kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লোকভাষা এবং একুশের চেতনা


কালচিত্র | জাফর জয়নাল প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ১০:৪০ এএম লোকভাষা এবং একুশের চেতনা

জাফর জয়নাল

লোকভাষা এবং একুশের চেতনা

স্বদেশীয় উচ্চারণপ্রণালী, ব্যাকরণগত কাঠামো এবং মুখের ভাবপ্রকাশের ধরনের সঙ্গে গ্রাম্য অথবা পুরোনো বিষয় সংস্কৃতির একটি গুরুত্ব অংশ। ‘লোক ভাষা’ অনেকটা ‘ফোক’ এবং ‘লোর’ এর মতো, এটি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে মৌখিক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পরিবাহিত হয়, অপরদিকে জনগণের তথাকথিত যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আয়তনের বিধিনিষেধের ভিতর এটা ততো টা গড়ে উঠে না। এটি প্রাথমিকভাবে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে যুক্ত, এটি কৃষি কিংবা শিল্প ব্যবস্থাতেও হতে পারে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় এতে আঞ্চলিক স্বরাঘাত প্রবলভাবে কাজ করে। লোকভাষা কারো দ্বারা ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ব্যক্তিগত পরিসরে যাদের কেউ মধ্যবয়সে পৌঁচ্ছে, যাদের সামান্য পরিচয় রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে, যার আয় জাতীয় গড় আয়ের নিচের দিকে থাকে। কারণ লোকভাষা অনেক প্রজন্মের চিন্তা কে ধারণ করে। লোকভাষা ভিতর থাকে অনেক অপ্রচলিত ভাব এবং শব্দের প্রয়োগ, যার ব্যবহার প্রায় প্রবাদের ভিতর দেখা যায়।

অনেক উচ্চারণপ্রণালীতে শব্দ, ব্যাকরণগত কাঠামো এবং নিয়মতান্ত্রিক গঠন স্বীকৃত যে লোকভাষা সাধারণ ভাষার প্রাথমিক পর্যায়ের রূপ, যেটি অনেক ক্ষেত্রেই অপরিবর্তিত থেকেছে। কখনো আবার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উপভাষার রূপ নিয়েছে। কিন্তু এই লোকভাষা জাতীয় ভাষার মতো আজ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ বৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণের ভাষার ভিতর ঢুকে পড়ছে ইংরেজি ভাষার প্রভাব সরাসরিভাবে। যেহেতু ভাষা জ্ঞানকে ধারণ করে রাখে, ধরে রাখে সময়ের ইতিহাসকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মূলকথা ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ভিতর দিয়ে ভাষার জ্ঞান ভাণ্ডারকে রক্ষা করা এবং জাতি হিসেবে নিজেদের অধিকার আদায়ের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। লোকভাষায় তেমনিভাবে আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বিশ্বাসের জ্ঞান ভাণ্ডার সঞ্চিত থাকে। নোয়াখালীর একজন মানুষ যখন কাউকে ‘পাগল’ এবং অপরজনকে ‘ফাগল’ বলে তার ভিতর একটা চিন্তাগত পার্থক্য রয়েছে। ‘পাগল’ শব্দে দিয়ে নোয়াখালীতে ছোট পাগলকে বোঝায়, অন্য দিকে ‘ফাগল’ শব্দ দিয়ে বোঝায় বড় পাগলকে। এই ধরনের নিজস্ব বোধ গোষ্ঠীগত জীবন চর্চার অংশ। আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক জীবনের এই শেকড় বিচ্ছিন্ন জীবনের কারণে ভাষার এই একান্ত নিজস্ব সৌন্দর্য আজ হারাতে বসেছে। সংস্কৃতির লোকায়াত মূল অন্বেষণের জন্য লোকভাষার কোন ভালো বিকল্প হতে পারে না। লালন শাহ তাঁর বাউলগানে যখন বলেন ‘খোঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়...’ , তখন গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের মানুষরা ঠিকই বুঝতে পারলেও বাইরের মানুষজন তা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারে না। অথচ এখানে রয়েছে আমাদের ঐতিহ্যের শেকড় প্রোথিত। লালন যখন বলছেন ...‘কমনে’ আসে যায়... কিংবা ‘পাখি’র কথা তখন আমাদের লোকভাষার কাছে ফিরে যেতে হয়। এখানেই যে জীবনের রহস্য, আমাদের সংস্কৃতির শেকড় রস সংগ্রহ করে আজও বহমান রয়েছে এখানে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় ১৯৬৫ সালে ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ প্রকাশের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ভাষার প্রতি গুরুত্ব আরোপের কাজটি শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর দাঁড়িয়ে আমরা জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাষা কিংবা বিদেশি ভাষার প্রতি যতটা গুরুত্ব দিয়েছি, ততোটা গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের ঘরের ভিতর বেড়ে ওঠা ভাষার প্রতি কতটা মূল্যায়ন করেছি আজ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মনে সেই প্রশ্ন জেগে ওঠেছে। এবিষয়ে আমাদের যথেষ্ট ভাবনার অবকাশ রয়েছে বৈকি! আজ এপর্যন্ত থাক, অন্যদিন অন্য কথা হবে।

লেখক: জাফর জয়নাল পেশাগতভাবে তিনি শিক্ষকতা করেন। কবিতা লেখার চেষ্টা করেন নিয়মিতভাবে। অনুবাদে তিনি গদ্য অনুবাদে আনন্দ পান। সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধের অনুবাদের প্রতি তাঁর আগ্রহ রয়েছে। ‘ফোকলোর ও জেন্ডার’, ‘সংগীতনৃবিদ্যা’ এবং ‘সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ ইত্যাদি তাঁর অন্যতম অনুবাদ প্রবন্ধ।

Side banner