kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের আলোকে বাংলার বাউল দর্শন


কালচিত্র | ড. মো: আবদুল করিম মিঞা প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২২, ০১:৩৪ পিএম ইতিহাসের আলোকে বাংলার বাউল দর্শন

ড. মো: আবদুল করিম মিঞা

ইতিহাসের আলোকে বাংলার বাউল দর্শন

 

প্রাচীন ভারতের নানা ধর্ম বিশ্বাস রীতিনীতির প্রকাশ ঘটেছে বাংলার বাউল দর্শনে। ইতিহাসের পরিক্রমায় বাউল একটি স্বতন্ত্র দর্শনের সৃষ্টি করেছে। আর সে ধারা বাঙালির নিজম্ব। এই ধারায় বিভিন্ন ধর্মমতের সমন্বয় ঘটেছে। সমন্বয়বাদীতা বাংলার নিজস্ব গুণ। যার ফলে বাংলায় যে সকল ধর্ম প্রবেশ করেছে সেগুলো তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে নি।

বাউল দর্শন বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের কাছে অনেকখানি ঋণি। বৌদ্ধ দর্শনের জন্মান্তরবাদ বাউল গ্রহন করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের কর্মবাদ অনুসারে, মানুষ কর্মের দায় শোধ করার জন্য বার বার জন্ম-মৃত্যুর অধীনে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত পাপ ক্ষয় না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে চুরাশি লক্ষ যোনি পরিভ্রমন করতে হয়। চুরাশি লক্ষ যোনি পরিভ্রমনের পর সে পায় মানব জন্ম। এই মানব জীবনে মানুষ ক্রমাগত ভাল কাজ করলে সে ‘উর্ধ্বগমন’ এর মধ্য দিয়ে ‘নির্বাণ’ এর পথে এগিয়ে যায়। বাউল দর্শন মতে, মানুষ জন্মের পূর্বের জন্ম ধেনু জন্ম। বৌদ্ধ ধর্ম মতে, প্রত্যেক প্রাণী কীট পতঙ্গ জীবজন্তু রূপে জন্ম গ্রহন করে পূর্বজন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। কাজেই কোন জীবকে হত্যা করা বৌদ্ধ ধর্মে অবিধেয়। বৌদ্ধ ধর্মে জীব হত্যা মহাপাপ। বাউলও এমত মানে। এজন্য বাউল প্রাণী হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করে না। সকল জীবের প্রতি বাউলের রয়েছে সহমর্মিতা।

আমাদের সমাজ জীবন নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত। এগুলো সবই মানুষের সৃষ্টি। বাউল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত করে মানুষকে দেখে না, বাউল মানুষকে সে দেখে  মানুষ হিসাবে।

ভারতবর্ষে সামাজিক ভাবে উচু-নিচু ভেদ প্রথা প্রথম পাওয়া যায় আর্যদের আগমনের পর। আর্যরা এদেশে আদিম অধিবাসী অনার্যদের অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। আর নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণি ভেবেছে। এভাবেই হিন্দুধর্মে জাত প্রথার গোড়া পত্তন ঘটে। পরবর্তী কালে কিছু ধর্মে জাত বর্ণ প্রথা আরও ঝেঁকে বসে। নানা বর্ণ ও উপবর্ণে হিন্দু সমাজ বিভক্ত হয়ে পরে।

