতা। কবিতায় অনন্যার চোখের ভাষা অনুমান করতে পারার অহংকার ব্যক্ত হয়েছিল। তবে গোপন খামে পাঠনো কবিতার কোনো কপি রাখা হয়নি। অনন্যার সাথেও দু’যুগ ধরে দেখা নেই। সিলেট মুরারিচাঁদ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে আমি প্রথম প্রত্যন্ত গ্রাম ছেড়ে শহুরে হই। ভজন মামার (অজিত রায় ভজন) আগ্রহে অনুপ্রেরণায় চাঁদের হাট ও ছড়া পরিষদ-এর সক্রিয় সদস্য হই। এসব সংগঠনের সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে প্রথম রোমাঞ্চিত হই। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক সিলেটবাণী পত্রিকায় আমার প্রথম ছড়া প্রকাশিত হয়। ‘বৃষ্টি’ নামের সে-ছড়ায় বৃষ্টির ভাষা বুঝতে না পারার ব্যাকুলতার কথা ছিল।


এইচএসসি পরীক্ষার পর (১৯৮৮) আবার গ্রামে ফিরে আবদুর রহিম ও আলতাফ হোসেনকে নিয়ে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করি। প্রথমে ‘অনুরাগ’ এবং পরে ‘সাথী’ নামে পত্রিকায় কবিতা লেখার পাশাপাশি সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় সম্পাদকীয় লিখে এলাবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম। তবে মামা ডা. বিনয় মোহন দে এসব কর্মকা-ে ভাগ্নের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। কেননা পত্রিকা প্রকাশের জন্যে শ্রীমঙ্গল প্রেসে রাত যাপন করতে হতো। মেটাল ব্লক দিয়ে ছাপা-প্রুফরিডিং ইত্যাদি কাজে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। মনে পড়ে একদিন মামা বললেন, ভাগ্নে আমার পড়াশোনা ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ হবে। আমি বলেছিলাম আমি শ্যামলকান্তি হব মামা; বলেই মামার ভয়েÑদে দৌড়। বোর্ড বৃত্তিসহ উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে ঐ বিনয়মামাই বাবা-মাকে বুঝিয়ে ওতোদূরে আমায় পাঠাতে রাজি করান। বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে দেখলাম অনেকেই সাহিত্য ভালোবাসে না। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ পেয়ে বাংলা পড়ছে। ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। ব্যতিক্রমী কজন মিলে কলা অনুষদের জারুলতলায় কাব্য-আড্ডায় অনেক দুপুর বিকেল হয়েছে। সহপাঠী সিরাজুল হক সিরাজকে নিয়ে যৌথভাবে সম্পাদনা করি ‘ছন্দসুর’ (১৯৯০) কবিতাপত্র। দু’সংখ্যা বেরুনোর পর প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের হুমকির মুখে সম্পাদনার স্বপ্ন বাদদিতে হয়। ভীষণভাবে ভেঙে পড়ছিলাম, এমন সময় চাকসু বার্ষিকীতে (১৯৯১) ‘কল্পনার কবুতর’ নামে আমার কবিতা প্রকাশিত হলে ক্যাম্পাসে কবি খ্যাতি পাই। এই কবিতায়ও আমাদের কল্পনাকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করবার ব্যর্থতাজনিত হাহাকার ব্যক্ত করে লিখেছিলাম:


আসে না আর ঘনকৃষ্ণ পল্লবের ভেতর
পাতার আড়ালে শাপলা দিঘির পাড়ে
বসে না এখন ঝাউ গাছটার ঘাড়ে 
আমাদের কল্পনার সে নোটন কবুতর।


বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের কোর্স সেশনজটে আট বছর চলে যায়। অনার্সে ভাষাতত্ত্বে এক নম্বর কম পাওয়াতে এমএ শ্রেণিতে গবেষণার সুযোগ বঞ্চিত হই। তবু ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান স্যারের ¯েœহ বঞ্চিত হইনি বলে মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া সহপাঠীদের ঈর্ষার পাত্র ছিলাম। নববর্ষের খেতাব দিতে গিয়ে বন্ধুরা আমায় প-িত মশাই নাম দিয়ে তাদের ঝাল ঝেড়েছিল।

