kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১৭ ভাদ্র ১৪৩২

বৈপরীত্য ও গণমাধ্যম


কালচিত্র |   উত্তম কুমার আচার্য্য প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২০, ০৯:৪৪ পিএম বৈপরীত্য ও গণমাধ্যম

রোম নগরী যখন জ্বলছিল তখন সম্রাট নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন‍‍` ...... এটি অবস্থার বৈপরীত্যকে প্রকাশ করে। ‍‍`বিপরীত‍‍` শব্দটির বিশেষ্য ‍‍`বৈপরীত্য‍‍` এ কথা বৈয়াকরণরা বলেন। 

কোনো কোনো শব্দের ব্যুৎপত্তিগত কিংবা আভিধানিক অর্থ সাধারণের বোধগম্য না হলেও বাস্তবতার নিরিখে তা সহজেই সাধারণের বোধ্য হয়। প্রত্যক্ষণ, স্থিরচিত্র কিংবা চলচ্চিত্র, শ্রুতিসাধ্য ঘটনাবলী, পাঠযোগ্য বিষয়াবলীর মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, দর্শক, শ্রোতা কিংবা পাঠক অন্যান্য শব্দের মতই বৈপরীত্যের ধারণা পান সহজেই। বৈপরীত্য, অসাম্য, ভিন্নতা, বৈসাদৃশ্য, বিরুদ্ধতা, প্রতিকূলতা, বৈষম্য- এই শব্দগুলো সাধারণভাবে একই মনে হলেও এদের অর্থের মধ্যে অসমতা রয়েছে। 

বৈপরীত্যের সাথে বৈষম্য ও অসংগতি‍‍`র রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। বৈপরীত্য আর বৈচিত্র্য চমৎকার দু‍‍টি ধারণা। বৈপরীত্য প্রায়শ: কাম্য হয় না। কিন্তু বৈচিত্র্য কামনা করেন প্রায় সকলেই। খাবারে, পোশাকে, জীবনযাত্রায়, সংস্কৃতিতে, জীবজগতে, মহাবিশ্বে, মননে, জন্ম ও মৃত্যুতে বৈচিত্র্যের ধারণা মানুষের বোধকে দিয়েছে অনন্য স্বাতন্ত্র্য। বৈপরীত্যের সাথে তুলনার সম্পর্ক যেমন, বৈচিত্র্যের সাথে বহুত্বের সম্পর্কও তেমন। বৈচিত্র্য গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বৈপরীত্য তা পায় না। যেমনটা হওয়ার কথা ছিল তা হয়ইনি; বরং সম্পূর্ণ উল্টো একটা চিত্র যদি আমরা পাই তবে বলি বিপরীত হয়েছে। 

পাকিস্তান সৃষ্টির সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল এবং এটা যৌক্তিকভাবে যথার্থ ছিল। কিন্তু উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হলো, যেটি ছিল পাকিস্তানের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। 

সত্তর এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী দলকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি, হলো বিপরীত। তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। কিন্তু হয় বিপরীত, জনগন হয় বারবার উপেক্ষিত। জনপ্রতিনিধিদের নিকট যৌক্তিকভাবে কাম্য থাকে জনগণের সেবা। তবে তারা (ব্যতিক্রম বাদে) আত্মসেবার জন্য জনগণকেই বলির পাঁঠা বানান। নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করার কথা থাকে যাদের, তারা থাকেন নিজের কিংবা বিশেষ কারো সুবিধা সৃষ্টির কাজে লিপ্ত। সন্তানের উচিৎ কর্তব্য মাতাপিতার যত্ন নেয়া কিন্তু অনেকে মাতা-পিতাকে অবহেলা করেন এবং কখনো কখনো নির্যাতনও করেন কিংবা পাঠান বৃদ্ধাশ্রমে। এভাবে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির বৈপরীত্য আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বংশ বিস্তার করে। আমরা বৈপরীত্যের সমালোচনা করি আবার একে লালনও করি। এও এক বৈপরীত্য ছাড়া আর কিছু নয়। বৈপরীত্যের এরকম হাজারো দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে আমরা প্রত্যক্ষ করি কিংবা কখনো কখনো নিজেরাও নিয়ামক হই। 

তবে সমাজকে এগোতে হবে। অনাকাঙ্খিত বৈপরীত্যের প্রতিকার করতে হবে। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির বৈপরীত্য ঘুচাতে হবে। এ বৈপরীত্য ঘুচাতে গণমাধ্যম শুধু জেগে থাকে তাই নয়, জাগিয়েও তোলে। গণমাধ্যম আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্ত:রাষ্ট্রীয় বৈপরীত্যকে তুলে ধরে প্রতিকারকে ত্বরান্বিত করে। এক্ষেত্রে এরা তৃতীয় নেত্রের ভূমিকা পালন করে। একটি জাতিকে সঠিক পথে চালনা করার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে বৈপরীত্যের শিকার হওয়া সত্বেও সাধারণভাবে অসাধারণ দায়িত্বশীলতার পরিচয় তারা দিয়ে থাকেন। 

নাগরিক জীবনকে যাপনযোগ্য করার কথা যাদের, তারা যদি চিন্তা ও কর্মে বৈপরীত্য লালন করেন এবং আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকেন, তাহলে সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গাটা ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসে। এ সংকোচন প্রগতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সবাই দেখে দেখে যায়, সয়ে যায় অদ্ভুত বৈপরীত্য। নিজের শরীরের ভেতর পুষ্পশয্যা তৈরি করে তাতে সুখনিদ্রা দেন আমাদের চিন্তকবৃন্দ। কিন্তু গণমাধ্যম জেগে থাকে বৈপরীত্য ও অসংগতির বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। তারা চেতনার পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বৈপরীত্য ও অসংগতির প্রতিটি ছবি সর্বসমক্ষে মেলে ধরেন এ প্রত্যাশায় যে, এ অনাকাঙ্খিত বৈপরীত্যের আশু সমাধান হবে, আত্মমগ্নতার নিদ্রা ভেঙে সমাজ নির্মাণের শিথিলবোধ কান্ডারিরা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠবে। 

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

আরআইএস 

Side banner