গৌতম বুদ্ধের জীবীত কালে বৌদ্ধ সমাজে কোন শ্রেণিভেদ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ২০০ বৎসরের মধ্যে ‘নির্বাণ’ এর পদ্ধতি নিয়ে মত ভেদের সৃষ্টি হয়। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ‘মহাযান’ ও ‘হীনযান’ এই দুই শাখায় প্রথমে বিভক্ত হয়ে পরে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম আরও দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়। এগুলো হলো ‘সহজযান’ ও ‘কালচক্রযান’।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর ভারতে মুসলমান রাজত্বের সূচনা হয়। মুসলমানেরা ইসলামের সাম্যবাদ নিয়ে শ্রেণিবিভক্ত ভারতে প্রবেশ করে। তাঁদের সাম্যের আদর্শে এদেশের নিপিড়িত মানুষ মানুষের মর্যাদা পাওয়ার আশায় স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু মুসলমান সমাজে শেখ সৈয়দদের মতো মর্যাদা পায় না। তখন তাদের মধ্যে চাপা ক্ষেভের সৃষ্টি হয়। আবারও তারা বর্ণ বৈষম্যের শিকার হলো। তখন ক্ষুব্ধ বাউল মানুষের জাত সম্পর্কে সমাজের কাছে জাতের স্বরূপ সম্পর্কে বলছে-

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে

লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।

মানুষের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতির ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। মহাভারতের যুগেও আজকের মতো বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। উদ্ধালক মুনির পুত্র শে^তকেতুই বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন করে। মহাভারতের সময় স্বাধীনভাবে পতি নির্বাচনেরও অধিকার ছিলো। কালক্রমে সভ্যতা এগিয়ে গেলে মানুষের পতি-পতিœ নির্বাচনের স্বাধীনতা খর্ব হতে থাকে। শাস্ত্রের বাঁধনে বাঁধা পড়ে স্বাধীনতা। মন্ত্র পড়ে স্বামী-স্ত্রী হওয়ার অধিকার পায়। দুরে যায় ভালবাসা। বাউল এখনো পুরানো বিবাহ পদ্ধতি ধরে রেখেছে।  বাউল শাস্ত্রের মন্ত্র পড়ে বিবাহ করে না, সে কন্ঠি বদলের মাধ্যমে স্ত্রী গ্রহন করে। বাউলের স্ত্রী বা সেবাদাসী ভাল লাগলে সারা জীবন কাছে থাকে। আর ভাল না লাগলে চলে যায়। এটা উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে সত্য। এতে শাস্ত্রের কোন নিয়ম তাকে মানতে হয় না। ভাল লাগাটাই মূখ্য। অর্থাৎ প্রেমের মাধ্যমেই বাউল সবকিছু পেতে চায়।

বাউলের পাপ-পূণ্য সম্পর্কে ধারনা আমাদের সব ধর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। শাস্ত্রীয় সমাজের কাছে বাউল প্রশ্ন করেছে-

পাপ পূণ্যের কথা আমি কাহারে বা শুধাই

একদেশে পূণ্য যা অন্য দেশে পাপ তাই।

শুকর গরু দুটি পশু খেতে বলেছেন যিশু

তাই দেখে হিন্দু মুসলমান পিছুতে হটায়।।

গরুর মাংস মুসলমানে খেলে পূণ্য হয়, আর হিন্দু খেলে পাপ হয়। আবার শুকরের মাংস মুসলমানে খেলে পাপ হয়, আর হিন্দু খেলে পাপ হয় না। কিন্তু খ্রিস্টানেরা শুকর ও গরুর মাংস দুটোই খায়। তাদের পাপ হয়? না পূণ্য হয়? বাউলের দৃষ্টিতে এসব বস্তুর মধ্যে পাপ-পূণ্য নেই। আসল পাপ হলো মানুষের অকল্যাণ করা। আর আসল পূণ্য হলো মানুষের কল্যাণ করা। পাপ-পূণ্য সম্পর্কে এটাই বাউলের ধারণা।

জগতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে। একেক ধর্মের অনুসারীদের একেক নামে ডাকা হয়। গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের বলা হয় বৌদ্ধ, যিশু খ্রিস্টের অনুসারীদের বলা হয় খ্রিস্টান, হযরত মুহাম্মদ (স:) এর অনুসারীদের বলা হয় মুসলমান। আবার ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব বিষয়কে কেন্দ্র করে একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে নানা বর্ণ ও উপবর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। যা মূল ধর্ম দর্শনে নেই। বাউল বলতে চায়, আমাদের সমাজ জীবনে যে ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র দেখি সেগুলো মানুষের সৃষ্টি। মানুষই সমাজ জীবনের নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র সৃষ্টি করে রেখেছে। বাউল এই বিভক্ত সমাজে বিশ্বাস করে না। সে বিশ্বাস করে অখন্ড মানব সমাজে। যে সমাজ গোত্র বর্ণহীন। এইজন্য বাউল সমাজ বিভক্তকারীদের নিকট প্রশ্ন রেখে বলছে-