এমএ পরীক্ষার পর অলকা-জাফর-রাজীব সাহিত্যিক বন্ধুরা বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্পে আবেদন করে ঢাকায় যায়। আর আমি গবেষণা করবো, না বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবÑএই দ্বিধায় দোলে গ্রামে ছোটে যাই শিক্ষকতা করতে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর, ভালো একটা চাকুরির প্রস্তুতি, সাংসারিক দায়িত্ব ইত্যাদির কারণে কবিতাকে ছুটি দিতে হয় কয়েক বছর। এক যুগ পর মনে হয় সরকারি চাকুরি, সংসার ও টিউশনি এই শুধু নয় জীবন। জীবনে জন্মভূমি-মাতৃভাষার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ড. আবুল কাসেম স্যারের তত্ত্বাবধানে ‘সিলেটের উপভাষা’ নিয়ে গবেষণায় নিযুক্ত হই একুশ শতকের শুরুতেই। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি পনেরো বছর একনাগড়ে ভাষা-গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রী পাই। ভাষা নিয়ে গবেষণায় নেমে ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদের বই পড়ে পড়ে ভাষাগবেষণার প্রেরণা প্রভূত পরিমাণে বেড়ে যায়। স্বপ্ন দেখি হুমায়ুন আজাদের মতো আগামী প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশের। পা-ুলিপি জমা দিই ড. মাহবুবুল হক স্যারের মাধ্যমে। ভূমিকা লিখে দেন ড. মনিরুজ্জামান। এবার আগামী প্রকাশনী আগ্রহ দেখায় সিলেটের উপভাষার ব্যাকরণের সাথে সিলেটি ভাষার অভিধানটাও একত্রে প্রকাশের। প্রকাশনীর প্রেরণায় দুই বছরের নিরলশ চেষ্টায় অভিধান সংকলন করে দিলে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গ্রন্থ; ‘সিলেটের উপভাষা: ব্যাকরণ ও অভিধান’ (২০১৮)।


গবেষক মাসুম খানের সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে জার্নালভিত্তিক গবেষণার আগ্রহ জাগে। অবশ্য আগে থেকেই জাতীয় দৈনিকে ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ চলছিল। ইতিহাস একাডেমি, ঢাকা-এর একটি সেমিনার হয় এশিয়াটিক সোসাইটিতে। সেমিনারের সভাপতিত্ব করছিলেন ড. তপন বাগচী। আমার পঠিত ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা’ প্রবন্ধের তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে তিনি আবার ফোন করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ও রচনাসমগ্রের ভাষাশৈলী বিশ্লেষণ করে গ্রন্থ প্রণয়নের পরামর্শ দেন। অগ্রজপ্রতীম ড. তপন বাগচীর পরামর্শে ও নির্দেশনায় পাঁচ মাসের একাগ্র আরাধনায় লেখা হয় ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষাশৈলী’ নামে দেড়শতাধিক পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ। রাষ্ট্রীয় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বইটি প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। করোনাকালে শ্রেণিপাঠ কার্যক্রম বন্ধ। অনলাইনে সপ্তাহে দুতিনটি ক্লাস করে অগাধ অবসর। এই অবসরে পুরোনো কবিতার পা-ুলিপি আবার পড়ি, ঘষামাজা করি। ড. মহীবুল আজিজ স্যার ভূমিকা লিখে দিলেন, কবি মনিরুল মনির সম্মত হলেন প্রকাশ করতে। প্রকাশিত হলো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ: ‘চেতনা-চড়–ই’ (২০২০)। একুশ সালে একুশের বইমেলাতে এসে বাংলা একাডেমি ‘গ্রন্থমেলা’ ‘বইমেলা’ নাম নিল। কবি রাহেল রাজিব স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে কবিমানস থেকে কবিতার বই প্রকাশের আগ্রহ দেখালে, কবি মাসুম খান ও অধ্যাপক হোসনে আরা কামালী বাছাই করে দিলেন আরও কিছু কবিতা। এই নিয়ে প্রকাশিত হলো আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রণয় প্লাবন’ (২০২১)। ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন দৈনিকে, সাময়িকীতে ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে দু’ডজন খানিক প্রবন্ধ। কয়েকজন কবির কাব্যভাষা নিয়ে শৈলীবিজ্ঞানসম্মত আলোচনাও চলছে। 

কবিতায় লিখছি আমাদের অন্তরের অব্যক্ত ভাবনা, কল্পনাকে ভাষায় প্রকাশের প্রয়াস চালাচ্ছি। আর প্রবন্ধে-গবেষণায় আমার আগ্রহ ভাষাকে নিয়ে। মাতৃভাষার সৌন্দর্য অনুসন্ধানে আমি ভাষার ব্যাকরণসূত্র আবিষ্কারে আনন্দ পাই প্রতিনিয়ত। পাণিনি-শিষ্য পতঞ্জলি যেমন বলেছিলেন, ভাষা তাঁর গোপন সৌন্দর্য মেলে ধরে বৈয়াকরণের সম্মুখে, পতিব্রতা রমণী যেমন তার পতিরে দেখায়। আমি তাই ভাষা দিয়ে লিখি, ভাষা নিয়ে লিখি। প্রতিদিন দেখি কতো কিছু জানিনে; তাই ভাষাবিজ্ঞান শিখি। সাথে স্বপ্ন দেখি বাঙালি একদিন সত্যি উপলব্ধি করবে ভাষা নিয়ে দেশ, ভাষা নিয়ে জাতি। সেদিন বাংলা ভাষা গৌরবের আসন পাবে তার বাঙালি সন্তানের অন্তরে। 


লেখক: ভাষাবিজ্ঞানী
 

Side banner