_একজন রমা চৌধুরীর কাছে আমাদের ঋণ_
ড. মীজানুর রহমান মিজু
কতো মুক্তিকামী জনতার সীমাহীন আত্মত্যাগ, কতো জননীর শুষ্ক-তপ্ত-শূন্য হৃদয়ের দীর্ঘ হাহাকার, কতো তরুণ-যুবা-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার হৃদয়নিঃসৃত দীর্ঘশ্বাস আর বুকের তাজা রক্ত, কতো বীরাঙ্গনার ইজ্জত-আব্রু বিসর্জনের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা! তাই এই স্বাধীনতার মূল্য অনেক, গুরুত্ব অপরিসীম। বড় দাম দিয়ে কেনা আমাদের এই স্বাধীনতা। যাঁরা দাম দিয়ে আমাদের জন্য এই স্বাধীনতা এনে দিলেন তাঁদের কাছে বাঙালি জাতি আজীবন ঋণী। তাঁদের পুণ্যস্মৃতি বুকে জড়িয়েই বাঙালির নিত্যকার পথচলা।
এদেশের মুক্তির জন্য সর্বস্ব হারানো তেমনি এক মায়ের নাম রমা চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন প্রিয়তম স্বামী, হারিয়েছেন সন্তান। পাক হানাদারের হাতে হারিয়েছেন অমূল্য সম্ভ্রম। গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাঁর ঘরবাড়ি। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবন বড় একটা সুখে কাটেনি। তিনি ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। স্বাধীনতা চলাকালীন সময়ে তিনি শিক্ষকতা করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বই লিখতেন আর অফিস-আদালত- শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে সেই বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। "একাত্তরের জননী " তাঁর বিখ্যাত বই। তাঁর প্রতি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা এই বইয়ে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা ১৮।
স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর পর তিনি কখনোই পায়ে জুতো পরতেন না, খালি পায়েই সর্বত্র আসা-যাওয়া করতেন। তিনি বলতেন, "যে দেশের মাটি লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তে স্নাত, সে মাটির ওপর জুতো পায়ে দিয়ে কেমন করে হাঁটি?" ভীষণ স্বাধীনচেতা ও ঋজু ব্যক্তিত্ববান এই নারী কখনোই কোনো ব্যক্তিক বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি বলতেন, "স্বামী-পুত্র-সম্ভ্রম হারানোর যে মূল্য, কোনোকিছুর বিনিময়েই সেই ঋণশোধ সম্ভব নয়।" দেশের জন্য কতোটা মমত্ববোধ থাকলে আর নিবেদিতপ্রাণ হলে এমন প্রত্যয় ধারণ করা যায় বুকে!
সত্যিই তাঁর ঋণ, তাঁর মতো মানুষের ঋণ, শোধ হবার নয়। তাঁর সাথে আমার একবার কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ১৯৯৮ সালে। আমি তখন সরকার-নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংকের চট্টগ্রামস্হ একটি শাখার কর্মকর্তা ছিলাম। তিনি যথারীতি নাঙ্গাপায়ে কাঁধে বইয়ের ঝোলা ঝুলিয়ে আমার কক্ষে এসেছিলেন। হাসিমুখে কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের কথা বলেছিলেন। আমি তাঁর কয়েকটি বই "কিনে" নিয়েছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। তারপর ওঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। ২০১৮ সালের আজকের দিনটিতে (৩ সেপ্টেম্বর) তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রিয় পবিত্র মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তাঁর জীবনাচরণের ছায়া অবলম্বনে আমি একটি গল্প লিখেছি--- "স্বাধীনতার কপালে লালটিপ"। নিজেকে "লেখক" হিসেবে পরিচয় দেয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই, কিন্তু এই মহীয়সী রমণীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর সেটি এক ক্ষুদ্র প্রয়াস।
পরপারে ভালো থাকবেন বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। যে অপরিসীম ঋণে আপনি আমাদেরকে জড়িয়ে গেলেন, আমরা যেন তার মর্যাদাটুকু বুঝতে পারি। আপনার নাঙ্গাপায়ের ধূলো হোক এদেশের কূলবধুদের মাথার সিঁদুর, আপনার উৎপলোপম পদযুগল হোক এদেশের লক্ষকোটি জনতার চুম্বন-বেদী।
হৃদয়নিংড়ানো শ্রদ্ধা জেনো, মা জননী।
আপনার মতামত লিখুন :