জাত গেল জাত গেল বলে

একি আজব কারখানা

সত্য পথে কেউ নয় রাজি

সবই দেখি তা না না না।।

যখন তুমি ভবে এলে

তখন তুমি কি জাত হলে

কি জাত হবে যাবার কালে

ভেবে তাই বলনা।

অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ একই ভাবে জন্ম গ্রহন ও মৃত্যুবরণ করে। শুধু মাঝখানের জীবনটা বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত হয়। যা বাউল দর্শন অস্বীকার করেছে। বাউল বিশ্বাস করে সমাজ জীবনে কোন ভেদ রেখা থাকবে না। আল্লাহ মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে সৃষ্টি করেছেন। আর তা হলো নারী আর পুরুষ। বাউল ও এই ভেদ রেখায় বিশ্বাস করে।

বাউলের গুরুবাদ প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতে বহিরাগত ধর্মও এর প্রভাব অস্বীকার করতে পারে নি। ইসলামে মারেফাত সাধনায় পিরাবাদের যে আধিক্য দেখা যায় তা পারস্য প্রভাবজাত। আরবের ইসলাম যখন পারস্যে যায় তখন সে পিরবাদের সাথে একত্রিত হয়। পারস্যের প্রাচীন ধর্মও পিরবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। পারস্যের পিরবাদ প্রভাবিত ইসলাম সুফিদের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করে। ইসলাম ভারতে প্রবেশ করার আগেই ভারত ছিলো হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত গুরুবাদী দেশ।

গুরুবাদ ও পিরবাদের দর্শন ভূমি একই। কাজেই ভারতীয়দের কাছে পিরবাদ তেমন বিদেশী মনে হলো না। তাই ভারতীয়দের কাছে পিরবাদ ও গুরুবাদ একাকার হয়ে গেল। ইসলামের সাম্যবাদে আকৃষ্ট হয়ে এদেশের নি¤œ বর্ণের বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজের লোকজন পির ফকিরদের কাছে ইসলাম গ্রহন করে। তারা গুরুবাদী ধ্যান ধারনা নিয়ে ইসলামে প্রবেশ করে। ফলে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে গুরুবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এভাবে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে গুরু বা পির কেন্দ্রীক সাধন ভজনের প্রচলন শুরু হয়। গুরু হন সাধনার নিয়ামক। লালন ফকির গুরুর মহাত্ম্যজ্ঞাপন করে বললেন-

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার

অথবা

আর কোন ধন চাইনা গুরু

চরণ দিও তুমি

আমি গুরুতে যেন গোবিন্দরূপ

দেখে মরি।।

এখানে বাউল বলতে চেয়েছে, গুরু কেন্দ্রীক সাধনা করলে মানুষ সাধনায় সফলতা লাভ করে। ভক্ত চায় মানুষ গুরুর মধ্যে ‘পরম গুরু’র রূপ দেখে যেন এই জীবনের অন্ত হয়। তবেই সে জন্মচক্রের হাত হতে রেহাই পাবে। এভাবেই আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনে গুরু প্রভাব বিস্তার করে আছে। বাউল এখনো প্রাচীন ভারতের জীবন ব্যবস্থার অনেক রীতি নীতি পালন করে। ইতিহাসের  এই দীর্ঘ পথেও সে তা বিস্মৃত হয় নি।

 

ড. মো: আবদুল করিম মিঞা

অধ্যাপক (বাংলা), আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ।

Side banner